১১ মে ২০২১, ২৩:০৬

নতুন করে এই লড়াই-সহিংসতা বাঁধলো কেন?

গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলা শুরুর পর একটি ভবন থেকে পালানোর চেষ্টা করছে বাসিন্দরা  © সংগৃহীত

জেরুজালেমে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ইহুদি এবং ইসরায়েলি পুলিশের সাথে ফিলিস্তিনিদের যে ছোটখাটো সংঘাত চলছিল সোমবার (১০ মে) তা বিপজ্জনক এক লড়াইয়ের রূপ নিয়েছে।

এদিন জেরুজালেমে আল-আকসা মসজিদ চত্বরে ঢুকে ইসরায়েলি পুলিশের বেধড়ক লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস এবং রাবার বুলেটে তিনশরও বেশি ফিলিস্তিনি আহত হওয়ার পর গাযা ভূখণ্ড থেকে সশস্ত্র ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েল দিকে রকেট ছোঁড়া শুরু করে।

বদলা নিতে ইসরায়েল গাজায় বিমান হামলা শুরু করেছে, এবং এখন পর্যন্ত পাওয়া খবরে কমপক্ষে ২৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে নয়টি শিশু।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, গাজা থেকে ছোঁড়া রকেটে দক্ষিণাঞ্চলীয় আশকেলন শহরের দুটো বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। আহত হয়েছে ২০ জনের মত।

২০১৪ সালের পরে এই প্রথম গাজা থেকে জেরুজালেমকে লক্ষ্য করে রকেট ছোঁড়া হয়েছে। কয়েকটি রকেট শহরের উপকণ্ঠে এসে পড়ে। যদিও হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।

জেরুজালেমের সাংবাদিক হরিন্দর মিশ্র বলছেন, গত সাত বছরের মধ্যে সোমবার প্রথম জেরুজালেমে জনগণকে সতর্ক করতে কয়েকবার সাইরেন বেজেছে।

“জেরুজালেম শহরের পরিস্থিতি থমথমে। শহরের পূর্ব এবং পশ্চিমের মধ্যে যাতায়াত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মোড়ে মোড়ে এবং স্পর্শকাতর প্রাচীন ধর্মীয় স্থাপনাগুলোর বাইরে প্রচুর পুলিশ। অনেক বছর পর জেরুজালেমে এরকম টান টান উত্তেজনা।”

জেরুজালেম লক্ষ্য করে রকেট ছোঁড়ার ঘটনাকে ইসরায়েল খুবই গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বিনইয়মিন নেতানিয়াহু বলেছেন, হামাস “রেড লাইন” অতিক্রম করেছে এবং এর শাস্তি তাদের পেতে হবে। পরপরই শুরু হয় গাজায় ইসরায়েলি বোমা হামলা।

ইসরায়েলি বিভিন্ন মিডিয়ার খবরে বলা হচ্ছে, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পাঁচ হাজার রিজার্ভ সৈন্য মোতায়েনের এক প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।

যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং জাতিসংঘ ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে নতুন দফা এই সংঘাত ও রক্তপাত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মধ্যস্থতার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।

গাজায় নির্ভরযোগ্য ফিলিস্তিনি সূত্র উদ্ধৃত করে রয়টার্স বার্তা সংস্থা জানিয়েছে, মিশর এবং জাতিসংঘের পক্ষ থেকে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে।

হঠাৎ এই সংঘাত কেন?
কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে নতুন করে এই লড়াই-সহিংসতা বাঁধলো কেন? বিবিসির মধ্যপ্রাচ্য সংবাদদাতা জেরেমি বোওয়েন বলছেন দশকের পর দশক ধরে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধর মূলে যেসব কারণ সেগুলোর কোনো সমাধান এতদিনেও হয়নি বলেই ঘুরে ফিরে এই সংঘাত বাঁধে।

তিনি বলেন, “এবারের সংঘাতের কেন্দ্রে জেরুজালেম। রমজানের সময় পুলিশের বাড়াবাড়ি এবং আদালতের মাধ্যমে কয়েকটি ফিলিস্তিনি পরিবারকে উৎখাতের বিতর্কিত একটি তৎপরতা নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন দফার এই বিরোধ ... তবে অন্য কোনো কারণেও এটি শুরু হতে পারতো।”

পূর্ব জেরুজালেমের আরব অধ্যুষিত এলাকা শেখ জারাহ থেকে চারটি ফিলিস্তিনি পরিবারকে বাড়িছাড়া করার এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে গত কয়েক সপ্তাহ ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

শেখ জারায় যে জমির ওপর ঐ চারটি ফিলিস্তিনি পরিবার গত প্রায় ৭০ বছর ধরে বসবাস করছেন - হঠাৎ তার মালিকানা দাবি করে কয়েকজন কট্টরপন্থী ইহুদি। জেরুজালেম নগর কর্তৃপক্ষ এবং শহরের একটি নিম্ন আদালত সেই দাবি মেনেও নেয়। ফিলিস্তিনিদের ক্ষোভের সূচনা সেখান থেকেই।

বহুদিন ধরেই ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সন্দেহ দানা বেঁধেছে যে ইসারায়েলি দক্ষিণপন্থীরা জেরুজালেম থেকে ছলেবলে তাদের উৎখাত করতে বদ্ধপরিকর, এবং শেখ জারাহ থেকে ঐ চারটি পরিবারকে বাড়িছাড়া করার সিদ্ধান্ত সেই ছকেরই অংশ।

