প্ল্যাজারিজমের অভিযোগ উঠেছিল বিশ্বখ্যাত এই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে

উপরের বা দিক থেকে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, জনি ক্যাশ, হেলেন কেলার। নিচের বা দিকে জেইন গুডাল ও ডান দিকে টিএস এলিয়ট।
উপরের বা দিক থেকে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, জনি ক্যাশ, হেলেন কেলার। নিচের বা দিকে জেইন গুডাল ও ডান দিকে টিএস এলিয়ট।  © সংগৃহীত

প্ল্যাজারিজম অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রে বহুল আলোচিত এক শব্দ। কারো লেখা থেকে অংশবিশেষ তার ক্রেডিট না দিয়ে বা সূত্র উল্লেখ না করে নিয়ে সেটি নিজের রচনা বলে চালিয়ে দেওয়াই হলো প্ল্যাজারিজম। একে একধরনের চুরি বলে মনে করা হয়। তবে এটি যেনতেন চুরি নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক চুরি। যেহেতু চুরি বলে কথা তাই বিষয়টি নিন্দনীয়।

প্ল্যাজারিজমকে অ্যাকাডেমিক সেক্টরে বড় ধরনের নৈতিক স্খলন হিসেবে দেখা হয়। এই প্ল্যাজারিজম ঠেকাতে রীতিমতো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। ব্যবহৃত হচ্ছে বিশেষ ধরনের সফটওয়্যার। যেটি জানান দেয়, এটি কী সম্পূর্ণ মৌলিক লেখা না কি লেখক অন্য কোথাও থেকে একটি রচনার অংশবিশেষ ঘোষণা না দিয়ে নিয়েছেন।

বহু বিশ্ববিদ্যালয় ও জার্নাল কর্তৃপক্ষ কোনো লেখা গ্রহণ বা ছাপানোর আগে লেখাটি পুরোপুরি মৌলিক কিনা পরীক্ষা করে নিচ্ছে। যাই হোক, এই প্ল্যাজারিজম শুধু বর্তমান যুগেই ঘটছে এমন কোনো বিষয় নয়। আবার কোনো সাধারণ মানুষই শুধু প্ল্যাজারিজমের কালো তালিকায় নাম লেখান তাও নয়।

কয়েকজন বিশ্বখ্যাত ব্যক্তির বিরুদ্ধেও এই অভিযোগ উঠেছিল, যারা সারাবিশ্বের অত্যন্ত সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব। তারা হলেন,

মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র
মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। তাকে নতুন করে পরিচয় করে দেওয়ার কিছু নেই। তার পরিচয় তিনি নিজেই। তিনি ১৯৬৪ সালে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পান। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তার নেতৃত্বে আমেরিকাতে তুমুল বেগে মানবাধিকার আন্দোলন পরিচালিত হয়।

এ দুর্বার আন্দোলনের ফলে আমেরিকা সরকার বাধ্য হয় কৃষ্ণাঙ্গদের মানবাধিকারসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দিতে। নিপীড়ত ও বঞ্চিত মানুষের মুক্তির প্রতীক হয়ে উঠেন তিনি। নোবেল কমিটি তাকে সম্মানিত করেন নোবেল পুরস্কার দিয়ে। তার ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ ভাষণটি এখনো সারাবিশ্বের নিপীড়িত মানুষকে প্রেরণা যোগায়।

মার্টিন লুথার কিং বোস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তার গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল, ‘পল টিলিচ ও হেনরি নেলসন উইমেনের ভাবনায় ঈশ্বরের ধারণার একটি তুলনা’।

সব ঠিকই ছিল, সমস্যা বাঁধে তার স্ত্রী যখন থিসিস পেপারসহ তার আরো কিছু নথিপত্র স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেন তখন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নজরে আসে, মার্টিন লুথার কিং এর আগের কিছু লেখাজোখা, এমনকি তার গবেষণাপত্রেও বহু লেখকের লেখা থেকে অংশবিশেষ নেওয়া হয়েছে।
ঐতিহাসিক রালফ লুকার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্টিন লুথার কিং পেপার প্রজেক্টে সম্পৃক্ত ছিলেন। তার ভাষ্য, যদি মার্টিন একাডেমিক লাইনে থাকত, তাহলে বিষয়টি আরো অনেক দূর পর্যন্ত গড়াত। কিন্তু তিনি তো একাডেমিক লাইনের কেউ ছিলেন না। আরেকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, মার্টিন লুথার যেই সময়ে গবেষণাপত্রটি সাবমিশন করেছিলেন, সেই সময়ে অবশ্য এ ধরনের কাজ দীর্ঘদিন ধরে চলা একপ্রকারের রেওয়াজই ছিল।

এমনকি মার্টিন লুথার কিংয়ের সেই বিখ্যাত বক্তৃতা ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ও নাকি আর্কিব্যাল্ড ক্যারি নামে এক যাজকের কাছ থেকে চুরি করা বলে অভিযোগ রয়েছে। মজার বিষয় হলো, এই দুজনই আবার স্যামুয়েল ফ্রান্সিস স্মিথ নামে আরেকজনের প্রার্থনাসঙ্গীত ‘আমেরিকা’ থেকে টুকলিফাই করেছিলেন।

মার্টিন লুথার কিং এর প্ল্যাজিরজমের অভিযোগের ব্যাপারে বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত দীর্ঘদিন ধরে চলে। ১৯৯১ সালে কর্তৃপক্ষ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে গবেষণাপত্রে প্ল্যাজারিজমের অভিযোগটি সত্য। তার ডিগ্রি বাতিলে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন জায়গা থেকে জোর আপত্তি আসে। পরে অবশ্য কর্তৃপক্ষ আর ডিগ্রি বাতিল করেনি।

জেইন গুডাল

সাধারণ মানুষ নাম জানে এমন হাতে গোনা কয়েকজন বিজ্ঞানীর তিনি একজন। তানজানিয়ায় শিম্পাঞ্জি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে তিনি বিখ্যাত হন। শিম্পাঞ্জির আচরণ নিয়ে তার ৫০ বছরের গবেষণালব্ধ লেখালেখি ও বই মানুষকে শিম্পাঞ্জির সম্পর্কে জানতে সাহায্য করেছে।
এই গুডালের বিরুদ্ধেই প্ল্যাজারিজমের অভিযোগ উঠেছিল, যা তার দীর্ঘ বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের শেষের দিকের ঘটনা।
২০১৩ সালের শুরুর দিকের কথা। গুডাল তার নতুন বই সিডস অব হোপ (Seeds of Hope) বই প্রকাশের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ সময় বইয়ের কিছু রিভিউ পাঠানো হয়েছিল কয়েকটি পত্রিকায়।

সর্বপ্রথম ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক স্টিভেন লেভিংস্টনের সবার নজরে আনেন যে, গুডালের বইয়ে কয়েকটি অনুচ্ছেদ রয়েছে, যা তার নিজের লেখা নয়। তিনি কোথা থেকে তা নিয়েছেন তারও উল্লেখ নেই। ঘটনাটি চারদিকে শোরগোল সৃষ্টি করে। পরে জানা গেল গুডাল উইকিপিডিয়া ও অখ্যাত কয়েকটি ওয়েবসাইট থেকে তথ্য নিয়েছিলেন। গুডাল ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং শেষশেষ বইটি আলোর মুখও দেখেছিল।

জনি ক্যাশ

মিউজিক ইতিহাসের এক বিখ্যাত নাম জনি ক্যাশ। তার ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে তাকে একজন কান্ট্রি মিউজিশিয়ান মনে করা হতো। কিন্তু পরে সঙ্গীতভূবনের নানা দিকে তার পদচারণা দেখা যায়।

১৯৫৫ সালে জনি ক্যাশ ‘ফলসম প্রিজন ব্লুস’ গানটি রেকর্ড করেন। যেখানে একজন সাজাপ্রাপ্ত খুনিকে জেলখানার পাশ দিয়ে যাওয়া ট্রেনের বিকট শব্দ শুনিয়ে নির্যাতন করা হতো।
জানা গেছে, জনি ক্যাশ গর্ডন জেনকিনসের ক্রিসেন্ট সিটি ব্লুস গানটির কথা ও সুর ব্যাপক মাত্রায় পরিমার্জন করে তার গানটি তৈরি করেন।
পরে এ নিয়ে মামলা হয় জনি ক্যাশের বিরুদ্ধে। মামলার মধ্যখানে দুই পক্ষ বিষয়টি নিয়ে একটি সমঝোতায় পৌঁছায়। এজন্য অবশ্য জনি ক্যাশকে গুনতে হয়েছিল ৭৫ হাজার ডলার। আর এখনকার হিসেবে ৬ লাখ ৬০ হাজার ডলারে হয় সেই দফারফা।

