২৬ এপ্রিল ২০২০, ২২:১২

করোনাভাইরাস যেভাবে বদলে দিল যুক্তরাষ্ট্র-চীনের লড়াইয়ের অস্ত্র

  © বিবিসি

করোনাভাইরাস কীভাবে ছড়ালো, কারা দায়ি, তা নিয়ে জানুয়ারি থেকেই অনলাইনে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের শেষ নেই। এসব ভিত্তিহীন তত্ত্বের মধ্যে রয়েছে- এই ভাইরাস চীনের গোপন জীবাণু অস্ত্রের অংশ এবং চীন তাদের গুপ্তচরদের কাজে লাগিয়ে কানাডা থেকে এই ভাইরাস চুরি করে উহানে নিয়ে গিয়েছিল।

ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপ এবং বেনামি নানা টুইটার অ্যাকাউন্ট ছাড়িয়ে ভিত্তিহীন এসব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এমনকী রাশিয়ার সরকারি টিভির প্রাইম-টাইম অনুষ্ঠানেও জায়গা করে নেয়। প্রায় চার মাস পরেও, এসব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এখনও সমানে চলছে। সেই সাথে তাতে আগুন দিচ্ছেন চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিক এবং এমনকী মূলধারার কিছু মিডিয়া।

চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান কোনো প্রমাণ ছাড়াই বলে চলেছেন, করোনাভাইরাসের উৎপত্তি যুক্তরাষ্ট্রে। ১২ মার্চ, চীনা ওই কূটনীতিক টুইট করেন- মার্কিন সেনাবাহিনী হয়তো এই ভাইরাস উহানে বয়ে নিয়ে আসে।

পরদিন তিনি গ্লোবাল রিসার্চ নামে একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি আর্টিকেল টুইট করেন যার শিরোনাম ছিল- ‘এই ভাইরাসের সূত্রপাত যে যুক্তরাষ্ট্রে তার আরো কিছু প্রমাণ।’ অবশ্য পরে আর্টিকেলটি ওই সাইট থেকে ডিলিট করে দেওয়া হয়।

পরপরই চীনা দৈনিক গ্লোবাল টাইমস ঝাওয়ের কথার পুনরাবৃত্তি করে। চীনা দৈনিকে লেখা হয়- কূটনীতিক হয়তো চীনা সরকারের কথা বলেননি, তিনি তার নিজের মতামত প্রকাশ করেছেন, কিন্তু ‘তিনি চীনা জনগণের মনে যে সন্দেহ সেটাই প্রকাশ করেছেন।’

চীনের বেশ কতগুলো দূতাবাস এবং বিশ্বের নানা প্রান্তে সোশ্যাল মিডিয়ায় লোকজন ঝাওয়ের সুরে কথা বলতে শুরু করে দেয়।

ল্যাব থেকে ভাইরাস ছড়ানোর কোনো প্রমাণ কি রয়েছে?

বিবিসি মনিটরিংয়ের চীনা বিশেষজ্ঞ কেরি অ্যালেন বলছেন, চীনে সবাই জানে ঝাও রেখে-ঢেকে কথা বলেন না, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়াতে তিনি অনেক বিতর্কিত বক্তব্য দেন। যদিও সেগুলো সবসময় চীনা নেতৃত্বের মতামত বা মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ নয়।

গ্লোবাল রিসার্চ নামে যে ওয়েবসাইটের একটি আর্টিকেল তিনি টুইট করেছিলেন, সেটি ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত সেন্টার ফর রিসার্চ অন গ্লোবালাইজেশন নামে কানাডার একটি বেসরকারি গবেষণা সংস্থার।

সাইট।পলিটি-ফ্যাক্ট নামে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি ওয়েবসাইট যারা অনলাইনে প্রকাশিত নানা তথ্যের সত্যতা যাচাই করে, তারা বলছে, ‘গ্লোবাল রিসার্চ নাইন-ইলেভেন, ভ্যাকসিন এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে নানারকম ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রবক্তা।’

গ্লোবাল রিসার্চের যে আর্টিকেল ঝাও টুইট করেছিলেন, তার লেখক ছিলেন ল্যারি রোমানফ। তার লেখাটি গ্লোবাল রিসার্চ তাদের সাইট থেকে মুছে দিলেও, রোমানফ পরে আবারো বলেছেন, ভাইরাসটি চীন থেকে উৎপত্তি হয়নি।

কিন্তু সায়েন্স নামে যে সাময়িকীতে প্রকাশিত যেসব গবেষণামুলক আর্টিকেল রোমানফ প্রমাণ হিসাবে উদ্ধৃত করেছেন, সেগুলোতে কিন্তু চীনেই যে করোনাভাইরাসের শুরু তা নিয়ে তেমন কোনো সন্দেহ প্রকাশ করা হয়নি। সেগুলোতে শুধু সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে যে, উহানের জীব-জন্তুর বাজার থেকে এই ভাইরাসের উৎপত্তি নাও হতে পারে। রোমানফ আরও দাবি করেন, ‘জাপান এবং তাইওয়ানের বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন যে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি যুক্তরাষ্ট্রে।’

তবে জাপানি এবং তাইওয়ানের টিভিতে তাইওয়ানের ফার্মাকোলজির যে অধ্যাপকের দেওয়া মতামতকে রোমানফ উদ্ধৃত করেন, পরে জানা যায় ওই অধ্যাপক এখন তার দেশে বেইজিংপন্থী একটি রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়েছেন। উপরন্তু রোমানফ তাকে একজন ভাইরোলজিস্ট বলে পরিচয় দিলেও তিনি তা নন।

