মাফিয়ার সঙ্গে জেলে পার্টি করেন ম্যারাডোনা, গুলি চালান সাংবাদিককে

দিয়েগো আর্মান্দো ম্যারাডোনা
দিয়েগো আর্মান্দো ম্যারাডোনা  © আনন্দবাজার

নিম্নবিত্ত পরিবারে দারিদ্র ছিল শৈশবের নিত্যসঙ্গী। ঘরে অর্থাভাব থাকলেও নামের পাশে বসে গিয়েছিল সোনার ছোঁয়া। ফুটবলে অসামান্য দক্ষতার সুবাদে দিয়েগো আর্মান্দো ম্যারাডোনা ফ্রাঙ্কোর নাম হয়ে গিয়েছিল ‘এল পিবে দে ওরো’। স্প্যানিশ ভাষায় যার অর্থ ‘সোনার বালক’। সোনার চেয়েও উজ্জ্বল প্রতিভা পাশে ছিল আজীবন। সময়ের সঙ্গে যোগ হয়েছিল বিতর্ক এবং বর্ণ।

জীবনের সেই ওঠাপড়ায় পাশে থাকা স্ত্রী ক্লদিয়ার সঙ্গে ২০ বছরের দাম্পত্য ভেঙে গিয়েছিল ২০০৪ সালে। বিবাহ বিচ্ছেদের সময় ম্যারাডোনা স্বীকার করেন ইতালির নাগরিক দিয়েগো সিনাগ্রার জন্মদাতাও তিনি! অথচ এই দিয়েগোর জন্ম ১৯৮৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। তখন ম্যারাডোনা-ক্লদিয়ার দাম্পত্যের বয়স দুই বছর। বড় মেয়ে ডালমার জন্ম হতে দেরি আছে আরও এক বছর। কিন্তু ইতালীয় দিয়েগোর পিতৃত্ব বরাবর অস্বীকার করে গিয়েছেন তিনি। রাজি হননি ডিএনএ পরীক্ষাতেও।

দীর্ঘ দিনের প্রেমিকা এবং পরবর্তীতে স্ত্রী ক্লদিয়ার সঙ্গে বিয়ে ভাঙার সময় ম্যারাডোনা স্বীকার করেন ইতালির ক্লাবে খেলার সময় স্থানীয় তরুণী ক্রিস্টিনা সিনাগ্রার সঙ্গে সম্পর্কের ফসল দিয়েগো সিনাগ্রা। বাবার নাম এবং মায়ের পদবি নিয়ে বড় হওয়া এই তরুণ নিজেও এক জন ফুটবলার। জন্মের ১৯ বছর পরে দিয়েগো সিনাগ্রা তাঁর বাবাকে প্রথম চাক্ষুষ দেখেছিলেন গল্ফের মাঠে।

এই বিতর্ক ছাড়াও আর কী কী অনুঘটক হয়েছিল কৈশোরের প্রেমিকা ক্লদিয়ার সঙ্গে দাম্পত্য ভাঙার সময়? সে সব প্রশ্ন প্রকাশ্যে এনে সম্পর্ককে ছিন্ন করার সিলমোহর দেননি ম্যারাডোনা বা ক্লদিয়া, কেউই। ক্লদিয়া বলেছিলেন, বিচ্ছেদই তাঁদের সমস্যার শ্রেষ্ঠ সমাধান। কিন্তু তার পরেও ম্যারাডোনা-ক্লদিয়ার সুসম্পর্ক ব্যাহত হয়নি।

বিচ্ছেদের পরেও প্রাক্তন স্ত্রী ক্লদিয়া, দুই মেয়ে ডালমা এবং জিয়ানিন্নাকে প্রায়ই দেখা গিয়েছে ম্যারাডোনার সঙ্গে। ২০০৯ সালে জিয়ান্নিনার সন্তানই তাঁকে দাদু হওয়ার আনন্দ উপহার দেয়। শুধু বিয়ের বাইরে সম্পর্কই নয়। আশির দশকে ইটালিতে থাকাকালীন আরও এক বিতর্ক তাঁর সঙ্গী হয়। শোনা যায়, সে সময়েই তিনি মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। তবে মাদক সেবন নাকি তিনি শুরু করেছিলেন স্পেনে, বার্সেলোনা ক্লাবের হয়ে খেলার সময়। মাদকাসক্তির প্রভাব এড়িয়ে যেতে পারেনি তাঁর ক্যারিয়ার। ১৯৯১ সালে মাদক সেবনের দায়ে তাঁকে ১৫ মাসের জন্য নির্বাসিত করে নাপোলি। ১৯৯৪ সালে আমেরিকায় ফুটবল বিশ্বকাপের অন্যতম অধ্যায় হয়ে দাঁড়ায় নিষিদ্ধ মাদক সেবনের জন্য ফুটবলের রাজপুত্রের দেশে ফিরে যাওয়া।

