যেসব কারণে দিল্লি ও ঢাকার সম্পর্ক কিছুতেই সহজ হচ্ছে না
মাত্র মাস তিনেক আগেও যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে দুই দেশের নেতা-মন্ত্রী-কর্মকর্তারা অহরহ ‘সোনালি অধ্যায়’ বলে বর্ণনা করতেন, সেই ঢাকা ও দিল্লির পারস্পরিক কূটনীতিতে এই মুহূর্তে একটা চরম অস্বস্তিকর শীতলতার পর্ব চলছে।
বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর ১০০ দিন অতিক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আজ পর্যন্ত তার মুখোমুখি দেখাই হয়ে ওঠেনি। সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনের অবকাশে এ রকম একটা বৈঠক আয়োজনের জন্য বাংলাদেশ অনুরোধও জানিয়েছিল, কিন্তু ভারত তা এড়িয়ে গিয়েছে।
দুই দেশের দুই বর্তমান নেতার মধ্যে এর মাঝে মাত্র একবারই টেলিফোনে কথা হয়েছে, কিন্তু ভারতের ভাষ্য অনুযায়ী সেখানেও প্রাধান্য পেয়েছে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের প্রসঙ্গ। সুতরাং সেই টেলিফোন আলাপেও ভারতের দিক থেকে স্পষ্টতই ছিল ‘নালিশ’ বা ‘অনুযোগে’র সুর।
গত ৮ অগাস্ট যেদিন ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন, সেদিনও এক্স হ্যান্ডলে তার প্রতি বার্তায় প্রধানমন্ত্রী মোদি ‘শুভেচ্ছা’ জানালেও দায়িত্ব গ্রহণের জন্য ‘অভিনন্দন’ জানাননি, কোনো কোনো পর্যবেক্ষক এটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন।
বস্তুত নিউ ইয়র্কে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত বৈঠক ছাড়া দুদেশের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ে এখনও কোনো ‘ইন্টারঅ্যাকশন’ই হয়নি। ভারতের হয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যাবতীয় আদান-প্রদান করছেন ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত প্রণয় কুমার ভার্মা, যা কূটনৈতিক সম্পর্ক ‘স্কেল ডাউন’ করারই ইঙ্গিত!
পাশাপাশি আরও কিছু ঘটনা গত তিন মাসে ঘটেছে, যা থেকে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে দিল্লি এখনও বাংলাদেশের নতুন সরকারকে ঠিকমতো ভরসাই করতে পারছে না। যেমন প্রায় মাস চারেক হতে চলল ভারত এখনও বাংলাদেশে তাদের ভিসা কার্যক্রম কার্যত বন্ধ রেখেছে।
খুব জরুরি কিছু মেডিক্যাল ভিসা ছাড়া বাংলাদেশি নাগরিকরা ভিসা পাচ্ছেন না বললেই চলে। আর ভারতও জানিয়ে দিয়েছে তারা যতক্ষণ না মনে করছে সে দেশে পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক’ হচ্ছে, ততক্ষণ আগের মতো ভিসা ইস্যু করারও কোনো সম্ভাবনা নেই।
তা ছাড়া কলকাতা ও ঢাকার মধ্যে চলাচলকারী ট্রেন মৈত্রী এক্সপ্রেসও গত ১৯ জুলাই থেকে বন্ধ রাখা হয়েছে। একই হাল খুলনা-কলকাতা বন্ধন এক্সপ্রেস বা ঢাকা-শিলিগুড়ি মিতালি এক্সপ্রেসেরও, যদিও বেশ কিছুদিন বিরতির মধ্যে দুদেশের মধ্যে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল অবশেষে শুরু হয়েছে।
বিদেশি নাগরিকদের পাসপোর্টে ভারতের ভিসার প্রতীকি ছবি
ভারতের বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশে যেসব অবকাঠামো প্রকল্পে কাজ করছিল, তারও অনেকগুলোর কাজ জুলাই-অগাস্ট থেকে থমকে গেছে, আজ পর্যন্ত তা শুরু করা যায়নি। আদানি পাওয়ার-সহ বিভিন্ন ভারতীয় সংস্থা বকেয়া অর্থ না পেয়ে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহও কমিয়ে দিয়েছে।
গত ১০০ দিনের ভেতর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশে বন্যার জল ছাড়ার অভিযোগ বা দুর্গাপুজোর মণ্ডপে হামলা নিয়ে একাধিক প্রকাশ্য বিবৃতি জারি করতেও দ্বিধা করেননি, যাতে বাংলাদেশ সরকারের সমালোচনা ছিল স্পষ্ট!
