জেসমিনের স্বপ্নের পথযাত্রা
মা-বাবা আর দুই ভাইকে নিয়ে মিরপুর ১০ নম্বরে একটি ছোট্ট কুঁড়েঘরে থাকে জেসমিন আখতার। ছোটবেলা থেকেই বাস্তবতা বুঝতে শিখেছে মেয়েটি। সে জানে দরিদ্রতার কারণে তার কপালে লেখাপড়া নেই। রিকশাচালক বাবার পক্ষে পাঁচ সদস্যের পরিবারের জন্য দু'বেলা খাবার জোগাড় করাই যেখানে কঠিন, লেখাপড়ার চিন্তাটা সেখানে বিলাসিতা। জেসমিন ধরেই নিয়েছিল লেখাপড়া শুধু ধনীদের জন্য।
তবে হঠাৎ একদিন জেসমিনের ভাগ্যের নাটকীয় পরিবর্তন ঘটল। সে জানতে পারল মামাবাড়ি ট্রাস্ট সম্পর্কে। প্রথমে সে বুঝতে পারেনি এ প্রতিষ্ঠানটি কী কাজ করে। পরে জানতে পারল তার মতো সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়াশোনা, বই কেনা, তিন বেলা খাওয়ানোসহ দেখভালের সব খরচ বহন করে মামাবাড়ি ট্রাস্ট। তার কাছে এটা ছিল 'মামাবাড়ির আবদার'- এর মতো। তাই সব জেনেও প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিল না জেসমিন। তার মনে প্রশ্ন জাগে- এত ভালো জায়গাও দুনিয়ায় আছে?
মামাবাড়ি ট্রাস্ট মিরপুরভিত্তিক একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। তারা মূলত মিরপুরের বস্তি এলাকার সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করছে। শিক্ষার আলোয় শিশুদের আলোকিত করাই তাদের মূল লক্ষ্য। ট্রাস্টের উদ্যোক্তা সমাজসেবী মাহবুব রাব্বানী ও আয়েশা রাব্বানী দম্পতি। ২০০৯ সালে মাত্র সাতজন সুবিধাবঞ্চিত শিশু নিয়ে তারা এ ট্রাস্টের কার্যক্রম শুরু করেন। প্রথম দিকে ট্রাস্টের কোনো নাম ছিল না। পরবর্তী সময়ে 'মামাবাড়ি' নামটা ঠিক করা হয়। কারণ আমাদের দেশে মামাবাড়ি মানেই শিশুদের জন্য আনন্দের জায়গা। যেখানে তারা খুব আনন্দে ও পরম যত্নে দিন কাটাতে পারে। এখানে থাকা শিশুদের স্বজনরাও তাই ট্রাস্টকে 'মামাবাড়ি' নামেই ডেকে থাকে।
বর্তমানে ট্রাস্টটি ৯৭ শিশুর লেখাপড়ার খরচ, স্কুল ইউনিফর্ম, খাবারসহ সব খরচ বহন করছে। এখন পর্যন্ত ট্রাস্টের অনেক ছাত্রছাত্রী সফলতার সঙ্গে এসএসসি, এইচএসসি ও কারিগরি পরীক্ষায় পাস করেছে। মামাবাড়ি ট্রাস্টের পরিবার জেসমিনকেও সাদরে গ্রহণ করে। এরপর স্বপ্নের ডানা মেলে ওড়ার সুযোগ নিতে লেখাপড়া শুরু করতে পেরেছে সে। এখন সে মিরপুর গার্লস আইডিয়াল স্কুলের ছাত্রী। এখানকার অন্যদের মতো জেসমিনও জীবনে খুঁজে পেয়েছে নতুন আশার আলো। পেয়েছে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ও স্বপ্ন দেখার সাহস। এ আশার আলো যেন তাকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
মামাবাড়ি ট্রাস্টের একটি নির্ধারিত বাড়ি রয়েছে। শিশুরা এ বাড়িতে রাতে থাকে না। তবে বাকিটা সময় তাদের ওখানেই কাটে। তারা এখানে খাওয়া-দাওয়া করে, হোমওয়ার্ক করে, গোসল করে, এমনকি এক্সট্রা কারিকুলাম বিভিন্ন কাজে অংশ নেয়। কিছু মেয়ে শিশু এখানে কারাতে ও তায়কান্দো প্রশিক্ষণও নিচ্ছে। তাদের কেউ কেউ খুব সুন্দর গান গায়, কেউ খুব সুন্দর ছবি আঁকে, আবার কেউ খেলাধুলায় দুর্দান্ত।
শুরুতে পথচলা অনেক কঠিন হলেও রাব্বানী দম্পতির এমন নিঃস্বার্থ উদ্যোগ বেশ সাড়া ফেলেছে। তাই বিভিন্ন সময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন দেশের অনেক সমাজসেবী ও করপোরেট প্রতিষ্ঠান। এরই ধারাবাহিকতায় ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডও এই শিশুদের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ব্যাংকটি আগামী এক বছর তাদের সিএসআর ফান্ড থেকে এ ট্রাস্টকে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ জন্য সম্প্রতি ব্যাংকের ডেপুটি ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিআরও চৌধুরী আখতার আসিফ, কমিউনিকেশনস বিভাগের প্রধান ইকরাম কবীর, সাসটেইনেবল ফিন্যান্স বিভাগের প্রধান তাহমিনা জামান খান মামাবাড়ি ট্রাস্ট পরিদর্শন করেন।
এ বিষয়ে চৌধুরী আখতার আসিফ বলেন, 'বৃহৎ ব্র্যাক পরিবারের অংশ হিসেবে ব্র্যাক ব্যাংকের ডিএনএতে করপোরেট দায়িত্ব যুক্ত আছে। আমরা মামাবাড়ি ট্রাস্টকে যে সহযোগিতা করছি, তা ভবিষ্যতে সুন্দর সমাজ নির্মাণের বিনিয়োগ। ইউনাইটেড নেশনস গেল্গাবাল কমপ্যাক্টের সদস্য হিসেবে এবং সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল পূরণের প্রতিজ্ঞা থেকে ব্র্যাক ব্যাংক সব সময় সিএসআর প্রকল্পগুলোকে বাড়তি গুরুত্ব দেয়। যার ফল সুদূরপ্রসারী।' তিনি আরও বলেন, 'বিশ্বাস করি আমাদের এই ছোট অবদানের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। দেশের জন্য তারা আর বোঝা থাকবে না, সম্পদ হবে।'