রোমানফ আরও দাবি করেন, ম্যারিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যে মার্কিন সেনাবাহিনীর জীবাণু অস্ত্রের একটি ল্যাবই হচ্ছে করোনাভাইরাসে সূত্র। তিনি দাবি করেন, ‘প্যাথোজেন লিকেজ ঠেকানোর যথেষ্ট সুরক্ষা ব্যবস্থার অভাবে গত বছর ঐ ল্যাবটিতে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

কিন্তু সে সময় নিউইয়র্ক টাইমস তাদের এক রিপোর্টে বলেছিল যে ম্যারিল্যান্ডের ওই ল্যাবটি বন্ধ করে দেওয়া হয়নি, শুধু গবেষণা কাজ স্থগিত করা হয়। প্রতিষ্ঠানের একজন মুখপাত্র সে সময় বলেন, ‘বিপজ্জনক কোনো পদার্থ এই ল্যাব থেকে নিঃসারিত হয়নি।’

রোমানফ নিজেকে একজন ‘অবসরপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরামর্শক এবং ব্যবসায়ী’ হিসাবে পরিচয় দেন। তিনি বলেন, তিনি সাংহাইয়ের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ভিজিটিং প্রফেসর যেখানে এমবিএ প্রেগামের ক্লাসে বিশ্বের বিভিন্ন বিষয়ে নানা কেস স্টাডিজের বিশ্লেষণ করেন তিনি।

কিন্তু ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল সাময়িকী লিখছে ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটো এমবিএ প্রোগামের সাথে জড়িত লোকজন রোমানফ সম্পর্কে কিছু জানেন না। বিবিসি ফুদান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে রোমানফ সম্পর্কে জানতে চেয়েছে, কিন্তু এখনও কোনো জবাব পায়নি।

গ্লোবাল রিসার্চে প্রকাশিত রোমানফের সিংহভাগ লেখাতেই যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করা হয়েছে এবং তিনি নানাভাবে চীনকে সমর্থন করেছেন। যেমন ১৯৮৯ সালে তিয়েনানমেন স্কোয়ারের ছাত্র বিক্ষোভ সম্পর্কে তিনি লেখেন, আমেরিকাই ওই ‘বিপ্লবে উস্কানি’ দিয়েছিল। বিবিসি রোমানফের কাছ থেকে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিল, কিন্তু তিনি কোনো উত্তর দিননি।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে এই ভাইরাসের উৎপত্তি বলে চীনা কূটনীতিক এবং চীনা মিডিয়ার এসব দাবির পর ক্ষুব্ধ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও দাবি করেন, চীন যেন এসব ‘ভুয়া তথ্য’ ছড়ানো বন্ধ করে।সেই সাথে চীনের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রচারণা শুরু করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তিনি করোনাভাইরাসকে ‘চাইনিজ ভাইরাস’ আখ্যা দেন।

একইসাথে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তহবিলে চাঁদা বন্ধের ঘোষণা দেন ট্রাম্প। তিনি দাবি করেন, ডব্লিউএইচও চীনের সমর্থক। সেই সাথে আমেরিকার একাধিক রাজনীতিক এবং ভাষ্যকার কোনো প্রমাণ ছাড়াই দাবি করতে শুরু করেন, চীনই এই ভাইরাস ছড়িয়েছে।

ডানপন্থী টিভি ফক্স নিউজের সুপরিচিত উপস্থাপক টাকার কারলসন একটি গবেষণা উদ্ধৃত করে বলেন, ‘উহানের একটি ল্যাব থেকে দুর্ঘটনাবশত এই ভাইরাস বাইরে ছড়িয়ে পড়ে।’ এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে সমর্থন করে বক্তব্য দেন শীর্ষ দুই রিপাবলিকান সিনেটর- টেড ক্রুজ এবং টম কটন।

যে গবেষণার কথা ফক্স টিভি বলেছে, তার একটি প্রাথমিক খসড়া ফেব্রুয়ারির গোড়ার দিকে প্রকাশ করেন বোটাও শিয়াও এবং লি শিয়াও নামে গুয়াংজু সাউথ চায়না বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন গবেষক। তাদের ওই গবেষণাপত্রটি অন্য কোন গবেষক পর্যালোচনাও করেনি, যেটা যে কোনো গবেষণার প্রচলিত নিয়ম। ওই খসড়ায় বলা হয়, ‘করোনাভাইরাস হয়তো উহানের একটি ল্যাব থেকে ছড়িয়েছে।’

শিয়াও অবশ্য পরে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে বলেন, তিনি তার গবেষণাপত্রটি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। ওয়াল স্টিট্র জার্নাল তাকে উদ্ধৃত করে বলে, ‘বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্য এবং প্রকাশিত আর্টিকেলের ভিত্তিতে তারা ভাইরাসের সম্ভাব্য উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে মতামত দেন, সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণের ভিত্তিতে নয়।’

এপ্রিলের মাঝামাঝি ওয়াশিংটন পোস্ট লেখে, চীনে মার্কিন দূতাবাসের দুজন কর্মকর্তা ২০১৮ সালে উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি সফর করার পর মার্কিন সরকারকে সাবধান করেছিলেন যে, উহানের ল্যাবে সুরক্ষার ঘাটতি রয়েছে এবং সেখানে বাদুড় বাহিত করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে।

তবে ইবোলা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় যুক্তরাষ্ট্রে সতর্কতা কর্মসূচির প্রধান ছিলেন যিনি সেই জেরেমি কোনিনডিক বলেন, ‘এই ভাইরাসের সূত্রপাত কোনো ল্যাব থেকে হতে পারে- এমন সম্ভাবনা বিজ্ঞান একেবারে নাকচ করছে না, কিন্তু যেসব প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে, তাতে সে সম্ভাবনা খুবই কম।’