শিক্ষার্থীদের মানসিক সুস্থতায় সিঙ্গাপুরে স্কুলে অভিনব উদ্যোগ

সাপ্তাহিক বিশেষ সেশন
সাপ্তাহিক বিশেষ সেশন  © ফাইল ফটো

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে বিশ্বে বিভিন্ন দেশে কয়েক লাখ শিক্ষার্থী ঘরে থেকে শিক্ষাগ্রহণে বাধ্য হচ্ছে। কিছু দেশে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসায় শিক্ষার্থীরা স্কুলে ফিরতে শুরু করেছে। লকডাউনে থাকাকালে এই শিক্ষার্থীদের, বিশেষ করে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘ মেয়াদে কী প্রভাব পড়ছে, সেটি নিয়ে নতুন উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিবিসির প্রতিবেদনে জানা যায়, মানসিক এই সংকট কাটাতে সিঙ্গাপুরের একটি স্কুলে নেওয়া হয়েছে অভিনব উদ্যোগ।

করোনার কারণে শিক্ষার্থীদের জীবনে বদলে গেছে অনেক কিছুই। সামাজিক কর্মকাণ্ড, খেলাধুলা, সবই বন্ধ। তবে থেমে নেই পড়াশোনা। লকডাউনের পরে যেসব শিক্ষার্থী, বিশেষ করে যেসব শিশু ক্লাসে ফিরছে, তারাও স্বাভাবিক পরিবেশ পাচ্ছে না। মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হচ্ছে। পড়াশোনার চাপও বাড়ছে। ফলাফল ও পড়াশোনার এ চাপ নতুন পরিস্থিতিতে অনেক শিশুই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছে না। বিভিন্ন দেশে পরিচালিত এ–সংক্রান্ত গবেষণা থেকে এমন তথ্যই জানা যায়।

সিঙ্গাপুরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আবার বেড়েছে। সেখানকার বেশ কিছু স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে ঘরবন্দি অবস্থায় শিক্ষার্থীদের উপর মানসিক চাপ বাড়ছে। আর সেই চাপ কমাতে সিঙ্গাপুরের প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্কুলগুলোয় সাপ্তাহিক বিভিন্ন সেশন শুরু হয়েছে

গত মে মাসের শেষ দিকে এসব স্কুলের শিক্ষার্থীরা আবার অনলাইন ক্লাসে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। ১০ দিন পর্যন্ত অনলাইন ক্লাস করেছে এই শিশুরা। সিঙ্গাপুরে পড়াশোনার ক্ষেত্রে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হয় শিক্ষার্থীদের। ফলে, অনলাইনে ক্লাসের সময় অনেক শিক্ষার্থী পিছিয়ে পড়ে। পড়াশোনা নিয়ে অনেকেই উদ্বেগে ভোগে। ১৩ বছর বয়সী কেট লাউ বলে, ‘আমরা পড়াশোনায় ভালো করতে চাই। এ জন্য অনেক বেশি চাপে থাকতে হয়। লকডাউনের পরে ভালো ফল করার চাপ আরও বেড়েছে।’

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসায় কিছু দেশে স্কুল খুলেছে। 

বিশ্বে শিক্ষাক্ষেত্রে সামনের সারিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে সিঙ্গাপুর একটি। শিশুদের ওপর করোনাভাইরাসের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবের ওপর দেশটির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বাড়তি মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। মহামারির আগে সিঙ্গাপুরে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়নি। তবে এখন বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্য ইস্যুতে কাজ চলছে।

সাপ্তাহিক বিশেষ সেশন
এ বছর সিঙ্গাপুরের প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্কুলগুলোয় সাপ্তাহিক বিভিন্ন সেশন শুরু হয়েছে। শিশুরা লকডাউনে কীভাবে নিজেদের উদ্বেগ ও মানসিক চাপ সামাল দিয়েছে এবং পরিস্থিতির উন্নতি ঘটিয়েছে, সে বিষয়ে এসব সেশনে তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়। এসব সেশনে শিশুদের অ্যানিমেটেড ভিডিও দেখানো হয়, যাতে তারা মানসিক চাপগুলোর কারণ বুঝতে পারে এবং তা কাটিয়ে উঠতে পারে। শিক্ষকেরাও তাঁদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের জানান। শিশুদের মানসিক উদ্বেগ কাটাতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।

