যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাসে আলোচিত ৮ ঘটনা

আজ মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন
আজ মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন  © বিবিসি

বহুল আলোচিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে আজ মঙ্গলবার (৩ নভেম্বর)। নির্বাচনে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং সাবেক ভাইস-প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ব্যবস্থা অন্য দেশের চেয়ে আলাদা। তবে সবসময়েই এই নির্বাচন সরলভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি। প্রায় আড়াইশো বছরের মার্কিন গণতন্ত্রের ইতিহাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে ঘটেছে বেশ কয়েকটি চমকপ্রদ এবং নাটকীয় ঘটনা তুলে ধরেছে বিবিসি।

দুই বছর ধরে ভোটগ্রহণ নির্বাচন:  যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন। দেশটির ন্যাশনাল আর্কাইভস তথ্য অনুযায়ী, সদ্য তৈরি করা সংবিধান অনুযায়ী ১৭৮৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ১৭৮৯ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত, ২৫ দিন ধরে ওই নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই একবারই দুই ক্যালেন্ডার বছরজুড়ে নির্বাচন হয়েছিল। তখনকার ইলেকটোরাল কলেজে মোট ভোট ছিল ৬৯টি, এখন যা ৫৩৮টি।

তখনকার নিয়ম অনুযায়ী, কংগ্রেসে প্রতিনিধিত্ব অনুসারে প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে ইলেকটোরাল কলেজ প্রতিনিধি নির্বাচিত হতেন। প্রত্যেক ইলেকটর আলাদা দুইজন প্রার্থীকে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য একটি করে ভোট দিতেন। যিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পাবেন, তিনি প্রেসিডেন্ট। এরপরে দ্বিতীয় সর্ব্বোচ্চ ভোট প্রাপ্ত ব্যক্তি হবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট।

তখন একেকটি অঙ্গরাজ্যে একেকভাবে ইলেকটর নির্বাচন করা হতো। যেমন পাঁচটি রাজ্যে আইন প্রণেতারা তাদের নির্বাচিত করতেন, বাকি ছয়টি রাজ্যে খানিকটা বেশি ভোটের ভিত্তিতে তাদের নির্বাচন করা হতো। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতা হিসাবে জর্জ ওয়াশিংটন সবগুলো ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। জন অ্যাডামস ৩৪টি ভোট পেয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

সমান ভোট:  ১৮০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, প্রথমবারের মতো দলগতভাবে সেখানে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া হয়। রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ছিলেন তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন এবং অ্যারন বার। আর ফেডারেলিস্টদের প্রার্থী ছিলেন সেই সময়ের প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামস আর চার্লস সি পিঙ্কনি। রিপাবলিকানরা চাইছিলেন, তাদের দুই প্রার্থীর মধ্যে জেফারসন কিছু ভোট বেশি পাবেন আর অ্যারন বার একটি হলেও কম। তাহলে একজন প্রেসিডেন্ট, আরেকজন ভাইস প্রেসিডেন্ট হবেন।

কিন্তু ঘটনাক্রমে দুইজনের ভোট সমান, ৭৩ ভোট হয়ে যায়। কারণ তখনো নির্বাচকরা দুটি করে ভোট দেয়ার সুযোগ পেতেন। ফলে কে প্রেসিডেন্ট হবেন, সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার গিয়ে পড়ে হাউজ অব রিপ্রেজেন্টিটিভের ওপর। যেখানে সেই সময়ের ১৬টি অঙ্গরাজ্যের একটি করে ভোট। বিজয়ী হতে হলে একজনকে অন্তত নয়টি রাজ্যের ভোট পেতে হবে। কিন্তু জেফারসন আটটি অঙ্গরাজ্যের ভোট পান। কারণ তার বিরোধী ফেডারেলিস্ট প্রতিনিধিরা অ্যারন বারকে সমর্থন করেছিল। সাতদিন ধরে ৩৫ দফা ভোটাভুটিতেও কোন সমাধান আসেনি।

শেষ পর্যন্ত অ্যালেকজান্ডার হ্যামিলটন কয়েকজন ফেডারেলিস্ট প্রতিনিধিকে জেফারসনকে সমর্থন করাতে রাজি করাতে সক্ষম হন। টমাস জেফারসন প্রেসিডেন্ট হন আর ভাইস-প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পান অ্যারন বার। সেই নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে দ্বাদশ সংশোধনী আনা হয়, প্রত্যেক ইলেকটরকে আলাদাভাবে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস-প্রেসিডেন্টের জন্য ভোট দিতে হবে।