শেখ জারাহ এবং জেরুজালেমের পুরনো এলাকার বিভিন্ন জায়গায় গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ফিলিস্তিনি কিশোর তরুণদের সাথে লেহাবা এবং আরো কিছু কট্টর ইহুদি সংগঠনের সদস্যদের সাথে বিচ্ছিন্নভাবে হাতাহাতি, গালিগালাজ বিনিময় চলছিল।

এরই মধ্যে রোজার শুরুতে পুলিশ জেরুজালেমে ফিলিস্তিনিদের ওপর কিছু বিধিনিষেধ বসালে পরিস্থিতির আরো ঘোলাটে হয়ে ওঠে।

যেমন, বহুদিন ধরেই রোজার সময় পুরনো শহরের দামেস্ক গেটের চত্বরে সন্ধ্যায় জমা হয়ে ইফতার করে অনেক ফিলিস্তিনি। এবার ইসরায়েলি পুলিশ তা নিষিদ্ধ করে - যা নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়।

সেই সাথে যোগ হয় কট্টর ইহুদিদের ‘জেরুজালেম দিবস‘ কুচকাওয়াজ নিয়ে উত্তেজনা।
১৯৬৭ সালে আরবদের সাথে যুদ্ধে পূর্ব জেরুজালেম দখলের ঘটনাকে ইসরায়েলি দক্ষিণপন্থীরা প্রতিবছর উদযাপন করে। প্রতিবছর ১০ মে এই উপলক্ষে কয়েক হাজার ইহুদি পূরব জেরুজালেমের ফিলিস্তিনি এলাকার ভেতরে দিয়ে মিছিল করে।

এবছর ঘটনাক্রমে দিনটি পড়েছে রোজার ভেতর। ফিলিস্তিনিরা চেয়েছিল এবার যেন ঐ মিছিলের রুট বদলানো হয়। কিন্তু ইসরায়েলি পুলিশ বা নগর কর্তৃপক্ষ তাতে কান দেয়নি যা নিয়ে ফিলিস্তিনিরা ক্ষুব্ধ ছিল ।

তবে সোমবার শেষ মুহূর্তের এক সিদ্ধান্তে মিছিলটি ফিলিস্তিনি এলাকায় যেতে দেওয়া হয়নি।

ইসরায়েলি রাজনীতির যোগসূত্র
সোমবার সকালে আল-আকসা মসজিদ চত্বরে ইসরায়েলি পুলিশি অভিযান, তারপর সেই রাতেই ইসরায়েলকে লক্ষ্য গাজা থেকে রকেট ছোঁড়া এবং গাযায় ইসরায়েলি বিমান হামলার পর সংঘাত যে বিপজ্জনক চেহারা নিয়েছে - তা ২০১৮ সালের পর দেখা যায়নি।

সাংবাদিক হরিন্দর মিশ্র বলছেন, কয়েক বছর ধরে শান্তি আলোচনায় পুরোপুরি স্থবিরতা এবং কোভিড প্যানডেমিকের কারণে বহু মানুষ যে অর্থনৈতিক চাপে পড়েছেন সেটিও বহু মানুষের মধ্যে ক্ষোভ এবং হতাশা তৈরি করেছে যেটি, তার মতে, সংঘাতের ঝুঁকি বাড়িয়েছে।

ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও এই সংঘাতর পেছনে কাজ করছে বলে মনে করেন সাংবাদিক মিশ্র।

গত দুই বছর ধরে ইসরায়েলে একের পর এক নির্বাচনে কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছে না। গত নির্বাচনের পরও বিনইয়ামিন নেতানিয়াহু শরীক জোগাড় করে সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হলে প্রেসিডেন্ট বিরোধী ইয়েস আডিট দলের নেতা ইয়ার লাপিডকে সরকার গঠনের সুযোগ দেন।

হরিন্দর মিশ্র বলেন, “সরকার গড়তে হলে আরব দলগুলোর সমর্থন দরকার লাপিডের। সেই চেষ্টা তিনি করছিলেন। এখন জেরুজালেমের ঘটনাপ্রবাহ, ফিলিস্তিনি পরিবার উচ্ছেদের ঘটনায় আরব দলগুলো তো আর কথা বলতে চাইছে না। সোমবারের পর লাপিড এবং তার বর্তমান শরীকদেরও এখন সরকার ও সেনাবাহিনীকে সমর্থন দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না“

ফলে, জোট সরকারের গঠনে লাপিডের চেষ্টা ঝুঁকিতে পড়ে গেছে। সুতরাং, হরিন্দর মিশ্র মনে করেন, চলতি এই সংঘাতের রাজনৈতিক ফায়দা এখন নিশ্চিতভাবেই পাবেন নেতানিয়াহু।

এখন পরিস্থিতির চাপে লাপিড যদি জোট গঠনে ব্যর্থ হন, তাহলে ইসরায়েলে আরেক দফা নির্বাচনের সম্ভাবনা তৈরি হবে। এবং ফিলিস্তিনিদের সাথে চলতি এই বিরোধ হয়তো সেই নির্বাচনে নেতানিয়াহুকে সাহায্য করতে পারে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা