যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে নেতৃত্ব দিয়েছেন, অথচ 'রাজাকার' শব্দেই তার পতন
গত বছরের আজকের দিনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে, গণবিক্ষোভ ও সহিংসতার মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি আন্দোলনের সময় মন্তব্য করে ছিলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিদের পাবে না, তবে রাজাকারের নাতিরা পাবে?’। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু মজার বিষয় হল, ‘রাজাকার’ শব্দটিই তার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশের ইতিহাসের ঘটে যাওয়া সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কাতার ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার অনুসন্ধানী পডকাস্ট সিরিজ প্রকাশ করেছে। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘৩৬ জুলাই বাংলাদেশের অভ্যুত্থান’। পডকাস্টে হাসিনা সরকারের পতন, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ছাত্র আন্দোলন এবং রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের বিবরণ উঠে এসেছে।
কেভিন হার্টিনের পরিচালনায় ও তামারা খান্ডোকারের প্রযোজনায় পডকাস্টে উঠে আসে গত জুলাই-আগস্টে কয়েক সপ্তাহব্যাপী চলা বিক্ষোভ, সরকারি দমনপীড়ন এবং নজিরবিহীন ছাত্র প্রতিরোধে এক সময়ের গণতন্ত্রের প্রতীক শেখ হাসিনার কীভাবে পতন হয়। একটি বিতর্কিত সরকারি চাকরির কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভ কীভাবে ধীরে ধীরে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়।
পডকাস্টে তথ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনার পতনের চিত্র হিসেবে গণভবনসহ সরকারি ভবনগুলোর লুট ও ধ্বংস কথা তুলে ধরা হয়। ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক আন্দালিয়াব চৌধুরী গণভবনের ধ্বংসপ্রাপ্ত দেখে বলেন, ‘এটা যেন জম্বি আক্রমণ।’ প্রাচীরজুড়ে আঁকা গ্রাফিতি এবং মানুষের ক্ষোভ দেখে তার এমন অনুভব হয়েছিল।
‘মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিদের পাবে না, তবে রাজাকারের নাতিরা পাবে?’, শেখ হাসিনার এই একটি মন্তব্যই সরকার পতনের আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। মূলত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের সহযোগীদের বোঝাতে ব্যবহৃত ‘রাজাকার’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
শেখ হাসিনার এই বক্তব্যের পরপরই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিতে থাকে, ‘ আমি কে তুমি কে, রাজাকার রাজাকার’। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাৎক্ষণিক মিছিল শুরু করে। অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকর্মী প্রাপ্তি তপসী বলেন, ‘সেদিনই শেখ হাসিনার জন্য শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া হয়েছিল।’
গত বছরের ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের উপর হামলা চালায়। আশিফা খাতুন নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘মেয়েরা রক্তাক্ত হয়েছিল। কেউ কেউ রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। অজ্ঞান হওয়ার পরও আমাদের মারধর করা হয়।’
ছাত্রলীগের সদস্যরা হকিস্টিক ও ইট-পাটকেল নিয়ে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। এমনকি হাসপাতালে গিয়েও আহতদের ওপর হামলা চালায়। সরকারপক্ষের কথোপকথনের অডিও বিশ্লেষণ করে প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম দাবি করেন, ‘তাদের প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।’
তবে ছাত্রলীগের করা হামলা আন্দোলন থামানোর পরিবর্তে আরও বেগবান করে দেয়। আশিফা বলেন, ‘১৫ জুলাই আমাদের সবাইকে বদলে দেয়।’ পডকাস্টে দাবি করা হয়েছে, ফরেনসিক বিশ্লেষণে যাচাই করা টেলিফোন রেকর্ডে প্রমাণ মিলেছে যে শেখ হাসিনা নিজে এই দমন অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। আল জাজিরার কাছে থাকা এক কল রেকর্ডে হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, ‘জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগ করো। সংঘর্ষের চিত্র দেখিও না, শুধু ক্ষয়ক্ষতির ছবি দেখাও।’
আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে যখন ছাত্রলীগ ও যুবলীগ সদস্যরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শতাধিক নিরীহ শিক্ষার্থীকে ঘিরে ফেলে ও আক্রমণ চালায়। তখন শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশ সহযোগিতা না করায় ফেসবুক লাইভে সাহায্যের আবেদন জানায়। আন্দোলনে অংশ নেওয়া মালিহা বলেন, ‘৩৬ জুলাই আমি প্রথম কেঁদেছিলাম। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করায় মনে হয়েছিল আমাদের সব কষ্ট স্বার্থক হয়েছে।’
পডকাস্টে আরও তুলে ধরা হয়, কীভাবে এক শিক্ষার্থীকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করছে। এ ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে পরবর্তীতে সারা দেশে প্রতিবাদের নতুন ঢেউ তোলে ও সরকারকে আরও গভীর সংকটে ফেলে। অবশেষে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাথায় ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন এবং বিমানে করে দেশ ত্যাগ করেন।
এই ঘটনার পর ছাত্রলীগকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ১৫ জুলাইয়ের সহিংসতায় জড়িত শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। তবে আওয়ামী লীগ নেতারা সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, শেখ হাসিনা কখনো প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহারের নির্দেশ দেননি। আল জাজিরার প্রকাশিত অডিও ক্লিপগুলোর বিষয়ে তাদের দাবি, ‘এগুলো একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রমূলক প্রচারণা।’ ছাত্রলীগ দাবি করেছে, তারা শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পথেই ছিল।
তবে আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য সেই স্মৃতি আজও দগদগে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মালিহা বলেন, ‘আমরা একসঙ্গে কেঁদেছি, একসঙ্গে লড়েছি। সেই দিন আমার মনে আবার মানুষের প্রতি বিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছিল।’