মহাসাগরের নিচে ‘অতিদানব তেলাপোকার’ সন্ধান
অনেকেই বলছেন বিজ্ঞানীদের জন্য এ বছরটা বেশ অভিনব। বছরের শুরুতে তাদের সামনে ধরা দিয়েছে চোখে দেখা যায় না এমন এক প্রাণঘাতী ভয়াবহ জীবাণু যা সারা পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এরপর বিশ্বের অনেক দেশে হানা দিয়েছে পঙ্গপালের ঝাঁক।
এখন ইন্দোনেশিয়ার বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করেছেন, তারা গভীর সমুদ্রে খুঁজে পেয়েছেন খোলসযুক্ত জলজ প্রাণী প্রজাতির অতিকায় এক জীব, যেটিকে তারা দানবাকৃতির সামুদ্রিক তেলাপোকা বলে বর্ণনা করেছেন। তারা বলছেন, এটি ক্রাসটেশিয়ান শ্রেণিভুক্ত জীবিত অতিকায় প্রাণীগুলোর অন্যতম।
তাদের তথ্যানুযায়ী, নতুন এই জীবটি ব্যাথিনোমাস বর্গের অন্তর্ভূক্ত। ব্যাথিনোমাস হল বিশাল আকৃতির আইসোপড প্রজাতির প্রাণী, যাদের সাত জোড়া পা থাকে। প্রকাণ্ড চেহারার এই জীবের দেহ হয় চ্যাপ্টা, তাদের দেহের উপরের অংশ শক্ত আবরণে ঢাকা থাকে এবং এরা জলজ প্রাণী- থাকে গভীর পানিতে।
এই প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নাম দেয়া হয়েছে ব্যাথিনোমাস রাকসাসা (ইন্দোনেশীয় ভাষায় রাকসাসা মানে রাক্ষস বা ‘দানব’)। এটি পাওয়া গেছে জাভা এবং সুমাত্রা দ্বীপের মাঝে সুন্দা প্রণালীতে এবং কাছে ভারত মহাসাগরে- সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৯৫৭ থেকে এক হাজার ২৫৯ মিটার গভীরে।
প্রাপ্তবয়স্ক এই জীবটি আয়তনে ৩৩ সেন্টিমিটার লম্বা এবং আকৃতির দিক দিয়ে এটিকে ‘অতিদানব’ বলে গণ্য করা হচ্ছে। ব্যাথিনোমাস শ্রেণিভূক্ত অন্য প্রজাতির প্রাণী মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত লম্বায় ৫০ সেন্টিমিটার পর্যন্তও হতে পারে। ব্যাথিনোমাস রাকসাসা প্রজাতির জীব মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত ৩৩ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের হয়।
‘এই নতুন পাওয়া প্রাণীটি আসলেই অতিকায় এবং ব্যাথিনোমাস প্রজাতির মধ্যে দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ জীব,’ বলেন ইন্দোনেশিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সেসের (এলআইপিআই) শীর্ষ গবেষক কনি মার্গারেথা সিদাবালক। পৃথিবীতে অতিদানব আইসোপড প্রজাতির সাতটি প্রাণীর কথা জানা যায়।
এই প্রথম ইন্দোনেশিয়ার গভীর সমুদ্রে অতিদানবাকৃতির সাত জোড়া পা বিশিষ্ট এই প্রজাতির প্রাণী পাওয়া গেল। বিজ্ঞানীদের দলটি এক বিজ্ঞান সাময়িকীতে লিখেছেন, ওই এলাকায় এ ধরনের প্রাণী নিয়ে গবেষণা হয়েছে খুবই কম।
এলআইপিআই সংস্থার জীববিজ্ঞান বিভাগের অস্থায়ী প্রধান ক্যাথিও রাহামাদি বলছেন, ‘এই অবিষ্কার এটাই প্রমাণ করে যে, ইন্দোনেশিয়ায় জীববৈচিত্রের ব্যাপকতার খোঁজ মানুষ এখনও পায়নি। বিশাল সম্ভাবনাময় এই জগতটা সম্পর্কে আমাদের ধারণাই নেই।’
