স্বাধীনতা, ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং পদ্মা সেতু একই সূত্রে গাঁথা

পদ্মা সেতুতে প্রধানমন্ত্রী, জয় ও পুতুল
পদ্মা সেতুতে প্রধানমন্ত্রী, জয় ও পুতুল  © সংগৃহীত

এবছর মে-জুন মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষা সফররে সময় ৬ই মে নিউইয়র্কের ঐতিহাসিক ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে বাংলাদশের স্বাধীনতার সুবর্নজয়ন্তী  কনসার্টে আমার অংশগ্রহণ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্মানিত আইসিটি উপদেষ্টা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী, আইসিটি প্রতিমন্ত্রীসহ দেশ বিদেশের হাজারো দর্শকের উপস্থিতিতে মূল মঞ্চে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয়।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নের্তত্বে আমাদের র্দীঘদিনের লালিত স্বাধীনতা এবং বিশেষ করে গত এক দশকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির কথা মনে করে দুচোখে পানি চলে এসেছিল। উদীয়মান অর্থনীতি, ডিজিটাল মডেল দেশ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, শতভাগ বিদ্যুতায়ন,ব্লেন্ডেড ও ডিজিটাল শিক্ষা, আশ্রায়ণ প্রকল্প, নারীর ক্ষমতায়নসহ অনেক গৌরবের বিষয় আছে আমাদের, যদিও কিসিঞ্জার একসময় এই দেশটিকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে অভিহিত করেছিল।

আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা কোনো নির্দিষ্ট বছরে বা আকস্মিক ঘোষণার মাধ্যমে অর্জিত হয়নি, বরং দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সংঘটিত ঘটনার ধারাবাহিকতায় আমাদের আলোকপাত করতে হবে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বাঙালির আশা-আকাঙ্খা নস্যাৎ করে সর্বক্ষেত্রে বৈষম্য আর নিপীড়ন ও নৃশংসতা চালাতে শুরু করে।

ফলস্বরূপ, অনেকগুলো ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটেছিল যার মধ্যে রয়েছে ২৩শে জুন ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন, ১৯৫২ সালরে ২১শে ফেব্রুয়ারী ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের শুরু,৭ই জুন ১৯৬৬ সালে বাঙ্গালীর মুক্তির সনদ বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানে গণঅভ্যুত্থান এবং একনায়কের অবসান, ১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদের নির্বাচন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি, ৭ই মার্চ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫শে র্মাচ ১৯৭১ সালে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী র্কতৃক অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা এবং নিরস্ত্র বাঙ্গালীর উপর হত্যাযজ্ঞ শুরু, ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, নয় মাস র্দীঘ মুক্তিযুদ্ধ শুরু এবং অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ৩০ লক্ষ শহীদ এবং ২-৪ লক্ষ ধর্ষিত নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে চূড়ান্ত স্বাধীনতা লাভ। 

বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন ‘সোনার বাংলা’- একটি ক্ষুধা ও দুর্নীতিমুক্ত, জ্ঞানভিত্তিক, প্রযুক্তিনির্ভর, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে প্রথম বিজয় দিবস বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) প্রতিষ্ঠা করে এবং ১৯৭৩ সালে কার্যক্রম শুরু হয়; ১৯৭৩ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর আর্ন্তজাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন এর সদস্য হয়, ২২ ফেব্রুয়ারী এবং ১৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ সালে যথাক্রমে ওআইসি এবং জাতিসংঘের পূর্ন সদস্য লাভ করে ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধু প্রথমে মঙ্গাপীড়িত উত্তরবঙ্গের কথা বিবেচনা করে যমুনা নদীর উপর একটি সেতু নির্মাণের কথা ভেবেছিলেন কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে পদ্মা সেতুও ছিল তাঁর পরিকল্পনায়। তাঁর সরকারের সময় অনেক দূরদর্শী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তাকে তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত সময় আমরা দিতে পারিনি।

দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পিতার বপন করা বীজকে শুধু চারায় রূপান্তরিত করতে পেরেছিলেন, অনেক দূরদর্শী উদ্যোগ সম্পন্ন করার জন্য পর্যাপ্ত সময় পাননি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আবার ক্ষমতায় আসে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখা প্রণয়ন করে। বঙ্গবন্ধুর একই দর্শন বহন করে বর্তমান ডিজিটাল বিশ্বে তার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার সুযোগ্য আইসিটি উপদেষ্টা জনাব সজীব ওয়াজেদ জয়ের দূরদর্শী নের্তত্বে 'ডজিটিাল বাংলাদেশ' হিসেবে দেশ-বিদেশে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং তা এখন ২০৪১ সালের 'স্মার্ট বাংলাদেশ' বিনির্মাণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সরকার ভিশন-২০২১ বাস্তবায়ন করেছে এবং একটি নিরাপদ, উন্নত এবং উদ্ভাবনী দেশের মর্যদায় পৌঁছাতে ভিশন ২০৩০, ভিশন ২০৪১, ভিশন ২০৭১ এবং ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করছে।

আরও পড়ুন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের ফল প্রকাশ, পাসের হার ৮.৫৮%।

সদ্য স্বাধীন দেশে যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু আইটিইউ সদস্য হয়ে বেতবুনিয়ায় স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশনে স্থাপন করার মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশের বীজ বপন করেছিলেন। বর্তমান সরকার দেশের প্রথম জিওস্টেশনারি কম্কিউনিকেশেনস অ্যান্ড ব্রডকাস্টিং স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটলোইট-১’ স্পেসএক্স এর মাধ্যমে উৎক্ষপণের ব্যবস্থা করে ২০১৮ সালের ১২ই মে, যেটি মহাকাশ ও আধুনিক টেলিযোগাযোগ সেবা নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। গত ১৩ বছরে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নের ফলে সারা দেশে প্রায় প্রতিটি সেক্টরে বিশাল আইসিটি অবকাঠামো গড়ে উঠেছে এবং তা মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা অনেক সহজ করে দিয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি)।

এখন ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবলের মাধ্যমে সংযুক্ত হচ্ছে স্কুলগুলো এখন শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব দিয়ে সজ্জিত, হাজার হাজার ইন্টারেক্টিভ কনটেন্ট এবং ই-বুক ডিজাইন করা হয়েছে, ১০০টি র্অথনৈতিক অঞ্চল তৈরি করা হচ্ছে ইত্যাদি। ই-পাসর্পোট, অনলাইন পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, মাই.গভ, ই-নথি মুক্তপাঠ, কিশোর বাতায়ন, শিক্ষক বাতায়ন, ৩৩৩ কলসেন্টার, একপে ডজিটিাল সেন্টার, নাইস-৩, সুরক্ষা অ্যাপ, বাংলাদেশ.গভ.বিডি সহ বভিন্নি উদ্যোগের মাধ্যমে সরকার নাগরিক সেবাগুলোকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর জন্য ডিজিটাল সেবায় রূপান্তর করেছে। এভাবইে ডিজিটাল বাংলাদেশ ২০৪১ সালের ‘র্স্মাট বাংলাদেশ’ বিনিমার্ণের জন্য একটি উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম তৈরী করেছে।

