২৬ জুন ২০২৫, ২১:২৫

পশ্চিমা মিডিয়ার চোখে গাজার মানবিক বিপর্যয় কীভাবে দেখানো হয়?

প্রতীকী ছবি  © দুর্ভিক্ষ

গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি অবরোধ ও সামরিক অভিযানের মধ্য দিয়ে যখন এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় এবং ‘দুর্ভিক্ষ’ বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে, তখন পশ্চিমা গণমাধ্যমে এই সংকটকে ঘিরে ভাষার ব্যবহার ও কাভারেজে দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট দ্বিমুখিতা।

জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ) যেখানে গাজায় "আসন্ন" এবং "বিস্তৃত দুর্ভিক্ষ" ঘোষণা করেছে, সেখানে অনেক পশ্চিমা গণমাধ্যম এখনো ‘food shortage’, ‘nutrition crisis’ বা ‘logistical failure’-এর মতো অস্পষ্ট শব্দ ব্যবহার করছে—"famine" বা "starvation"-এর মতো সুনির্দিষ্ট আইনগত শব্দ নয়।

২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলের যুদ্ধ অভিযান শুরুর পর থেকেই গাজা উপত্যকায় বসবাসরত দুই কোটির বেশি ফিলিস্তিনি অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছেন। অবকাঠামোর ধ্বংস, মানবিক সহায়তা আটকে রাখা এবং অব্যাহত হামলার ফলে খাদ্য ও পানির সংকট গভীরতর হয়ে ওঠে।

জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা একাধিকবার এই অবস্থাকে ‘ইচ্ছাকৃত দুর্ভিক্ষের কৌশল’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে, যা যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের মধ্যে পড়ে।

তবে, এসব বাস্তবতা সত্ত্বেও পশ্চিমা মূলধারার সংবাদমাধ্যম যেমন—CNN, BBC, The New York Times, এবং অন্যান্য বড় প্ল্যাটফর্মগুলো দুর্ভিক্ষকে নিয়ে সরাসরি ভাষায় না গিয়ে ব্যবহার করছে ‘খাদ্য ঘাটতি’, ‘পুষ্টিহীনতা’ বা ‘মানবিক চ্যালেঞ্জ’-এর মতো শব্দ। এতে প্রশ্ন উঠছে—এই ভাষা কি কেবল সাংবাদিকতার নিরপেক্ষতা রক্ষার চেষ্টা, নাকি ইসরায়েলের প্রতি পক্ষপাতমূলক অবস্থান?

বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা কেবল শব্দ নির্বাচনের ব্যাপার নয়, বরং একটি কাঠামোগত পক্ষপাতের প্রতিফলন। আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা Refugees International-এর প্রেসিডেন্ট জেরেমি কোনইন্ডাইক এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “Famine শব্দটি শুধু একটি বর্ণনা নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা তৈরি করে। আর সেই দায় থেকে ইসরায়েলকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, মিডিয়ার মাধ্যমেই।”

২০২৪ সালের মার্চে Integrated Food Security Phase Classification (IPC) জানিয়েছিল, গাজার উত্তরাঞ্চল ও গাজা শহরে দুর্ভিক্ষ “প্রায় নিশ্চিত”—যা এপ্রিল-মে মাসের মধ্যেই বাস্তব রূপ নেবে। ২০২৫ সালের মে মাসে IPC পুনরায় জানায়, “গাজার সমগ্র জনগোষ্ঠী এখন মারাত্মক দুর্ভিক্ষ ঝুঁকিতে রয়েছে।”

তবুও পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের অনেকেই এই ঘোষণা সংবাদে ব্যবহার করলেও ‘famine’ শব্দটিকে শিরোনাম বা বুলেটিনে খুব কমই জায়গা দিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এর ফলে এই মানবিক বিপর্যয়ের তাৎপর্যও কমে যায় এবং জনমত গঠনের ক্ষেত্রে সত্য আড়াল হয়ে পড়ে।

এমনকি “পেশাগত ভারসাম্য” বজায় রাখার নামে অনেক প্রতিবেদনেই ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের মন্তব্যকে কেন্দ্র করে "দ্বিমত" তুলে ধরা হয়, অথচ এদের বক্তব্যকে কঠোরভাবে যাচাই বা পাল্টা প্রশ্ন করা হয় না। এতে করে এক ধরনের মেকি ভারসাম্যের আবরণে ইসরায়েলি অবস্থানকে বৈধতা দেওয়া হয়, আর ফিলিস্তিনি পক্ষের অভিযোগকে তুলে ধরা হয় ‘একটি মতামত’ হিসেবে।

তবে ব্যতিক্রমও আছে। যেমন, ২০২৫ সালের ৪ মে The Guardian-এর একটি সম্পাদকীয়তে স্পষ্ট করে বলা হয়—গাজায় খাদ্য ব্যবস্থাকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং এটি একটি “ইচ্ছাকৃত ক্ষুধানীতি”, যা যুদ্ধাপরাধের শামিল।

অধিকাংশ প্রতিবেদনে দেখা যায়, স্থানীয় গাজাবাসীর কণ্ঠকে গুরুত্ব না দিয়ে বরং আন্তর্জাতিক সংস্থা কিংবা পশ্চিমা বিশ্লেষকদের মাধ্যমে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। এতে করে ফিলিস্তিনিদের জীবন্ত অভিজ্ঞতা ও কষ্টগুলো সংখ্যায় পরিণত হয়, মানবিক বাস্তবতাকে ছাপিয়ে যায় ভাষার ধোঁয়াশা।

এমন পরিবেশে প্রশ্ন উঠেছে—যখন শিশুদের ক্ষুধামৃত্যু প্রমাণিত বাস্তবতা, তখন সাংবাদিকতা কি আর পক্ষপাতহীন? নাকি সত্যকে আবৃত করে রাখা হচ্ছে শব্দের পর্দায়?