'বোমায় যদি নাও মারা যাই, ক্ষুধা কিংবা হৃদয় ভেঙ্গে মারা যাবো'
গাজার খান ইউনিসে বসবাস করা হাবিব কেশতা আর তাঁর স্ত্রী নূর একসময় নতুন প্রাণের আশায় বুক বেঁধেছিলেন। সম্প্রতি জানতে পেরে তাঁরা ভীষণ খুশি হয়েছিলেন যে, তাঁদের ঘরে আসছে এক পুত্রসন্তান। ইসরায়েলি গণহত্যার আগেই তাঁদের একটি কন্যাসন্তান জন্মেছিল। নতুন সন্তানের খবর তাঁদের অন্ধকার জীবনে খানিকটা হলেও আলো দেখাবে—এমন আশা করেছিলেন তাঁরা।
২৭ বছর বয়সী কেশতা বলেন, ‘আমরা ভীষণ খুশি হয়েছিলাম ছেলের খবর শুনে।’কিন্তু সেই আনন্দ বেশিদিন টিকল না। স্মৃতিচারণ করেন কেশতা বলেন, ‘এক সপ্তাহ পর আমার স্ত্রী অস্বাভাবিক ব্যথা অনুভব করলেন। আমরা আবার চিকিৎসকের কাছে গেলাম। চিকিৎসক তখন জানান, অপুষ্টির কারণে ভ্রূণের মৃত্যু হয়েছে।‘ চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন নূর। আশপাশে তখন তীব্র ইসরায়েলি বিমান হামলা চলছিল। মাসের পর মাস তিনি পুষ্টিকর খাবার প্রায় পাননি। কেশতার জানান, ‘আমাদের যা আছে তা হলো টিনজাত শিম, দুক্কা আর থাইম। অনেক সময় রুটিও থাকে না। একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীর জন্য এসব কোনোভাবেই পুষ্টি নয়।‘
গাজার মায়েদের অবর্ণনীয় কষ্ট
২মার্চ থেকে ইসরায়েল গাজার সীমান্ত পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার পর প্রায় ২০ লাখ মানুষ প্রবেশ করেছে নতুন এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময়ে। গমের আটা এখন বিলাসবহুল পণ্যে পরিণত। ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে ইতিমধ্যেই শত শত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আংশিকভাবে সীমান্ত খুললেও খাবারের দাম আকাশচুম্বী। অনেক ক্ষেত্রে সাহায্যবাহী ট্রাক লুট হয়ে যাচ্ছে, কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ বিতরণকেন্দ্রে পৌঁছতে পারছেন না সাধারণ মানুষ।এ অবস্থায় হাসপাতালগুলো প্রায় ভেঙে পড়েছে। আহত রোগীর ভিড়ে গর্ভবতী নারীদের জায়গা নেই। তাঁরা বাধ্য হচ্ছেন অস্থায়ী চিকিৎসাকেন্দ্রে গিয়ে পরীক্ষার জন্য। সেখানেই নূরের ভ্রূণের মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছিল। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসেই ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অন্তত ২ হাজার ৫০০টি গর্ভপাত ও নবজাতকের মৃত্যুর তথ্য নথিবদ্ধ করেছে। শুধু জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতেই গর্ভপাতের সংখ্যা ছিল আগের বছরের দ্বিগুণ। স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন, এর প্রধান কারণ অপুষ্টি, ভিটামিনের ঘাটতি, চিকিৎসাসেবার ভাঙন ও গর্ভকালজুড়ে বাস্তুচ্যুতি ও বোমাবর্ষণ। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ৩৬১ জন মানুষ অপুষ্টিতে মারা গেছেন, যাঁদের মধ্যে ১৩৯ জন শিশু।
সবচেয়ে বেশি ভুগছেন অন্তঃসত্ত্বা ও বৃদ্ধরা
শুধু অন্তঃসত্ত্বা নারীরাই নয়, বৃদ্ধরাও এই দুর্ভিক্ষে সবচেয়ে বেশি ভুগছেন। দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের পশ্চিমে কাপড় ও নাইলনের তৈরি এক অস্থায়ী তাঁবুতে আশ্রয় নিয়েছেন ৮৫ বছর বয়সী সালিম আসফুর। পূর্ব খান ইউনিসের আবাসান এলাকা থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়ার পর তিনি গত এক বছর ধরে বেঁচে আছেন সামান্য টিনজাত খাবারের ওপর নির্ভর করে। আসফুর বলেন, ‘আমার শরীর ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছে। জীবনের শেষ সময়টা এমনভাবে কাটাব, ভাবিনি।‘
তিনি একসময় সুস্থ–সবল ও কর্মক্ষম ছিলেন। এখন ভীষণ দুর্বল, দাঁড়াতেও কষ্ট হয়। দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা, রক্তচাপ সবসময় বেশি থাকে। ক্যানজাত খাবারের কারণে এমন হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। “তাও যদি পাই, মনে হয় যেন সোনা পেয়েছি। ‘আংশিকভাবে সাহায্য ঢুকলেও আসফুরের শরীরের দুরবস্থা কাটেনি। তিনি বলেন, ‘তখন আমরা ভাত, রুটি আর সামান্য শিম খেতে পেরেছিলাম। কিন্তু শরীরের দুর্বলতা কমেনি। এখনো ডিম নেই, মাংস নেই, মুরগি নেই, কোনো প্রোটিন নেই। খাবার এলে দাম এত বেশি যে কেনা সম্ভব নয়, আর পরিমাণও যথেষ্ট নয়।‘
খাবারের জন্য হাহাকার
গাজা সিটি দখলের সামরিক অভিযানের আগে ইসরায়েল ঘোষণা করেছে, আর কোনো বিরতি দেবে না সাহায্য ঢুকতে। উত্তরাঞ্চলে সাহায্যও সীমিত বা বন্ধ করা হবে, যাতে মানুষ দক্ষিণে পালিয়ে আসে। কিন্তু বয়স্ক আসফুরের মতো অনেকেই সেই সাহায্যের নাগাল পাচ্ছেন না। তাঁর কথায়, ‘আমি বৃদ্ধ মানুষ। গুলির নিচে হাজার হাজার ক্ষুধার্ত মানুষের ভিড়ে দৌড়াতে পারি না। কিছু বহন করতেও পারি না, কয়েক কিলোমিটার হেঁটে বিতরণকেন্দ্রে যাওয়াও অসম্ভব।‘ফলে কখনো টানা পাঁচ দিনও রুটি খেতে পারেননি, শুধু পানিতে মিশিয়ে পাতলা ডালসুপ খেয়ে বেঁচেছেন। যখনই সামান্য খাবার পাওয়া যায়, সেটি শিশুদের জন্য রেখে দেন। ‘আমার নাতি–নাতনিরা বোঝে না কেন খাবার এত কম। তারা বোঝে না, যখন বলি আজ তাদের জন্য মাত্র একটি ছোট টুকরো রুটি আছে।‘ আসফুর বলেন, ‘ক্ষুধা আমাদের সবাইকে ক্লান্ত করে ফেলেছে। আমি বিশ্বাস করি, যদি বোমায় না মরিও, তবে হয় ক্ষুধায় মরব কিংবা আমাদের জীবনে যা ঘটছে তার দুঃখে হৃদয়ভঙ্গ হয়ে মরব।‘
সংবাদসূত্র: মিডিলইস্ট আই