সত্যিটা হল- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কিছুই বানাচ্ছি না
- সাইফুল ইসলাম রিমেল
- প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:২৬ AM , আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:৪৪ AM
ইদানীং প্রায়ই একটা কথা শোনা যায় যে ‘আমরা আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে (পাবলিক/প্রাইভেট মিলিয়ে) ছাত্রছাত্রীদের মাঝে জ্ঞানের স্পৃহা না জাগিয়ে তাদের বিসিএস ক্যাডার বানাচ্ছি!” এটা একটা ভয়াবহ রকমের ভুয়া কথা/মিথ্যা অভিযোগ। যারা এসব কথা বলেন তারা হয় পুরো সমস্যাটার গভীরতা না বুঝতে পারার দরুন বলেন, না হয় সবাই বলে তাই তিনিও বলেন!
সত্যিটা হল আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোয় কিছুই বানাচ্ছি না। যারা বিসিএস ক্যাডার হচ্ছে তারা নিজেরেই তা হচ্ছে। যারা দেশের বাইরে স্কলারশিপ নিয়া যাচ্ছে নিজেদের চেষ্টায় যাচ্ছে, যারা প্রাইভেট ফার্মে কাজ করছে তারাও নিজেরাই সেইখানে জায়গা করে নিতেছে! এখানে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা নগণ্য, অনেকক্ষেত্রে নাই বললেই চলে।
প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা ভূমিকা অবশ্য আছে, সার্টিফিকেট দিতেছে প্রচুর! তবে বিসিএস এর প্রতি ছেলেমেয়েদের আগ্রহ বাড়ছে কেন সেটা একটু বলি। ড. সাদত স্যার এর আমল থেকে পিএসসি নিজের একটা স্বচ্ছ ভাবমূর্তি বানাতে পেরেছে। ছেলেমেয়েরা জানে জানপ্রাণ দিয়ে লেগে থাকলে, নিজের কিছুটা মেধা থাকলে কারও হেল্প ছাড়া, ফোন ছাড়া, তদবির ছাড়া বিসিএস দিয়ে ক্যাডার হওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রায় সকল শিক্ষক নিয়োগে এখন তদবির লাগে। ধরেন একটা ছেলে হার্ভার্ডের পিএইচডি, অক্সফোর্ডের ডিগ্রি নিল কিন্তু বাংলাদেশে তার কোন তদবির নাই, তারে দেশের কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চাকরি দেবে? আমার ধারনা দেবে না!
বিসিএস এ একটা বিরাট সংখ্যক ছাত্রছাত্রী আবেদন করে বলে এইটা নিয়ে হইচই হয় বেশি। প্রতিবছর দেশ থেকে শুধু আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নিতে যায় ৯ হাজারের উপর শিক্ষার্থী। এবং তাদের ৯৮ ভাগ আর দেশে ফিরে না। ফিরবে কিভাবে? সেই অপশনই তো নাই। ধরেন দেশে সে কোন চাকুরি রেখে যায় নাই, এখন একটা স্টুডেন্ট ইউরোপ আমেরিকা থেকে পিএইচডি করে এসে, গবেষণার উপর ট্রেইনিং নিয়ে এসে দেশে কি করবে? তার সামনে অপশন কই? বিসিএস দিলে তো দেশে থেকে সম্মানজনক একটা পেশায় সে থাকতে পারছে, প্রয়োজনে সরকারের কাছ থেকে ডেপুটেশন/শিক্ষাছুটি নিয়ে বাইরের ডিগ্রি নিয়ে আবার দেশে ফিরতে পারছে!
আরেকটা বিষয় না বললেই না। আমাদের কর্মক্ষেত্রে প্রতিবছর কি পরিমাণ গ্রাজুয়েট লাগবে আমরা জানি না। সারা দুনিয়ায় গ্রাজুয়েট ডিগ্রির সংখ্যায় আমরা চতুর্থ স্থানে। অথচ এই ডিগ্রিওয়ালা ৯০ ভাগের কোন স্কিল নাই, অথর্ব বলা চলে। উপজেলা লেভেলের একেকটা কলেজ থেকেও বছরে দুই তিনশ গ্রাজুয়েট হচ্ছে। অজপাড়াগাঁয়ে বিরান প্রান্তরে টাকাওয়ালা কেউ একটা কলেজ খুলেছিল, তদবিরের ঠেলায় সেখানেও অনার্স ডিগ্রি দিতেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। সাথে অগুনতি মাস্টার্স! এসব ডিগ্রিধারীর কাজ একটাই, বাপের কাছ থেকে টাকা নিয়া বাইক কিনা, বিড়ি খাওয়া আর মেয়েদের পিছনে ঘুরাঘুরি করা!
অথচ এই বিপুল জনশক্তিকে একটু ইংরেজিতে কথা বলা শিখিয়ে টেকনিক্যাল কাজে ট্রেনিং দিয়ে দুনিয়ার প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়া যেত। এরকম করতে পারলে বাংলাদেশের চেহারা চেঞ্জ হয়ে যাওয়ার কথা ১০ বছরে! পৃথিবীর কোথাও এত পরিমাণ অকাজের ডিগ্রি বিতরণ হয় বলে আমার জানা নাই!
বিসিএসে প্রতিবছর জেনারেল ক্যাডারে নিয়োগ হয় এভারেজে ৪০০/৫০০ জন। সেখানে প্রতিযোগিতা করে ৪ লক্ষ ছেলেমেয়ে। এটা কোন সুস্থ প্রতিযোগিতা না। এটার মানে হল আপনি তাদের সামনে বিকল্প দিতে পারছেন না। তারা নাচতে নাচতে মনের খুশিতে বিসিএস দিতে আসছে না। আসছে কারণ তাদের সামনে দেখার মত অন্য স্বপ্ন আপনি জাগাতে পারেন নাই। অন্য সব জায়গায় স্বচ্ছতার সহিত নিয়োগ দিতে পারছেন না। ছেলেমেয়েদের সম্মানজনক পেশার নিশ্চয়তা আপনি না দিয়েই তাদের অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রি দিয়েছেন। এটা নিয়ে ছেলেমেয়েদের সমালোচনা ট্রল যত ইচ্ছা করতে পারবেন লাভ কিছু হবে না। বরং দিনশেষে যারা ট্রল করবেন তারাও বিসিএসের লাইনে দাড়াবেন!
বাংলাদেশে কেউ কাউকে কিছু হতে সাহায্য করছে না। বরং এই বিশাল বিশৃঙ্খলার মাঝে খাবি খেতে খেতে ছেলেমেয়েরা নিজেরা নিজেদের আপ্রাণ চেষ্টায় যাই হয়ে উঠছে তাকে সম্মান করুন। আর সকলে মিলে একটা কম্প্রিহেন্সিভ প্ল্যান করে স্ট্রাকচার তৈরি করুন! সমাধান না দেখিয়ে অযথা সমালোচনায় লাভ কিছু হয় না!
লেখক: পিএইচডি গবেষক, সাউদাম্পটন ইউনিভর্সিটি।
(ফেসবুক থেকে নেয়া)