২৯ জুলাই ২০২৫, ০১:৪৬

গাজায় গণহত্যার অভিযোগে ইসরায়েলি মানবাধিকার সংস্থাগুলোর নজিরবিহীন অবস্থান

বিধ্বস্ত গাজা  © সংগৃহীত

গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অভিযোগে এবার সরব হয়েছে ইসরায়েলেরই দুটি শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা। সোমবার (২৮ জুলাই) এক প্রতিবেদনে ‘বেতসেলেম’ (B’Tselem) ও ‘ফিজিশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস – ইসরায়েল’ জানায়, গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান এখন একটি ‘গণহত্যায়’ রূপ নিয়েছে। (খবর দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস)

এই প্রথমবারের মতো অভ্যন্তরীণ ইসরায়েলি মানবাধিকার সংস্থাগুলো স্পষ্টভাবে গাজার যুদ্ধকে ‘গণহত্যা’ বলে অভিহিত করল। এর আগে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ তুললেও, ইসরায়েলি সংস্থার পক্ষ থেকে এতটা স্পষ্ট ভাষায় এমন অভিযোগ এই প্রথম।

 ‘আমাদের গণহত্য’  শিরোনামে প্রকাশিত বেতসেলেমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের অভিযানে গাজার সাধারণ মানুষের উপর যে বিপর্যয় নেমে এসেছে, তা সংগঠিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন বহন করে। তারা তুলে ধরেছে— গাজায় দশ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির মৃত্যু, শহর ও আবাসিক এলাকা সম্পূর্ণ ধ্বংস, দুই মিলিয়নেরও বেশি মানুষের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি, খাদ্য, ওষুধসহ জরুরি সহায়তা সামগ্রীর প্রবেশে বাধা।

বেতসেলেমের নির্বাহী পরিচালক ইউলি নভাক এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আজ আমরা যে প্রতিবেদন প্রকাশ করছি, তা আমরা কখনোই লিখতে চাইনি। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে যা ঘটছে, তা আর অস্বীকার করা সম্ভব নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ৭ অক্টোবর হামাসের ভয়াবহ হামলার গুরুত্ব খাটো করছি না, কিন্তু ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়ায় যে মাত্রায় গাজার জনগণের ওপর আঘাত হানা হয়েছে, তা স্পষ্টতই একটি গণহত্যায় পরিণত হয়েছে।’

সরকারের কটূক্তি ও ঘৃণাত্মক বক্তব্যও যুক্ত হয়েছে প্রমাণে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইসরায়েলি মন্ত্রী ও রাজনীতিকদের একাধিক অমানবিক ও ঘৃণামূলক বক্তব্য এই গণহত্যার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত চরিত্রের ইঙ্গিত দেয়। যেমন, সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াওভ গালান্ট গাজার মানুষকে ‘মানব পশু’ বলে আখ্যায়িত করেন, অন্য একাধিক নেতা গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উৎখাতের কথাও বলেন প্রকাশ্যে।

আরও পড়ুন: আইইএলটিএস পরীক্ষায় অডিও বিভ্রাট, ক্ষতিগ্রস্তদের বিকল্প সুযোগ দিয়েছে আইডিপি

ইসরায়েলের প্রত্যাখ্যান ও প্রতিক্রিয়া
সরকারি মুখপাত্র ডেভিড মেনসার এই অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘ইসরায়েল ফিলিস্তিনি জনগণ নয়, হামাস সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।’ তিনি আরও দাবি করেন, ‘ইসরায়েল যদি সত্যিই গাজা ধ্বংস করতে চাইত, তবে তারা দুই মিলিয়ন টনের বেশি মানবিক সহায়তা প্রবেশ করতে দিত না।’

আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারাধীন বিষয়
গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড গণহত্যার আওতায় পড়ে কিনা—এই প্রশ্নটি বর্তমানে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) বিচারাধীন রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মামলা করেছে। যদিও এখনো আদালতের চূড়ান্ত রায় আসেনি, তবে ইসরায়েলি মানবাধিকার সংস্থাগুলোর এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রভাব ফেলতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

গাজার বাস্তবতা ভয়াবহ
ইসরায়েলি বিমান হামলা ও স্থল অভিযানে ৫৯,০০০ জনের বেশি মানুষ নিহত, যার মধ্যে হাজার হাজার শিশু রয়েছে। গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই তথ্য জানিয়েছে। বিশাল জনসংখ্যা গৃহহীন, অনাহারে ও চিকিৎসাহীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে।

অন্যদিকে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী হামাসকে দায়ী করে বলছে, তারা বেসামরিক এলাকাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। তবে বেতসেলেম বলেছে, ‘এই অভিযোগের পক্ষে প্রমাণ না দিয়েই যেভাবে হাসপাতাল, বাসা ও বেসামরিক স্থাপনায় হামলা চালানো হচ্ছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’

বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েলি মানবাধিকার সংস্থাগুলোর এই সাহসী অবস্থান কেবল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নয়, বরং দেশের ভেতরে একটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক বার্তা দিচ্ছে—এবং সেটি হলো, গণহত্যা কখনোই আত্মরক্ষার ছায়ায় বৈধ হয়ে যেতে পারে না।