লন্ডনে ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম (প্রাকৃতিক ইতিহাস যাদুঘর) বলছে, গভীর সমুদ্রের আইসোপড কেন এত বিশালাকৃতির হয় সে সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে। একটা তত্ত্ব হল সমুদ্রের অত গভীরে বেঁচে থাকতে হলে প্রাণীকে প্রচুর অক্সিজেন শরীরে সঞ্চিত রাখতে হয়। ফলে তাদের দেহ বিশাল আকারের হতে হয় এবং তাদের লম্বা পা থাকার প্রয়োজন হয়।
আরেকটি বিষয় হল, গভীর সমুদ্রে তাদের কোনরকম শিকারীর হাতে পড়ার ভয় থাকে না, কাজেই তারা নির্ভয়ে বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়। এছাড়া, খোলসযুক্ত অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে ব্যাথিনোমাস প্রজাতির প্রাণীর শরীরে মাংসের পরিমাণ থাকে খুবই কম, যেমন কাঁকড়া। এ কারণে তাদের ধরে খাবার শখ অন্য প্রাণীদের তেমন থাকে না।
ব্যাথিনোমাস প্রজাতির প্রাণীর লম্বা শুঁড় থাকে এবং থাকে প্রকাণ্ড বড় চোখ। এ কারণে অন্ধকারের মধ্যেও তারা নিজেদের আবাস এলাকায় স্বচ্ছন্দে এবং নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারে। তাদের চেহারা অতিদানবীয় বা ভয়াবহ হলেও তারা কিন্তু আচরণে আসলে ততটা ভয়ঙ্কর নয়।
তারা আসলে ঘুরে বেড়ায় গভীর সমুদ্রে, মহাসাগরের তলদেশ থেকে কুড়িয়ে খায়, মরা জীবজন্তুর দেহাবশেষ থেকে তারা খাদ্য সংগ্রহ করে। লন্ডনের ইতিহাস বিষয়ক যাদুঘর বলছে, তাদের পরিপাক যন্ত্র খুবই শ্লথ। তারা যা খায় তা হজম করতে তাদের অনেক দীর্ঘ সময় লাগে। জাপানে দেখা গেছে, খাঁচায় রাখা এই অতিকায় দানব আইসোপড প্রাণী না খেয়ে পাঁচ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।
এই যৌথ গবেষণায় অংশ নিচ্ছে ইন্দোনেশিয়ার এলআইপিআই, সিঙ্গাপুরের ন্যাশানাল ইউনিভার্সিটি এবং লি কং চিয়ান ন্যাচারাল হিস্ট্রি যাদুঘর। এই গবেষক দল ২০১৮ সালে দুই সপ্তাহ ধরে চালানো এক অভিযানে ৬৩টি বিভিন্ন গবেষণার স্থল আবিষ্কার করে এবং সেসব জায়গা থেকে কয়েক হাজার প্রাণী নমুনা হিসাবে সংগ্রহ করে। এর মধ্যে এক ডজনের মত নতুন প্রাণী তারা খুঁজে পান।
গবেষক দলটি জানায়, তারা ব্যাথিনোমাস প্রজাতির দুটি নমুনা পান: একটি পুরুষ যার দৈর্ঘ্য ৩৬.৩ সেন্টিমিটার এবং একটি নারী যেটি লম্বায় ২৯.৮ সেন্টিমিটার। সুন্দা প্রণালী এবং দক্ষিণ জাভার সমুদ্র থেকে ব্যাথিনোমাসের আরও চারটি নমুনা তারা সংগ্রহ করেছেন।
কিন্তু সিদাবালক বলেছেন, অন্য চারটিকে এই একই প্রজাতির মধ্যে ফেলা যাচ্ছে না। কারণ এই প্রজাতির মধ্যে যে বিশেষত্বগুলো থাকা দরকার সেগুলো এখনও তাদের দেহে সেভাবে গড়ে ওঠেনি। খবর: বিবিসি বাংলা।