করোনাকালে শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ বদলেছে

সেরাঙ্গুন সেকেন্ডারি স্কুলের শিক্ষক মিখাইল চাও বলেন, ওই সেশনে কিছু শিক্ষার্থী জানিয়েছে, লকডাউনে ঘরের মধ্যে তারা নিঃসঙ্গ বোধ করেছে। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, অ্যানিমেশনের মাধ্যমে দেওয়া শিক্ষা শিশুদের নিঃসঙ্গতা দূর করতে সহায়তা করবে। অ্যানিমেশন চরিত্রগুলো দেখে শিশুরা বুঝতে পারবে—এ ধরনের সমস্যায় তারা একা নয়, অনেকেই ভুগছে।’

সেশন কতটা কার্যকর
সিঙ্গাপুরের ডিউক এনইউএস মেডিকেল স্কুলের স্বাস্থ্যবিষয়ক অধ্যাপক তাজিন জাফর বলছেন, কোনো কিছুই স্বাভাবিক নেই। শিক্ষার্থীদের সব সময়ই মাস্ক পরতে হয়। দূরত্ব মেনে চলতে হয়। এসবের মধ্যেও তাদের বাড়িতে প্রতিদিন পড়াশোনা সময়মতো করতে হয়। ফলাফলে ভালো গ্রেড পেতে হয়। নতুন এই জীবনযাপনে প্রত্যাশা পূরণে তাল মেলাতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে শিশুরা অতিরিক্ত মানসিক চাপ বোধ করে।

তাজিন জাফর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিশুদের ওপর করোনাভাইরাসের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, শিশুরা আগের মতো সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত নেই। তারা কম খেলে, কম ঘুমায়। তুলনামূলকভাবে ঘরে পড়াশোনার সময় বেড়ে যাচ্ছে। এ ধরনের বাড়তি চাপ থেকেই শিশুদের মধ্যে বিষণ্নতা ও উদ্বেগ জন্মায়।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে সৃষ্ট অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যেকোনো বাড়তি চাপ, যেমন পরীক্ষায় ভালো ফলের চাপ তাদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তোলে। এশিয়ার অন্যান্য দেশেও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

তাজিন জাফর আরও বলছেন, চীনে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েরা করোনার কারণে মানসিক হতাশা ও উদ্বেগের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীরা, যারা কলেজে ভর্তি হবে, তাদের মধ্যে উদ্বেগ ও মানসিক চাপ বেশি। তাঁর মতে, সিঙ্গাপুরে অ্যানিমেশনের মাধ্যমে বিশেষ সেশনে শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে চাঙা রাখার পদ্ধতি খুবই প্রশংসনীয়। দেশটিতে শিক্ষক, নার্স ও মনোবিদদের এ বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে। সাফল্য এলে এই মডেল পুরো দেশে কার্যকর করা যাবে বলে তিনি মনে করেন।

শুধু সিঙ্গাপুর নয়, এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে করোনাকালে শিক্ষার্থীদের মানসিক অসুস্থতা বেড়েছে। ২০১৫ সালে সিঙ্গাপুর ইনস্টিটিউট অব হেলথের গবেষণায় দেখা গেছে, মানসিক এ ধরনের অসুস্থতা থেকে শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা ও আলোচনার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলা সম্ভব। ওই গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের অর্ধেকের বেশি মানসিক দুর্বলতায় ভুগেছে। গবেষণা পরিচালনাকারীদের মধ্যে ১০ জনে ৯ জন মনে করেন, চাইলে এই মানসিক অসুস্থতা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব।

সমস্যা মন দিয়ে শুনলে উপকার হয় বলে জানিয়েছে শিক্ষার্থীরাও। কেটি লাউ বিবিসিকে বলেছে, বিশেষ ওই সেশনের মাধ্যমে সে উপকৃত হয়েছে। কেটি বলেছে, ‘আমি ক্লাসে এখন আমার সমস্যাগুলো খোলামেলাভাবে জানাতে পারি। বন্ধু বা শিক্ষকদের আমার সমস্যার কথা জানাতে পারি।’ কেটির সঙ্গে একমত পোষণ করেছে মুহাম্মদ রায়ান খান। ১৫ বছরের এই কিশোর বলেছে, মানসিক উদ্বেগ থাকলে সে কথা অবশ্যই মন খুলে বলতে হবে।


সর্বশেষ সংবাদ