এই ধরনের জিনিস কিন্তু বিগত ষোলো-সতেরো বছরে কখনোই দেখা যায়নি, যা থেকে পরিষ্কার বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে একটা ‘ওয়ার্কিং রিলেশনশিপ’ বা কেজো সম্পর্ক গড়ে তুলতেও দিল্লি রীতিমতো দ্বিধান্বিত।
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তথা ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা অবশ্য এর মধ্যে বিশেষ অস্বাভাবিক কিছু দেখছেন না।
মালয়েশিয়া থেকে তিনি বলছিলেন, ‘সম্পর্ক তো একেবারে থেমে নেই, চলছে। দুপক্ষের মধ্যে কোনো অপ্রীতিকর আদান-প্রদান হয়নি, কেউ কাউকে আক্রমণাত্মক ভাষায় কথা বলেনি... এটাই কি যথেষ্ট নয়?’
‘আসলে এটা তো বুঝতে হবে বাংলাদেশে যে সরকার ক্ষমতায় আছে তারা কোনো স্থায়ী সরকার নয়। তাদের ম্যান্ডেট কিছু থাকলেও সেটা খুব ‘লিমিটেড’ যে সে দেশে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা। তো এরকম একটা সরকারের সঙ্গে ভারতের নির্বাচিত সরকারের এনগেজমেন্টটাও লিমিটেড হওয়াটাই খুব স্বাভাবিক’, যোগ করে বলেন শ্রিংলা।
তবে দুদেশের সরকারের মধ্যে সম্পর্কের পরিধি সীমিত থাকলেও ‘পিপল টু পিপল’ কানেক্ট বা মানুষে মানুষে সংযোগটা কিছুতেই বন্ধ করা উচিত নয় বলেই তার অভিমত।
‘দিল্লি ও ঢাকার মধ্যে যা-ই চলুক, এটা যেভাবে হোক বজায় রাখতে হবে’ বলছেন হর্ষবর্ধন শ্রিংলা।
অবশ্য গত ১০০ দিনে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক যে প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে, তা নিয়ে দিল্লিতে অন্তত পর্যবেক্ষকদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই, আর এর জন্য নির্দিষ্টভাবে কয়েকটি কারণকেও চিহ্নিত করছেন তারা।
শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দান
এই মুহূর্তে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের সম্পর্কের মধ্যে আর একটি খুব বড় অস্বস্তির উপাদান হলো ভারতের মাটিতে শেখ হাসিনার উপস্থিতি!
৫ অগাস্টের পর ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে একাধিকবার জানিয়েছে, সেদিন বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ভারতে ‘সাময়িক’ আশ্রয় চেয়েছিলেন বলেই তা মঞ্জুর করা হয়েছিল। অন্তত একবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এটাও উল্লেখ করেছেন, ‘সুরক্ষার কারণে’ তাকে এ দেশে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।
মূল কারণটা যা-ই হোক, বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে গত জুলাই-অগাস্ট মাসের গণঅভ্যুত্থান যার শাসনের বিরুদ্ধে ছিল, সেই শাসক নিজেই এখন প্রতিবেশী দেশের আশ্রয়ে ও আতিথেয়তায় রয়েছেন।
বহু পর্যবেক্ষক বিশ্বাস করেন, সেই অভ্যুত্থানের যেহেতু একটা ভারতবিরোধী মাত্রাও ছিল, কারণ ভারতের সমর্থন ছাড়া এভাবে শেখ হাসিনার পক্ষে এতদিন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা অসম্ভব হতো বলে আন্দোলনকারীরা ধারণা করতেন আর সেই ভারতই যখন শেষমেশ অপসারিত প্রধানমন্ত্রীকে আশ্রয় দিল, তাতে কূটনৈতিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস আরও জোরালো হয়েছে।
১০০ দিনের ওপর হলো শেখ হাসিনা ভারতে এসে রয়েছেন
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস নিজে ভারতের বার্তা সংস্থা পিটিআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ভারতের মাটিতে বসে শেখ হাসিনা যেন রাজনৈতিক বিবৃতি না দেন, ভারতকে সেটা খেয়াল রাখতে হবে।
ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও সম্প্রতি স্বীকার করেছে, শেখ হাসিনার মুখে লাগাম পরানোর কথা তারা একাধিকবার ভারতকে বলেছে কিন্তু তাতে তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
এর পাশাপাশি ‘গণহত্যা’র বিচারের জন্য শেখ হাসিনাকে যাতে বাংলাদেশে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়, সে জন্য তাকে ভারতের কাছে ফেরত চাওয়ার কথাও বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক উপদেষ্টা। দুদেশের মধ্যকার প্রত্যর্পণ চুক্তির কথাও তুলেছেন তাদের কেউ কেউ।
সম্ভবত এটা জেনেই, যে ভারত তাকে কখনোই বাংলাদেশের হাতে তুলে দেবে না, কিন্তু তাতে কূটনৈতিক সম্পর্কের যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে।
দিল্লিতে প্রথম সারির থিংকট্যাংক মনোহর পারিক্কর আইডিএসএর সিনিয়র ফেলো তথা বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ স্ম্রুতি পট্টনায়ক সেই প্রথম দিন থেকে বলে আসছেন, শেখ হাসিনাকে ভারতে না রাখলেই দিল্লির জন্য সেটা সবচেয়ে ভালো অপশন হতো!
