কেটে ফেলা হাতের স্থানে তরুণী ফিরে পেল এক তরুণের হাত
ভারতের পুনার ২১ বছরের এক তরুণী শ্রেয়া। জীবনে ঘটে যাওয়া এক ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর তিনি সাক্ষী হয়েছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক যুগান্তকারী সাফল্যের।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শ্রেয়া তার বাড়ি পুনা থেকে কর্ণাটকের ‘মণিপাল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি’থেকে ফেরার সময়ে ভয়াবহ বাস দুর্ঘটনার শিকার হন। এতে তার দু’টো হাত কনুই এর নিচ থেকে কেটে বাদ দিতে হয়। তার এক বছর পরে তার জীবনে ঘটে যায় বিস্ময়কর একটি ঘটনা। তার কেটে যাওয়া হাতের স্থানে তিনি ফিরে পান এক তরুণের নতুন দু’টো হাত।
ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম দ্যা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, দুর্ঘটনার এক বছর পর তিনি ভারতের কেরালার ‘অমৃতা ইনস্টিটিউটে’ অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য নাম দাখিল করেন। গোটা এশিয়াতে সফলভাবে এই ধরণের অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য ওই হাসপাতালটি একমাত্র প্রতিষ্ঠান। সেই সময় আফগানিস্তান, মালয়েশিয়া এবং বাংলাদেশসহ এ ধরনের মাত্র ২০০টি অঙ্গহানির কেস নথিভুক্ত ছিল।
শ্রেয়া জানান, তিনি এক আফগান নাগরিকের সাথে সাক্ষাত করেছেন যিনি এক বছর আগে থেকে একজন দাতার জন্য অপেক্ষা করেছেন।
হাত দানের বিষয়টি বেশ বিরল। কারণ দাতার শরীরে কৃত্রিম অঙ্গ স্থাপন করা সত্ত্বেও অনেক পরিবার স্বজনের দেহ বিকৃতির ভয়ে অঙ্গদান করতে রাজি হয় না। আলোচিত এই সৌভাগ্যবতী তরুণী অবশেষে তার প্রতিস্থাপনের যোগ্য দাতা পেয়েছিলেন ২০১৭ সালের ৯ আগস্ট মাসে।
শ্রেয়া যুগান্তরকারী সেই সময়ের কথা মনে করে বলেন, ট্রান্সপ্ল্যান্ট সমন্বয়কারীরা বলেছিলেন দাতা জোগাড় হতে কয়েক মাস সময় লাগতে পারে। তাই আমরা কোনো আশা ছাড়াই আমাদের হোটেলে ফিরেছিলাম। কিন্তু এক ঘণ্টা পর হাসপাতাল আমাদের জরুরি রক্ত পরীক্ষার জন্য আবার ফোন করে।
পরে তিনি জানতে পারেন, ওই দিন এর্নাকুলামের রাজগিরি কলেজের শচীন নামের বি.কমের এক শিক্ষার্থী মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হন। যার ফলে তার মস্তিষ্ক মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা। শচীনের পরিবার তার হাত এবং অন্যান্য অঙ্গ দান করতে রাজি হয়েছিলেন।
শ্রেয়ার ও শচীনের রক্তের ধরন মিলে যাওয়ায় সেই হাত প্রতিস্থাপিত হয় তার দেহে। ২০১৭ সালের ৯ আগস্ট জটিল এই প্রতিস্থাপনের কাজে মিলিতভাবে কাজ করেন ২০ জন শল্য চিকিৎসক এবং ১৬ জন চেতনানাশক বিশেষজ্ঞ বা এনেস্থেটিকের দল।
অমৃতা ইনস্টিটিউটের প্লাস্টিক এবং প্রতিস্থাপন বিভাগের প্রধান ডক্টর সুব্রানিয়াম বলেছিলেন, ‘অতীব কঠিন হয় এই ধরনের কাজ। অঙ্গদাতা আর গ্রহীতার অঙ্গের পেশী, রক্তজালিকা থেকে শিরা উপশিরা বা এই সার্বিক খাপ খাওয়ানোর কাজ অতি সময়সাপেক্ষ।
চমক দেখা যায় অন্য জায়গায়। প্রতিস্থাপিত ওই হাতগুলো ছিল একটি ছেলের আর গ্রহীতা ছিল একটি মেয়ে। কিন্তু হাত প্রতিস্থাপনের পর ক্রমশ মেয়েটির হাতের প্রতিস্থাপিত অংশ মেয়েদের ধাঁচের হতে থাকে। একই সাথে ওই দাতা ছেলেটির গায়ের রং কালো হওয়ার কারণে মেলানিন বেশি ছিল ওই হাতে। ধীরে ধীরে ওই প্রতিস্থাপিত হাত দুটোর উপরিভাগের চামড়াও পরিবর্তিত হতে থাকে মেয়েটির শরীরের অন্য অংশের রঙের সাথে। এখন বলা অসম্ভব যে ওটি কোনো আলাদা মানুষের হাত প্রতিস্থাপিত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী দু শ’রও কম হ্যান্ড ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয়েছে। তবে ত্বকের স্বর বা হাতের আকারের পরিবর্তনের কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। চিকিৎসকেরা বলছেন সম্ভবত এটিই প্রথম।
এই অপারেশনের পরের তিন থেকে চার মাসে এই পরিবর্তন আসা শুরু হয়। ভিন্ন লিঙ্গের মানুষের অঙ্গ প্রতিস্থাপন হওয়া সত্ত্বেও ক্রমশ শ্রেয়ার হাতের কব্জি মেয়েলি ধাঁচের হতে থাকে আর আঙ্গুলও পরিবর্তিত হতে থাকে। অমৃতা ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে মূলত মেয়েলি হরমোনের কারণে এটা হতে পারে।
এ বিষয়ে ডা. সুব্রামনিয়া আয়ার বলেন,‘আমরা আশা করছি বৈজ্ঞানিক জার্নালে হ্যান্ড ট্রান্সপ্ল্যান্টের দু’টি ঘটনা প্রকাশিত হবে। তবে এতে সময় লাগবে। আমরা (শ্রেয়ার) ক্ষেত্রে রঙ পরিবর্তন রেকর্ড করছি। তবে আঙুল এবং হাতের আকারের পরিবর্তনটি বুঝতে আমাদের আরও প্রমাণের প্রয়োজন। একজন আফগান সেনা, যিনি একজন পুরুষ দাতার কাছ থেকে ডাবল হ্যান্ড ট্রান্সপ্ল্যান্ট করেন তিনিও ত্বকের কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলেন। তবে গত সপ্তাহে তিনি আফগানিস্তানে মারা গেছেন। তাই আমরা খুব বেশি রেকর্ড রাখতে পারিনি।’
দুর্ঘটনার পর মেয়েটি তার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। তবে এখন তিনি পুনার ফারগুসন কলেজ থেকে অর্থনীতিতে বিএ করছেন। শেষ সেমিস্টারে তিনি হাতে নিজের পরীক্ষা দিয়েছেন।
সূত্র: দ্যা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস