মুসলিম যুবককে বিয়ে করায় তরুণীর গর্ভপাত, ভারতে বিতর্ক তুঙ্গে
ভারতের নতুন ধর্মান্তকরণ বিরোধী আইন নিয়ে বিতর্কে আবার নতুন মাত্রা যোগ করেছে একজন অন্ত:স্বত্তা হিন্দু নারীকে জোর করে তার মুসলিম স্বামীর কাছ থেকে আলাদা করে দেবার পর গর্ভপাত হয়ে যাবার খবর। চলতি মাসের শুরুর দিকে একটি ভিডিও ভারতের সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। এতে দেখা যায়, উত্তর প্রদেশ রাজ্যের মোরাদাবাদ শহরে একদল পুরুষ এক নারীকে হেনস্তা করছে। তাদের গলায় জড়ানো কমলা রঙয়ের উত্তরীয়।
‘তোমার মত লোকেদের জন্যই বাধ্য হয়ে আইন আনতে হয়েছে’, একজন পুরুষ এই বলে তাকে তিরস্কার করছে। হেনস্তাকারীরা বজরং দলের সমর্থক। কট্টর হিন্দুত্ববাদী এই দল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিজেপির সমর্থক। যে আইনের কথা তারা বলছে, সেটা হল উত্তর প্রদেশ রাজ্যে সম্প্রতি চালু হওয়া অবৈধভাবে ধর্মান্তকরণ নিষিদ্ধ করে প্রণীত অধ্যাদেশ।
বিবিসি বাংলা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এই আইন করা হয়েছে মূলত ‘লাভ জিহাদ’কে লক্ষ্য করে। এই লাভ জিহাদ কথাটি মুসলিম বিরোধী কট্টর হিন্দু সংগঠনের তৈরি। তারা এই লাভ-জিহাদ তত্ত্ব ছড়িয়ে বলছে, মুসলিম পুরুষরা হিন্দু নারীদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করার উদ্দেশ্যে প্রেমের ছল দেখিয়ে তাদের বিয়ে করে।
ভিডিওতে তোলা এ ঘটনা ঘটেছে ৫ ডিসেম্বর। এতে দেখা যায় বজরং দলের সক্রিয় কর্মীরা ২২ বছরের এই নারীকে হেনস্তার পর তাকে এবং তার সাথে তার স্বামী ও স্বামীর ভাইকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। পুলিশ এরপর ওই নারীকে পাঠিয়ে দেয় সরকারের একটি আশ্রয় কেন্দ্রে এবং তার স্বামী ও স্বামীর ভাইকে গ্রেফতার করে। ওই নারী সাত সপ্তাহের অন্তঃস্বত্তা ছিলেন। ঘটনার কয়েকদিন পর, ওই নারী অভিযোগ করেন, হেফাজতে থাকা অবস্থায় তার গর্ভপাত হয়েছে।
এ সপ্তাহের শুরুতে, আদালত ওই নারীকে তার স্বামীর বাসায় ফিরে যাবার অনুমতি দেয়। তিনি আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটকে বলেন, তিনি প্রাপ্তবয়স্ক এবং নিজের ইচ্ছায় ওই পুরুষকে বিয়ে করেছেন। তবে তার স্বামী এবং স্বামীর ভাই এখনও জেলে রয়েছেন। গত সোমবার ছাড়া পাবার পর ওই নারী সংবাদমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করেছেন, সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রের কর্মচারীরা তার সাথে দুর্ব্যবহার করেছে এবং তার পেটে ব্যথা হচ্ছে একথা বলার পরেও প্রথমদিকে সে কথা তারা কানেই নেয়নি। আশ্রয়কেন্দ্র এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
তিনি বলেন, ‘আমার অবস্থার যখন খারাপ হয়, ওরা আমাকে একটা হাসপাতালে নিয়ে যায় (১১ ডিসেম্বরে)। সেখানে রক্ত পরীক্ষার পর, ওরা আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করে ও আমাকে ইনজেকশান দেয়। এরপর আমার রক্তপাত শুরু হয়ে যায়।’ এর দুদিন পর, তাকে আরও ইনজেকশান দেয়া হয়। তার রক্তপাত আরও বাড়তে থাকে এবং স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। তার গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে যায় বলে তিনি জানান।
তিনি যা বলছেন তা সঠিক কিনা এবং হাসপাতালে ঠিক কী ঘটেছিল তা এখনও স্পষ্ট নয়। গত সোমবার সকালে যে সময় তিনি ওই আটককেন্দ্রে ছিলেন, তখন তার গর্ভপাতের খবর আশ্রয়কেন্দ্রর কর্তৃপক্ষ নাকচ করে দেন। তার গর্ভপাতের খবরের ভিত্তি ছিল সেসময় তার শাশুড়ির দেয়া একটি সাক্ষাৎকার। শিশু সুরক্ষা কমিশনের সভাপতি ভিশেশ গুপ্তা গর্ভের ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যাবার সব খবর অস্বীকার করেছেন, এমনকি তিনি জোর দিয়ে এও বলেছেন যে ‘গর্ভের শিশুটি নিরাপদ আছে।’
যে হাসপাতালে ওই নারীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেখানকার একজন স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আলট্রাসাউন্ডে তারা সাত সপ্তাহের ভ্রূণটি দেখতে পেয়েছেন।’ তবে ওই চিকিৎসক বলেছেন, একমাত্র '‘যোনিপথ দিয়ে আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষা করলে তবেই নিশ্চিতভাবে বোঝা যাবে, ভ্রূণ নিরাপদ আছে কিনা।’