হাউজ অব রেপ্রেজেন্টেটিভের মাধ্যমে প্রথম নির্বাচন: আরও দুইবার হাউজ অব রেপ্রেজেন্টেটিভের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে হয়েছে। ১৯২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিকান পার্টির পক্ষে চারজন প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করেছিলেন। তাদের মধ্যে অ্যান্ড্রু জ্যাকসন সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিলেন (পপুলার ভোট)। অন্য প্রার্থীদের চেয়ে ইলেকটোরাল কলেজেও তিনি বেশি ভোট পেয়েছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে হলে ইলেকটোরাল কলেজের যতগুলো ভোট দরকার, তা তিনি পাননি।

ফলে সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দায়িত্ব বর্তায় হাউজ অব রেপ্রেজেন্টেটিভের ওপর, যাকে বলে ‘কনটিনজেন্ট ইলেকশন’। কংগ্রেসম্যানরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবেন আর সিনেটররা নির্বাচন করবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। এক্ষেত্রে হাউজ অব রেপ্রেজেন্টেটিভ সদস্যরা তাদের মোট প্রতিনিধির হিসাবে নয়, একেকটি অঙ্গরাজ্যের হিসাবে একটি করে ভোট দেবেন। সেই ভোটাভুটিতে নির্বাচিত হন জন কুইন্সি অ্যাডামস। কারণ নির্বাচনে চতুর্থ হওয়া (হাউজ স্পিকার) হেনরি ক্লের সমর্থকরা অ্যাডামসকে ভোট দেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে একমাত্র সেবারই সাধারণ ভোট ও ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে সংখ্যাধিক্য থাকার পরেও পরাজিত হয়েছিলেন কোন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। এরপর অবশ্য ১৮৩৬ সালে ভাইস-প্রেসিডেন্ট নির্ধারিত হয়েছিল সিনেটের ভোটে।

নির্বাচনের পরে গৃহযুদ্ধ: ১৯৬০ সালের নির্বাচনের সময় রিপাবলিকানরা দাসপ্রথা অবসানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। তবে দক্ষিণের রাজ্যগুলো ছিল দাসপ্রথার পক্ষে। রিপাবলিকানরা প্রেসিডেন্ট পদে আব্রাহাম লিঙ্কনকে মনোনয়ন দেয়। তবে ডেমোক্র্যাটরা স্টিফেন এ ডগলাসকে মনোনয়ন দেন। দক্ষিণের ডেমোক্র্যাটরা আলাদাভাবে মিলিত হয়ে ব্রেকিংরিজকে তাদের প্রার্থী হিসাবে মনোনীত করে। কন্সটিটিউশনাল ইউনিয়ন পার্টি নামের আরেকটি নতুন দল জন বেলকে তাদের প্রার্থী মনোনয়ন দেয়।

উত্তরের সব রাজ্যে ভোট পেয়ে লিঙ্কন নির্বাচিত হন। দক্ষিণের সবগুলো রাজ্যের ভোট পান ব্রেকিংরিজ। নির্বাচনের ফলাফলের ভেতর দিয়ে যেন উত্তর আর দক্ষিণের রাজ্যগুলোর মতভেদ আরও প্রকট হয়ে ওঠে। এর পরের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সাউথ ক্যারোলিনা ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাবার পক্ষে ভোট দেয়, আরও ছয়টি রাজ্য তাদের অনুসরণ করে। ১৯৬১ সালের ফেব্রুয়ারিতে এসব রাজ্য মিলে জেফারসন ডেভিসকে তাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেন। পরে আরও চারটি রাজ্য তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। শুরু হয় আমেরিকার গৃহযুদ্ধ।

কমিশন করে প্রেসিডেন্ট নির্ধারণ: ১৯৭৬ সালের নির্বাচনকে বলা হয় আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত নির্বাচন। রিপাবলিকান পার্টি প্রেসিডেন্ট পদে মনোনীত করেছিল রাদারফোর্ড বি হেইসকে আর ডেমোক্র্যাটরা মনোনীত করেছিল স্যামুয়েল জে টিলডেনকে। নির্বাচনে টিলডেন হেইসের চেয়ে দুই লাখের বেশি ভোট পান। ইলেকটোরাল কলেজের ভোটও তিনি পেয়েছিলেন ১৮৪টি, আর হেইস পান ১৬৫টি। নির্বাচিত হওয়ার জন্য টিলডেনের দরকার ছিল এক ভোট আর হেইসের দরকার ছিল ২০টি ভোট। বাকি যে ২০টি ভোট ছিল, উভয় দলই দাবি করেছিল যে, সেগুলো তারা পেয়েছে।