তিনি বলছিলেন, ‘আমি এখনও মনে করি প্রথমেই শেখ হাসিনা যদি তৃতীয় কোনো দেশে চলে যেতে পারতেন, সেটা দিল্লির জন্য সেরা সমাধান হতো। হয়তো শেখ হাসিনার জন্যও! কিন্তু যেহেতু সেটা সম্ভব হয়নি এবং শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়ানো ছাড়া এখন ভারতের সামনে কোনও উপায় নেই, তাই এটার পরিণাম (কনসিকোয়েন্স) আমাদের এখন ভোগ করতেই হবে।’
এই পরিণামের একটা দিক হলো, ঢাকার নতুন সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক মূল্যে দাম চোকানো।
হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের ইস্যু
বিগত ১০০ দিন ধরে ভারত একেবারে সর্বোচ্চ স্তর থেকে লাগাতার বাংলাদেশের কাছে যে বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ জানিয়ে এসেছে, তা হলো সে দেশে হিন্দুসহ সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও অত্যাচারের ইস্যু।
প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজে একাধিকবার মুহাম্মদ ইউনূসকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, সে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সম্পূর্ণ সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব তার প্রশাসনের। শুধু তা-ই নয়, গ৩ ২৬ আগস্ট যখন তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন, তখনও বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের প্রসঙ্গটি তোলেন এবং কিছুক্ষণ বাদে বিরল এক পদক্ষেপে সে কথা টুইট করেও জানিয়ে দেন!
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও একের পর এক ব্রিফিং ও বিবৃতিতে বারবার বাংলাদেশ সরকারকে মনে করিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশে হিন্দুদেরও স্বাধীনভাবে ধর্মাচরণের অধিকার আছে এবং দুর্গাপুজোর সময় তাদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সে দেশের সরকারের।
কিন্তু ভারত সরকার ও ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির বিশ্বাস, এই গুরুতর বিষয়টিকে বাংলাদেশ সরকার হয় গুরুত্বই দিচ্ছে না, অথবা তারা পরিস্থিতি মোকাবিলায় চূড়ান্ত ব্যর্থ হচ্ছে!
বিজেপির পলিসি রিসার্চ সেলের অনির্বাণ গাঙ্গুলির কথায়, ‘আজকের বাংলাদেশ গড়ে তোলার পেছনে সে দেশের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানরাও যে ঘাম-রক্ত ঝরিয়েছেন, দেশ বিনির্মাণে তাদেরও যে বিরাট অবদান আছে, সেই সত্যিটাই যেন ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।’
বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব আরও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ৫ আগস্টের পর থেকে সে দেশের হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের তথ্য অনুসারেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর দুই হাজারের বেশি হামলার ঘটনা ঘটেছে।
জাতিসংঘের শীর্ষ মানবাধিকার কর্মকর্তা ভলকার টুর্ক পর্যন্ত বাংলাদেশ সফরে এসে এই পরিস্থিতির গুরুত্বের কথা স্বীকার করেছেন, আর ভাবী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তো এসব হামলাকে ‘বর্বরোচিত’ বলতেও বাকি রাখেননি।