তবে ওই নারী আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ছাড়া পাবার পর যেসব অভিযোগ করেছেন তা নিয়ে কর্তৃপক্ষ এখনও কোন মন্তব্য করেনি। তারা হাসপাতালে ওই নারীর আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষার ফল তার হাতে দেয়নি অথবা হাসপাতালে তাকে ইনজেকশানের মাধ্যমে কী ওষুধ দেয়া হয়েছিল সে বিষয়েও কোন বিস্তারিত তথ্য তাকে দেয়নি। কাজেই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার পাঁচদিন পরেও তার গর্ভের ভ্রূণ সম্পর্কে স্বচ্ছ কোন তথ্য এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ফলে ভ্রূণের অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন ও সন্দেহ দানা বেঁধেছে।
তবে ওই নারীর গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে গিয়ে থাকতে পারে এমন খবরে ভারতে আবার ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে দোষারোপ করছে। ভারতে, ভিন্ন ধর্মের মধ্যে বিয়েকে দীর্ঘদিন ধরেই অনেক পরিবার ও সমাজে বাঁকা চোখে দেখার সংস্কৃতি রয়েছে। অনেক পরিবারকে দেখা যায় প্রায়শই এধরনের বিয়ে সমর্থন করেন না।
তবে কেউ ধর্মান্তরিত হতে চাইলে সে ব্যাপারে জেলা কর্তৃপক্ষের অনুমতি চাইতে হবে বলে নতুন আইন প্রণয়ন করায় ব্যক্তি বিশেষের প্রেম ভালবাসার ও জীবনসঙ্গী বেছে নেয়ার নাগরিক অধিকারে রাজ্যের হস্তক্ষেপ করার এখন প্রত্যক্ষ একটা ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। এ অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা দশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড। নতুন আইনে এই অপরাধ জামিনযোগ্য নয়। উত্তর প্রদেশের পর অন্তত আরও চারটি বিজেপি শাসিত রাজ্য কথিত ‘লাভ জিহাদের’ বিরুদ্ধে একই ধরনের আইন প্রণয়নের জন্য খসড়া তৈরি করছে।
সমালোচকরা এই আইনকে প্রতিক্রিয়াশীল এবং আক্রমণাত্মক বলে বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন এই আইন তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে বিয়ে বন্ধ করার একটা অস্ত্র হিসাবে- মূলত মুসলিম পুরুষ ও হিন্দু নারীদের মধ্যে বিয়েকে লক্ষ্য করে। এ আইন বাতিল করার জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয়েছে।
এই আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশও হয়েছে। ১ ডিসেম্বর ভারতের ব্যাঙ্গালোরে নারী আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ করেন। এ বিতর্কিত আইন ২৯ নভেম্বর পাস হবার পর অল্প সময়ের মধ্যে অন্তত ছয়টি ঘটনার ক্ষেত্রে এই আইন প্রয়োগ করা হয়েছে। মুসলিম ও হিন্দুদের মধ্যে বেশ কয়েকটি বিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, যেখানে বিয়েতে বর ও কনে দুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক ও বিয়েতে তাদের দুজনেই মত দিয়েছেন। এমনকি পরিবারেরও কোন অমত ছিল না এসব বিয়ের ক্ষেত্রেও। সবগুলো ঘটনায় মুসলিম পাত্রকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
যে ঘটনা নিয়ে এখন সামাজিকমাধ্যমে তোলপাড় চলছে, সেই ঘটনায় জড়িত ২২ বছরের হিন্দু নারী বলছেন তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন এবং তার মুসলিম স্বামীকে বিয়ে করেছেন জুলাই মাসে, প্রতিবেশি উত্তরাখন্ড রাজ্যের দেরাদুন শহরে। তারা যখন মোরাদাবাদে ফেরত আসেন, তখন তাদের ধরা হয় এবং তাদের বিবাহ নথিভুক্ত করার জন্য চাপ দেয়া হয়।
‘এ ধরনের একটা আইনের সমস্যা হল যে, এতে দুই ধর্মের মধ্যে প্রেম বা বিয়ে হলে সেটাকে অপরাধী কার্যকলাপের পর্যায়ে ফেলা হচ্ছে’, বলছেন ঐতিহাসিক চারু গুপ্তা। তিনি বলেন, ‘মেয়েদের নিজেদের ইচ্ছা বলে যে একটা জিনিস থাকতে পারে, এ আইন তাকে কোন সম্মান দেয় না। একজন নারী কাকে বিয়ে করবে সেই সিদ্ধান্ত নেবার বা সে পছন্দর অধিকার কি তার নেই? আর তার জন্য তাকে যদি আরেকটা ধর্ম গ্রহণ করতে হয়, সে চাইলে তাতে সমস্যা কোথায়?’
তিনি আরও বলেন, ‘এই আইনের পরিধি এতটাই বিস্তৃত করা হয়েছে এবং এর ক্ষমতা এতটা ব্যাপক করা হয়েছে যে, এর অধীনে কাউকে অভিযুক্ত করা হলে সে যে নির্দোষ সেটা প্রমাণ করার দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে। আর সেটা খুবই বিপদজনক।’