কিন্তু এই ভোট কাদের ঘরে যাবে? সংকট সমাধানের জন্য একটি আইন পাস করে ১৫ সদস্যের নির্বাচনী কমিশন গঠন করা হয়, যার মধ্যে কংগ্রেসের উভয় কক্ষের পাঁচজন করে প্রতিনিধির সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচজন সদস্য থাকবেন। তবে সেখানেও দেখা যায়, কংগ্রেসের সদস্য আর বিচারপতি মিলিয়ে রিপাবলিকান হয়ে গেছেন আটজন আর ডেমোক্র্যাট সাতজন। শেষ পর্যন্ত কমিশনের ৮-৭ ভোটের ব্যবধানে ২০টি ইলেকটোরাল ভোট হেইসকে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ফলে ১৮৫-১৮৪ ভোটের ব্যবধানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন রাদারফোর্ড বি হেইস।

সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সিদ্ধান্ত: ২০০০ সালে জর্জ ডব্লিউ বুশ এবং আল গোরের মধ্যে ভোটাভুটি হওয়ার পর ডেমোক্র্যাট আল গোর পেয়েছিলেন ২৬৭ ইলেকটোরাল ভোট আর রিপাবলিকান বুশ পেয়েছিলেন ২৪৬ ভোট। শুধুমাত্র ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের ২৫টি ভোট বাকি ছিল। সেখানে দুই প্রার্থীর মধ্যে ভোটের ব্যবধান এতো কম ছিল, যে সপ্তাহের পর সপ্তাহ জুড়ে ভোট গণনা চলছিল। সেই সময় ফ্লোরিডার গভর্নর ছিলেন জর্জ বুশের ভাই জেব বুশ।

২৬ নভেম্বর তিনি ঘোষণা দেন, ফ্লোরিডার ইলেকটোরাল ভোট জর্জ বুশের পক্ষে যাচ্ছে। পুনরায় গণনার দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে মামলা হয়। তবে সুপ্রিম কোর্ট ৫-৪ বিচারপতির মতামতের ভিত্তিতে ভোট পুনঃগণনা বন্ধের আদেশ দিয়ে বুশকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত করার রায় দেন।

বেশি ভোট পেয়েও পরাজয়: বেশি ভোট পাওয়ার পরেও কোন প্রার্থীর পরাজয়ের ঘটনা সেটাই শেষ ছিল না। ১৮৭৬ সালে, ১৮৮৮ সালে, ২০০০ এবং ২০১৬ সালে যে প্রার্থী জনগণের ভোট বেশি পেয়েছিলেন (পপুলার ভোট), ইলেকটোরাল কলেজের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পাওয়ার কারণে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেননি। অনেকবার ইলেকটোরাল কলেজের ভোটিং পদ্ধতির বাইরে জনভোটের বিচারে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রস্তাব আনা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেসে, কিন্তু কোনবারই তা পাশ হয়নি।

নভেম্বরের মঙ্গলবার: আগে নানা দিনে ও অনেক সময় ধরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও ১৮৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে একটি বিল পাস করা হয়, যেখানে নির্ধারণ করে দেয়া হয়, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে নভেম্বর মাসের প্রথম মঙ্গলবার। এর আগে ডিসেম্বর মাসের প্রথম বুধবারের আগের ৩৪ দিনের যেকোনো সময় রাজ্যগুলো ভোটাভুটি করতে পারতো। কিন্তু আগাম ফলাফল জেনে যাওয়ার কারণে, যেসব রাজ্যে পরে নির্বাচন হতো, সেখানে প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা দেখা দিতো।

এ কারণে নতুন আইনটি পাস করা হয়। কিন্তু নভেম্বর মাসের মঙ্গলবারেই কেন? ইতিহাসবিদ ইভান অ্যান্ড্রুসের তথ্য অনুযায়ী, সেই সময়ে বেশিরভাগ আমেরিকান কৃষিকাজ করতো এবং নির্বাচন কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে বসবাস করতো। রবিবার সবাই গির্জায় সময় কাটাতো আর বুধবার ছিল কৃষকদের বাজারের দিন। এ কারণে মঙ্গলবার দিন নির্ধারণ করা হয় যাতে কৃষকরা রবিবারের প্রার্থনার পর সোমবার ভোটের জন্য রওনা দিতে পারেন। আবার মঙ্গলবার ভোট দিয়ে তারা হাট করে ফিরতে পারেন।

আর নভেম্বর মাস? বসন্ত এবং গ্রীষ্মের সময়টায় ফসল বোনা হয়। সেই সময়ে নির্বাচন হলে চাষাবাদে সমস্যা তৈরি করে। আবার হেমন্তে ফসল তোলার সময়। নভেম্বর মাস নাগাদ কৃষকদের ফসল তোলা শেষ হয়ে যায়। আবার কঠিন, প্রচণ্ড শীত নামার আগে এটাই সবচেয়ে সুবিধাজনক সময়। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই আইন প্রণেতারা নভেম্বর মাসের প্রথম মঙ্গলবার নির্বাচনের তারিখ ঠিক করে দিয়েছিলেন।


সর্বশেষ সংবাদ