নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন যারা
শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দেওয়া হয়ে থাকে বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত নোবেল শান্তি পুরস্কার। কিন্তু এই শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছে এমন কিছু ব্যক্তিকে নিয়ে খোদ নোবেল কমিটিতেই হয়েছে অশান্তি। নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্ত ব্যক্তির কর্মকাণ্ড নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। এমনকি কারো নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রত্যাহার করে নেওয়ার দাবিও উঠেছে।
সুইডিশ বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী ও মানবহিতৈষী আলফ্রেড নোবেল যে ছয়টি পুরস্কারের প্রবর্তন করেছিলেন এটি তার একটি। কিন্তু এর রাজনৈতিক প্রকৃতির কারণে এ পদক অন্য পাঁচটি ক্যাটাগরির চেয়ে অনেক বেশি বিতর্ক তৈরি করেছে বিভিন্ন সময়ে।
যাদেরকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া নিয়ে নোবেল কমিটি থেকে শুরু করে বিশ্বব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠেছিল তেমন কিছু ব্যক্তির নাম এখানে তুলে ধরা হলো।
বারাক ওবামা
শান্তিতে নোবেল জয়ীদের অন্যতম হচ্ছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার নয় মাসের মাথায় নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। সমালোচকরা তাকে মনোনয়নের সিদ্ধান্তকে ‘অপরিপক্ক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।
২০১৫ সালে নোবেল ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক গের লান্ডেটস্ট্যাড বিবিসিকে বলেছিলেন, যে কমিটি ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তারা এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে।
২০০৯ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য বারাক ওবামার নাম ঘোষণায় অনেকের মতো তিনি নিজেও ধাক্কা খেয়েছিলেন। ২০২০ সালে নিজের স্মৃতিকথায় ওই ঘোষণার প্রথম প্রতিক্রিয়া হিসেবে ওবামা লিখেছেন, ‘কিসের জন্য?’
ওবামার নোবেল পাওয়া নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনার কারণ হচ্ছে তিনি শান্তিতে নোবেল পেলেও তার আমলে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশের চেয়েও বেশি যুদ্ধে জড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ওবামার আমলে আফগানিস্তান ও ইরাকে নতুন করে বাড়তি সৈন্য মোতায়ন করা হয়। ২০১১ সালের পর মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়ায় যুদ্ধে জড়ায় যুক্তরাষ্ট্র। অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় ওবামার আমলে আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনী সবচেয়ে বেশি বোমা হামলা করে। এই হামলা সবচেয়ে বেশি নিরীহ মানুষের মৃত্যু হয়। এসব কারণে শান্তিতে নোবেল জয়ী ওবামা সমালোচিত হন।
অং সান সুচি
নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী সমালোচিতদের তালিকায় নাম রয়েছে দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়ার দেশ মিয়ানমারের সাবেক স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচি। মিয়ানমারে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য দীর্ঘ সময় কারাবরণ করেন তিনি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও দেশটির সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলনের জন্য ১৯৯১ সালে নোবেল পান সুচি।
কিন্তু এর ২০ বছর পর তার দেশে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর সংঘটিত গণহত্যা ও ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। এই ঘটনায় সূচির ভূমিকা নিয়ে বিশ্বব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠে। রাখাইনের ঘটনাকে জাতিসংঘ গণহত্যা হিসেবে বর্ণনা করেছে। এই ঘটনার জেরে সুচির নোবেল প্রত্যাহার করে নেওয়ার দাবিও উঠে। এই দাবিতে বিশ্বব্যাপী একটি অনলাইন ক্যাম্পেইনও হয়েছিল।
হেনরি কিসিঞ্জার
সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার নোবেল শান্তি পদক পান ১৯৭৩ সালে। কিন্তু কম্বোডিয়ায় বোমা বর্ষণ, দক্ষিণ আমেরিকায় সামরিক শাসনকে সমর্থনসহ আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির ইতিহাসে সবেচেয় বিতর্কিত অধ্যায়ের সাথে জড়িত থাকা কিসিঞ্জারকে এই পুরস্কার দেয়ায় অনেকের চোখ কপালে ওঠে।
যুদ্ধবাজ খ্যাত এই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে শান্তিতে নোবেল দেওয়া নিয়ে তখন বিশ্বব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠে। প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছিলেন নোবেল কমিটির দুজন সদস্য। নিউইয়র্ক টাইমস পুরস্কারটিকে আখ্যায়িত করেছিলো ‘নোবেল ওয়ার প্রাইজ’ হিসেবে।
ওয়াঙ্গারি মাথাই
প্রয়াত এই কেনিয়ান পরিবেশবাদী ছিলেন প্রথম আফ্রিকান নারী, যিনি ২০০৪ সালে নোবেল জয় করেন। কিন্তু এইচআইভি ও এইডস নিয়ে তার এক মন্তব্যের জেরে ব্যাপক সমালোচনার শিকার হন।
ওয়াঙ্গারি মাথাই বলেছিলেন, এইচআইভি ভাইরাস জীবাণু অস্ত্র হিসেবে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে। যার লক্ষ্য ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের শেষ করা। তার দাবির স্বপক্ষে কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না।
ইয়াসির আরাফাত, আইজ্যাক রবিন ও শিমন পেরেজ
প্রয়াত এই ফিলিস্তিনি নেতাকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় ১৯৯৪ সালে। একই সাথে পুরস্কার দেয়া হয়েছিল তখনকার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিমন প্যারেজকে (পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী)।
মূলত ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব অবসানে অসলো শান্তি চুক্তির জন্য তাদের যৌথভাবে পদক দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এক সময়ে প্যারামিলিটারির সাথে জড়িত থাকা ইয়াসির আরাফাতকে পুরস্কার দেয়া নিয়ে বিতর্ক হয় ইসরায়েল ও এর বাইরে।
এমনকি এ মনোনয়ন নিয়ে বিভক্তি দেখা দেয় নোবেল কমিটির মধ্যেই। কমিটির একজন সদস্য প্রতিবাদে পদত্যাগও করেন।
অন্যদিকে সমালোচনা রয়েছে আইজ্যাক রবিনকে নিয়েও। ১৯৪৮ সালের আরব ইসরায়েল যুদ্ধ ও ফিলিস্তিনিদের উচ্ছ্বেদ অভিযান, ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েলের ছয় দিনে যুদ্ধে নেতৃত্বদানসহ ফিলিস্তিনের ভূমি দখলে অন্যতম ভূমিকা ছিল তার। এছাড়াও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে ‘ভূমিদস্যু’ ও যুদ্ধবাজ হিসেবে শিমন পেরেজের কুখ্যাতি রয়েছে আরবদের মাঝে।
আবি আহমেদ
২০২০ সালের ডিসেম্বরে ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদকে নোবেল দেয়া হয় ইরিত্রিয়ার সাথে দীর্ঘ দিনের সীমান্ত সংঘাত নিরসনের উদ্যোগ নেয়ার জন্য। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই এ পুরস্কারের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। কারণ নিজে দেশের টাইগ্রের উত্তরাঞ্চলে সেনা মোতায়েন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি।
সেখানে লড়াইয়ে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয় এবং জাতিসংঘ একে ‘হৃদয় বিদারক বিপর্যয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।