তবে ম্যারাডোনার ১৯৮৬ বিশ্বকাপ অভিযানের কাছে বাকি সব কিছু মলিন। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে কোয়ার্টার ফাইনালে তাঁর ‘ঈশ্বরের হাত’ দিয়ে করা গোল ছাড়া বিশ্বকাপের ইতিহাস অসম্পূর্ণ। চির বিতর্কিত সেই গোলের ঠিক চার মিনিটের মাথায় এসেছিল আজীবন বন্দিত আর এক পায়ের জাদু। ব্রিটিশ ডিফেন্ডারদের কাটিয়ে গোলরক্ষক পিটার শিলটনকে হতভম্ব করে সেই গোল। ফুটবলপ্রেমীরা চোখ বন্ধ করে এখনও দেখতে পান বলটা গোলের জাল জড়িয়ে পড়ে আছে।

১৯৮৬ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনায় পৌঁছেছিল ম্যারাডোনার পায়ের জাদুতে। ফাইনালে ৩-২ গোলে চূর্ণ হয়েছিল পশ্চিম জার্মানি। তার শোধ পরের ইতালি বিশ্বকাপে উশুল করেছিল জার্মানরা। ফাইনালে ১-০ গোলে তাদের কাছে পরাজিত হয়েছিল ম্যারাডোনার দল। ১৯৯৪ সালে বিশ্বকাপ থেকে নাটকীয় এবং লজ্জাজনক বিদায়ের পর ম্যারাডোনা আবার ফিরেছিলেন এই প্রতিযোগিতায়। ২০১০ সালে তিনি কোচ ছিলেন আর্জেন্টিনার। আরও এক বার তাঁর জাদু দেখার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন সারা পৃথিবীর ভক্তরা। কিন্তু এ বারও অপ্রাপ্তিই সঙ্গী হয় তাঁর।

দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে ৪-০ গোলে চূর্ণ করে জার্মানি। এর পরে তিনি বিশ্বকাপে হাজির থেকেছেন আর্জেন্টিনার সমর্থক হয়ে। কিন্তু ৮৬-র জাদু আর ফিরে আসেনি। বিশ্বকাপের ট্রফি ওঠেনি বুয়েনাস আইরেসগামী বিমানে। অতিরিক্ত মাদক ও সুরার নেশার পাশাপাশি অন্যান্য শারীরিক সমস্যাতেও জেরবার হয়েছেন তিনি। ২০০০ সালের পর থেকেই অস্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধির জন্য তিনি অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকেন। ২০০৪ সালে এক বার হৃদরোগেও আক্রান্ত হন।

সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে কলম্বিয়ায় গ্যাস্ট্রিক বাইপাস সার্জারিও করান তিনি। এরপর তাঁর খাওয়া-দাওয়ার উপর চরম নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। কিন্তু সমস্যা রয়েই গিয়েছিল। ২০০৭ সালে বুয়েনাস আইরেসের হাসপাতালে চিকিৎসা হয় হেপাটাইটিস আক্রান্ত ম্যারাডোনার। এর পর থেকে তাঁর শরীর ও স্বাস্থ্য নিয়ে ক্রমেই গুজব ছড়াতে থাকে। রটে গিয়েছিল তাঁর মৃত্যুর গুজবও। সে বছরই আর্জেন্টিনার এক টেলিভিশন চ্যানেলে এসেছিলেন তিনি। জানান, তিনি মদ্যপান ছেড়ে দিয়েছেন। গত আড়াই বছর স্পর্শ করেননি মাদক।

