বয়কটের ডাক দেওয়ার পর ভারতে বিক্রি বেড়েছে চীনা স্মার্টফোনের!

  © বিবিসি

ভারত ও চীনের সীমান্ত সংঘাতের পটভূমিতে ভারতে চীনা পণ্য বয়কট করার জন্য জোরালো দাবি উঠলেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। ভারতীয় ক্রেতারা বিশেষ করে চীনা মোবাইল ফোন ও ইলেকট্রনিক পণ্য কেনায় বিন্দুমাত্র রাশ টানছেন না। গত এক সপ্তাহের মধ্যে ভারতের বিভিন্ন ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে চীনা মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো যে সব প্রোডাক্ট লঞ্চ করেছে, তা শেষ হয়ে গেছে নিমেষের মধ্যে।

সাধারণ গ্রাহকরা বলছেন, চীনা কোম্পানিগুলি শস্তায় ভাল মানের পণ্য দিতে পারে বলেই সেগুলোর এত কদর। ভারতীয়দের যে চীনা মোবাইল ফোন ও সব ধরনের চীনা অ্যাপ অবিলম্বে বয়কট করা উচিত, মাসখানেক আগে প্রথম সে ডাক দিয়েছিলেন লাদাখের জনপ্রিয় শিক্ষা সংস্কারক সোনাম ওয়াংচুক, যার আদলে তৈরি হয়েছিল বলিউডের থ্রি ইডিয়টস ছবির বিখ্যাত ‘র‍্যাঞ্চো’ চরিত্রটি।

ওয়াংচুকের যুক্তি ছিল, ‘চীনা পণ্য বর্জন করলে শুধু চীনের আগ্রাসী নীতিরই প্রতিবাদ জানানো হবে তাই নয় – ভারতের দেশজ শিল্পও স্বনির্ভর হবে, উপকৃত হবে।’

গালওয়ান উপত্যকায়  ২০ জন ভারতীয় সেনা চীনা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হওয়ার পর সে দাবি আরও জোরালো হয়েছে। কিন্তু অ্যামাজন বা ফ্লিপকার্টের সেলে চীনা ফোনের দেদার বিক্রি কিন্তু অন্য কথাই বলছে। বলিউড তারকা অমিতাভ বচ্চন যে ই-কমার্স সাইটের সেলের বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন, সেখানে এখন হুড়মুড়িয়ে বিক্রি হচ্ছে রেডমি, অপ্পো, ভিভো, ওয়ানপ্লাসের মতো চীনা কোম্পানির ফোন।

গত সপ্তাহেই অ্যামাজনে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে উড়ে গেছে ওয়ানপ্লাসের লেটেস্ট মডেল। তাহলে কি ভারতীয় ক্রেতারা চীনা পণ্য বয়কটের ডাকে মোটেই সাড়া দিচ্ছেন না? দিল্লির তরুণ বোধিসত্ত্ব দাশগুপ্ত মনে করেন, চীনা স্মার্টফোনের যে বিকল্পগুলো রয়েছে, সেগুলোর দাম তুলনায় বেশি বলেই ক্রেতারা চীনা ফোনের দিকে ঝুঁকছেন।

তার কথায়, ‘দেখুন, আমার ফোন কেনার বাজেট যদি হয় ১০ হাজার টাকা তাহলে সেই পয়সায় রেডমি, রিয়েলমি বা এমন কী পোকো যে স্পেসিফিকেশনস দিচ্ছে, কোরিয়ার স্যামসাং চল্লিশ হাজার টাকার নিচে তা দিতে পারছে না। অ্যাপল তো আরও বেশি।’