শুধু জনি ক্যাশ একাই নন, দ্য বিচ বয়েজ, জর্জ হ্যারিসন এবং হালের স্যাম স্মিথকে প্ল্যাজিরজমের অভিযোগ খণ্ডাতে আইনের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। এদিক দিয়ে লেড যেপেলিন হলেন সিরিয়াল মিউজিক প্ল্যাজারিস্ট, যিনি এই বিষয়টাকে পাত্তাই দেন না।

হেলেন কেলার

বিখ্যাত মার্কিন লেখক, সুবক্তা ও রাজনৈতিক আন্দোলনকর্মী হেলেন কেলারের জন্ম ১৮৮০ সালে। তার বয়স যখন মাত্র ১৯ মাস, ঠিক তখন এমন এক অসুখে পড়েন, যে অসুখ কেড়ে নিয়েছিল তার দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি। তবে হারিয়ে ফেলা দৃষ্টিশক্তি বা শ্রবণশক্তি বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি তার উচ্চশিক্ষা অর্জনের পথে। তিনি হলেন প্রথম অন্ধ ও বধির যিনি ব্যাচেলর অব আটর্স ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন।

তাকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘দ্য মিরাকল ওয়ার্কার’। তার আত্মজীবনী মাই লাইফও অত্যন্ত সুপাঠ্য।
এই হেলেন কেলারের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছিল প্ল্যজারিজমের। ঘটনাটি এমন: হেলেনের বয়স তখন মাত্র ১১ বছর। ওই বয়সেই তিনি সেলিব্রেটি। দ্য ফ্রস্ট কিং নামে তিনি ছোটদের জন্য একটি গল্প লেখেন। গল্পটি ছাপা হয় দ্য গুডসন গ্যাজেটে।

জার্নালটি মূলত অন্ধ ও বধিরদের শিক্ষায় কাজ করত। গল্পটি ছাপা হওয়ার পর দেখা গেল, আরেকটি গল্পের সঙ্গে এর অনেক মিল রয়েছে। আর ওই গল্পটি লেখেন মার্গারেট ক্যানবি, ফ্রস্ট ফেইরিজ শিরোনামে।
হেলেন কেলার অভিযোগের ব্যাপারে দিব্যি কেটে বলেন, তিনি অন্য কোনো বই থেকে গল্পটি নেননি, এমনকি গল্পটি তার পড়াই হয়নি। তার কাছে ফ্রস্ট ফেইরিজ গল্পের কোনো কপিও নেই।
এ বিষয়ে হেলেন কেলারের শিক্ষক সুলিভান দেন চমকপ্রদ তথ্য। তিনি জানান যে, সুলিভান যখন একবার ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন, তখন হেলেন কেলারকে আরেকটি বাড়িতে রাখা হয়েছিল। আর সেই বাড়িতেই ছিল বইটি। ওই বাড়িরই কেউ হয়তো তাকে গল্পটি শুনিয়েছিল।
যদিও এই ছোট্ট বিষয়টি ছাড়া হেলেন কেলারের ক্যারিয়ারে আর কোনো অভিযোগ আসেনি। আর বিষয়টিকে একটি নিছক ভুল ছাড়া আর কিছুই ভাবতে রাজি নন বিশেষজ্ঞরা।

টিএস এলিয়ট

বিশ্ববিখ্যাত কবি থমাস স্টার্ন এলিয়ট ১৯৪৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯২২ সালে এলিয়ট তার বিখ্যাত কবিতা দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড রচনা করেন। তারও বহু বছর পর অভিযোগ উঠে তিনি এই কবিতাটি এক অখ্যাত কবির কবিতা থেকে নিয়েছিলেন।

জীবদ্দশায় তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ হালে বাতাস পেত না। কিন্তু তার মৃত্যুর পর সমালোচকরা এ বিষয়টি নিয়ে অনেক সমালোচনা করতে শুরু করেন।

তথ্যসূত্র : প্ল্যাজারিজমটুডে

লেখক : পলাশ সরকার


সর্বশেষ সংবাদ