কিন্তু জীবনযাত্রায় কিছুটা নিয়ন্ত্রণ সত্ত্বেও অসুস্থতা তাঁকে ছেড়ে যায়নি। ছেড়ে যায়নি বিতর্কও। দর্শক হিসেবে থেকেও বিশ্বকাপে তিনিই ছিলেন বিতর্কের কেন্দ্রে। ২০১৮ সালে রাশিয়ায় ফুটবল বিশ্বকাপে নাইজেরিয়ার বিরুদ্ধে ২-১ গোলে আর্জেন্টিনার নাটকীয় জয়ে তাঁর অশালীন আচরণ অথবা আইসল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচে সঞ্চালকের প্রতি বর্ণবিদ্বেষমূলক মন্তব্য— সব সময়ই ম্যারাডোনা ছিলেন শিরোনামে।

প্রকাশ্যে মেজাজও হারিয়েছেন বার বার। ১৯৯৪ সালে বুয়েনাস আইরেসে নিজের বাড়ির সামনে সাংবাদিকদের উপর গুলি চালিয়েছিলেন তিনি। তাঁর এয়ার রাইফেলের গুলিতে আহত হন চার জন। ঘটনার জন্য দুই বছর ১০ মাসের কারাদণ্ড নির্ধারিত হয়েছিল তাঁর জন্য। ম্যারাডোনার অভিযোগ ছিল, সাংবাদিকরা তাঁর ব্যক্তিগত পরিসর বিঘ্নিত করছেন।

তাঁর বদমেজাজ এবং কটূক্তির শিকার হয়েছেন সাধারণ ভক্ত থেকে লিওনেল মেসিও। একবার খেলায় অসুবিধে হওয়ার জন্য তিনি আঘাত করেছিলেন সমর্থকের হাতে। তাঁর অভিযোগ ছিল, ওই সমর্থক তাঁর পোস্টার তুলে ধরায় খেলার সময় সমস্যা হচ্ছিল। পেলের সঙ্গে কথোপকথনে ম্যারাডোনা বলেছিলেন মেসি প্রতিভাবান ফুটবলার হতে পারেন। কিন্তু তাঁর কোনও ব্যক্তিত্ব নেই। নেতৃত্ব দেওয়ারও ক্ষমতা নেই তাঁর।

বর্ণময় কেরিয়ারে মুখোমুখি হয়েছেন আর্থিক সমস্যারও। ইতালি সরকারের অভিযোগ, সে দেশে বহু অঙ্কের কর ম্যারাডোনা ফাঁকি দিয়েছেন। শারীরিক বা আর্থিক কোনও সমস্যাই ম্যারাডোনাকে বিতর্ক থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেনি। কলম্বিয়ার কুখ্যাত মাদক মাফিয়া পাবলো এসকোবারের সঙ্গে তিনি পার্টি করেছিলেন জেলের ভিতরেই। হাজির ছিলেন বহু সঙ্গিনীও। ম্যারাডোনার অবশ্য দাবি ছিল, ফুটবলপ্রেমী এসকোবারের অন্য পরিচয় তিনি জানতেন না।

বর্ণময় জীবন গত দুই বছর ঘন ঘন বিধ্বস্ত হয়েছিল শারীরিক সমস্যায়। ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁর হার্নিয়া অস্ত্রোপচার হয়। ছিল লিভারে রক্তক্ষরণের সমস্যাও। চলতি বছরের নভেম্বরে তাঁর মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করা হয়। সুস্থ হয়ে ফিরেছিলেন বাড়িতেও। কিন্তু আর ফিরতে পারলেন না চেনা জীবনের পুরনো ছন্দে।

বাড়িতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন ম্যারাডোনা। তবে ফুটবলপ্রেমীদের কাছে তিনি হারিয়েছেন শুধু চোখে। আর্জেন্টিনার জাতীয় টুপি মাথায় দেওয়া ১৬ বছরের কিশোর এখনও রাজপুত্র হয়ে খেলে চলেছেন। তাঁকে ঘিরেই বেঁচে থাকে ফুটবলপাগল বাঙালির রূপকথার নটেগাছ। খবর: আনন্দবাজার।


সর্বশেষ সংবাদ