‘একইভাবে আমার কাছে যদি ৫০ হাজার টাকা থাকে, তাহলে চীনের ওয়ান প্লাস এইট কিংবা ওয়ান প্লাস এইট প্রো আমায় যত সুবিধা দিচ্ছে ওই পয়সায় আইফোনও তা দিতে পারছে না। আর স্যামসাং দিতে গেলে দাম পৌঁছে যাচ্ছে এক লাখ ৩৫ হাজার টাকায়! কাজেই ভারতীয়দের হয়তো এখন চীনা ফোন বর্জন করা উচিত ঠিকই, কিন্তু সমস্যাটা হয়ে যাচ্ছে ‘ভ্যালু ফর মানি’-র দিকে দিয়ে চীনের প্রোডাক্ট আসলে অনেক এগিয়ে’, বলছিলেন বোধিসত্ত্ব দাশগুপ্ত।

ভারতের নামী থিঙ্কট্যাঙ্ক ইকরিয়েরের অর্থনীতিবিদ অর্পিতা মুখার্জি আবার এ প্রসঙ্গে দিকনির্দেশ করছেন ক্রেতাদের একটা বিশেষ স্বভাবের দিকে। তিনি বলেন, ‘কনজিউমার বা ক্রেতা কিছু কিনতে গেলে প্রথমে সে জিনিসটার মান দেখে, আর দামের তুলনা করে অন্যান্য একই ধরনের পণ্যের সঙ্গে। ধরুন, জিনিসটা মোবাইল ফোন হলে সে তার স্পেকস, স্টোরেজ, ক্যামেরা এই সব আগে দেখবে। কিংবা দেখবে ইউজেবিলিটি, ফোনের ওজন। কান্ট্রি অব অরিজিন অব দ্য ফিনিশড প্রোডাক্ট সবার শেষে দেখাটাই দস্তুর।’

তিনি বলেন, ‘আর তা ছাড়া মোবাইল ফোনের সাপ্লাই চেইনও খুব ফ্র্যাগমেন্টেড, মানে নানা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। যেমন অ্যাপলের আইফোনই তৈরি হয় প্রায় নব্বইটার মতো দেশে। ফলে একটা ফোনের যন্ত্রাংশ কোন দেশ থেকে কতটা আসছে, কোথায় অ্যাসেম্বলড হচ্ছে – ক্রেতা তা অনেক সময় জানেই না, কিংবা জানতেও চায় না।’

কিন্তু ব্রিটিশ শাসন আমলে যে ভারতের স্বদেশী আন্দোলনের ঐতিহ্য আছে, তারা এখন চীনের পণ্য বর্জনের ব্যাপারে কেন এত নিরুৎসাহী? ড. মুখার্জির মতে, তারা আসলে এখন বেশ বিভ্রান্ত ও লক্ষ্যহীন। স্বদেশি আন্দোলনটা ছিল সার্বিক স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশ, সেখানে উদ্দেশ্যটাও ছিল একেবারে পরিষ্কার – ইংরেজকে দেশছাড়া করা।"

তিনি বলেন, ‘এখানে যুদ্ধটা আপনি কার সঙ্গে লড়ছেন সেটাই তো পরিষ্কার নয়। আপনি কি সেই ভারতীয় ম্যানুফ্যাকচারারের বিরুদ্ধে লড়ছেন যার ফ্যাক্টরি চীনে, কিংবা যে চীন থেকে কিছু যন্ত্রাংশ আমদানি করে? না কি আপনি সেই ভারতীয় বিক্রেতার বিরুদ্ধেই লড়ছেন যে চীন থেকে জিনিস এনে এ দেশের নানা প্ল্যাটফের্মে বিক্রি করছে? স্বদেশি আন্দোলনের মতো এখানে কোনও স্পষ্ট দিশা নেই বলেই আসলে মুশকিল।’

ফলে ভারতে চীনা পণ্য বর্জনের ডাক সফল হতে গেলে তাতে আরও অনেক সময় লাগবে বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা। আর সেই ফাঁকে দেশি কোম্পানিগুলোকেও চীনের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার কঠিন চ্যালেঞ্জেও উতরোতে হবে, নইলে ভারতীয় ক্রেতা হয়তো বেশি দাম দিয়ে কখনওই কম মানের জিনিস কিনতে চাইবেন না। খবর: বিবিসি বাংলা।


সর্বশেষ সংবাদ