নোবেল নিয়ে ট্রাম্পের উচ্ছ্বাস, মোদীর অসন্তোষ, ভারত সফর বাতিল
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নোবেল শান্তি পুরস্কার ইস্যুতে প্রকাশ্য উচ্ছ্বাস ও দাবি মেনে নিতে পারছিলেন না। মি. ট্রাম্প বারবার, উচ্ছ্বাসপূর্ণ ভঙ্গিতে দাবি করছিলেন যে তিনি ভারত-পাকিস্তান সংঘাত “সমাধান”করে ফেলেছেন,যেটি আসলে ৭৫ বছরেরও বেশি পুরোনো এবং অত্যন্ত জটিল।
১৭ জুন এক টেলিফোন আলাপে ট্রাম্প আবারও বিষয়টি তোলেন এবং পাকিস্তানের পক্ষ থেকে নোবেল মনোনয়নের কথা উল্লেখ করেন। ফোনালাপে থাকা একাধিক সূত্রের বরাতে জানা গেছে, ট্রাম্প মোদিকে পরোক্ষভাবে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে তিনিও যেন নোবেল প্রাপ্তির মতো কোনো পদক্ষেপ নেন।
মোদি এ বিষয়ে স্পষ্ট অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতিতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা নেই, এটি সম্পূর্ণ ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সমঝোতার ফল। মোদীর এই অবস্থান ট্রাম্পকে ততটা প্রভাবিত করতে পারেনি, তবে নোবেল ইস্যুতে উদাসীনতার কারণে দুই নেতার মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
এর আগে, ট্রাম্প ও মোদীর সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তিনি টেক্সাসে ‘হাউডি মোদী!’ সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন। পরে গুজরাটে ‘নমস্তে ট্রাম্প!’ অনুষ্ঠানে মোদী তাকে বিমানবন্দরে আলিঙ্গন করে স্বাগত জানান এবং এক লক্ষেরও বেশি মানুষের উপস্থিতিতে উদযাপন করেন। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে বিদেশি নেতারা তার অহংকার তুষ্ট করতে প্রশংসা ও উপহার দিয়ে সফল হয়েছেন।
কিন্তু ট্রাম্প মোদীর কাছ থেকে যা চাইছিলেন, তা রাজনৈতিকভাবে সম্ভব নয়। মোদীর শক্তিশালী নেতার ভাবমূর্তি অনেকাংশে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তার কঠোর অবস্থানের ওপর নির্ভরশীল। নোবেল মনোনয়ন স্বীকার করা বা তার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া দেশীয় রাজনৈতিক খেসারত হিসেবে ধরা হতো।
জুন মাসের ফোনালাপের চার দিনের মধ্যে ট্রাম্প বিষয়টি আবার টেনে আনেন কঙ্গো ও রুয়ান্ডার মধ্যে শান্তি চুক্তি ঘোষণার সময়। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, “আমি এ জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার পাব না, ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ থামানোর জন্যও নোবেল পাব না। না, আমি যা-ই করি না কেন, আমি কোনো নোবেল শান্তি পুরস্কার পাব না।”
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারতের কঠোর প্রতিক্রিয়া এবং মোদীর নোবেল ইস্যুতে উদাসীনতা দেখায় যে গত এক দশকে ক্ষমতা ক্রমশ কেন্দ্রীভূত হয়েছে মোদীর শক্তিমান ভাবমূর্তি রক্ষার স্বার্থে। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো তানভি মাদান বলেন, “মোদী মার্কিন চাপের মুখে যুদ্ধবিরতি মেনে নেবেন বা মধ্যস্থতা চাইবেন—এ ধারণা তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। মোদী তার মার্কিন সম্পর্ককে কৌশলগত ও রাজনৈতিক সম্পদ হিসেবে তুলে ধরেছেন, এখন বিরোধীরা এটিকে দায় হিসেবে দেখাচ্ছে।”
জুন মাসের ফোনালাপের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই, যখন ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য আলোচনা ধীরগতিতে চলছিল, মি. ট্রাম্প হঠাৎ ঘোষণা দেন যে ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। এরপর বুধবার, রাশিয়া থেকে তেল কেনার কারণে ভারতের ওপর আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপানো হয়, যা মিলিয়ে দাঁড়ায় মোট ৫০ শতাংশ।
একসময় যিনি মি. ট্রাম্পকে “একজন সত্যিকারের বন্ধু” হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন, সেই মি. মোদী এখন আনুষ্ঠানিকভাবে তার অপছন্দের তালিকায় চলে গেছেন। জানা গেছে, মি. ট্রাম্প মোদীকে জানিয়েছিলেন চলতি বছরের শেষ দিকে কোয়াড সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য ভারত সফর করবেন। তবে প্রেসিডেন্টের সময়সূচি সম্পর্কে অবগত সূত্র বলছে, এবার শরতে তার ভারত সফরের কোনো পরিকল্পনা নেই।
ভারতে বর্তমানে অনেকেই মি. ট্রাম্পকে জাতীয় অপমানের উৎস হিসেবে দেখছেন। সম্প্রতি মহারাষ্ট্রের এক উৎসবে বিশাল ট্রাম্প কুশপুত্তলিকা শোভাযাত্রায় ঘোরানো হয়, যেখানে তাকে “পেছন থেকে ছুরিকাঘাতকারী” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের পদক্ষেপকে এক ভারতীয় কর্মকর্তা “গুন্ডাগিরি” হিসেবে বর্ণনা করেছেন—সরাসরি ভয় দেখানো বা দাদাগিরি।
এরই মধ্যে, যুক্তরাষ্ট্র-ভারত বাণিজ্য আলোচনার পটভূমিতে এই দ্বন্দ্ব আরও গুরুতর আকার নিয়েছে। ভারত আগামী সপ্তাহান্তে চীন সফরে যাবে, যেখানে মোদি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
সংবাদসুত্রঃ নিউইয়র্ক টাইমস