পদ্মা সেতু শুধু আমাদের জন্য একটি সেতু নয়, এটি বিশ্বের কাছে আমাদের গর্ব ও মর্যাদার প্রতীক। এটা তৈরী করা সহজ ছিল না কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সাহসী ও দৃঢ় নেতৃত্বে আমরা নিজস্ব অর্থায়নের মাধ্যমে পদ্মা সেতু নির্মণ করতে সক্ষম হয়েছি। প্রকল্পে জড়িত থাকার কথিত দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য দাতা সংস্থাগুলো তাদের অর্থায়ন প্রত্যাহার করে নেয় যদিও পরে কানাডার আদালত রায় দেয় যে এই প্রকল্পে কোনও র্দুনীতি হয়নি। বঙ্গবন্ধুর মতো তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কখনো অন্যায় অবিচারের সাথে আপস করেননি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত এক দশকে ভাল অর্থ নৈতিক প্রবৃদ্ধি এমনকি কোভিড-১৯ এর বৈশ্বিক অস্থিরতার মধ্যেও সেটি বজায় ছিল, যা এই মেগা প্রকল্পের নিজস্ব অর্থনায়নের ভিত্তি তৈরী করেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপছিু আয় ৩২৭ ডলার বেড়ে ২৫৫৪ ডলার এ উন্নীত হয়েছে। সরকার আগামী ২০২২-২৩ র্অথবছরে ৭.৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করেছে। অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনা এবং নেগেটিভ প্রচারণা সত্ত্বেও পদ্মা সেতু প্রকল্পটি সর্ম্পূণ হয়েছে এবং গত ২৫শে জুন ২০২২ এ উদ্বোধন করা হয়েছে। এটি জিডিপিতে ১.২৩ শতাংশ এবং বার্ষিক ০.৮৪ শতাংশ দারদ্র্যি বিমোচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।

পদ্মা বহুমুখী সেতু বাংলাদেশের বৃহত্তম সেতু যেটাতে সড়ক ও রেল উভয়েই আছে। এটি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ২১ জেলাকে উত্তর ও র্পূবাঞ্চলের সাথে সংযুক্ত করবে। ১৮ই সেপ্টম্বর ১৯৯৮ তারিখে পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রস্তাব করা হয় এবং ২০০৭ সালে একটি পরিকল্পনা গৃহীত হয়। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এপ্রিল ২০১০ সালে প্রকল্পটির জন্য প্রাক-যোগ্যতা দরপত্র আহ্বান করে কিন্তু ২০১১ সালে কথিত দুর্নীতি এবং বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দাতা সংস্থাগুলোর অর্থায়ন প্রত্যাহারের কারণে নির্মাণ বিলম্বি হয়। সরকার তখন প্রকল্পের জন্য নিজস্ব অর্থায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। ২৬শে নভেম্বর ২০১৪ সালে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড দ্বারা নির্মণকাজ শুরু হয় এবং ২৩শে জুন ২০২২ এ শেষ হয়। এর মোট দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিমি, প্রস্থ ১৮.১৮ মিটার, উচ্চতা ১২০ মিটার, স্প্যান সংখ্যা ৪১ এবং লেন ৪টি। এমাজনের পরেই পদ্মা বিশ্বের সবচেয়ে তীব্র খরস্রোতা নদী, তাই সেতুটি নির্মাণে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়ছেে যা ইঞ্জিনিয়ারিং ফিল্ডে একটি বিস্ময়। সবদিক বিবেচনা করে প্রকল্পটির খরচ দাড়িয়েছে ৩.৬ বিলিয়ন ডলার।

নিঃসন্দেহে পদ্মা সেতু একটি সাহসী জাতি হিসেবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিশ্বে উজ্জ্বল করেছে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা ও দোহিত্র তাঁর লিগ্যাসি পদ্মা সেতু এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের মাধ্যমে বিশ্বমঞ্চে নিয়ে গেছেন- যা স্বাধীনতা পরর্বতী বাংলাদেশের দুটি বড় মাইলফলক হয়ে থাকবে। আসুন গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানাই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যার জন্য আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ আর তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার আইসিটি উপদেষ্টাকে, যারা এই দেশকে উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের জন্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এছাড়া দেশসেরা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী ও সচিব মহোদয় এবং পদ্মা সেতু প্রকল্পের সাথে জড়িত সকল সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ কে বিশেষ ধন্যবাদ। আমরা যেন তাদের ভুলে না যাই!

লেখক: ব্লেন্ডেড, অনলাইন ও ডিজিটাল এডুকেশন এক্সরপার্ট, সাবেক ফ্যাকাল্টি মেম্বার, আইইউটি, ড্যাফোডিল ও ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি


সর্বশেষ সংবাদ