চিকিৎসককে ধর্ষণ-হত্যা: ‘রাতের রাস্তা’ যেভাবে নারীর প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠছে
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কলকাতার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্ষোভে ফুঁসছে মানুষ। দোষীদের শাস্তি এবং নারীদের নিরাপত্তার দাবি জানিয়ে আন্দোলনে সামিল হয়েছেন বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। সামিল হয়েছে অন্য দেশের নাগরিক সমাজও। ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর থেকে বারেবারে রাস্তায় নেমেছে জনতা।
প্রতিবাদ জানিয়ে গর্জে ওঠার ঘটনা এই রাজ্যে নজিরবিহীন নয়। নতুন নয় কলেজ স্কোয়্যার, ধর্মতলা, অ্যাকাডেমি চত্বর বা অন্যান্য জায়গায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনতার জমায়েতও। মিছিলে, স্লোগানে এর আগেও মুখর হয়েছে রাজপথ। কিন্তু আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসককে খুন ও ঘটনার পর শুরু হওয়া এ আন্দোলন একটা ভিন্ন দিক তুলে ধরেছে। রাজনীতির ছোঁয়াচ বাঁচাতে মরিয়া মানুষ। তারা মরিয়া প্রতিবাদের আগুন জ্বালিয়ে রাখতেও।
রোববার বাকি প্রতিবাদীদের সঙ্গে কলকাতার রাস্তায় রাত জেগেছিলেন অঙ্কিতা পাল। যেমনটা জেগেছিলেন গত ১৪ আগস্ট ‘রাত দখলের কর্মসূচি’তে। তিনি বলেন, ‘আমরা বিচার চাই। আরজি করের ঘটনায় অভিযুক্তদের সকলের শাস্তি চাই। কিন্তু এই প্রতিবাদ তারপরেও চলবে যতদিন না এই রেপ কালচার বন্ধ হয়, ধর্ষকরা ভয় পায়। লোকে বুঝতে পারে আমার সম্মতির অর্থ, আমার স্বাধীনতার অর্থ।’
রোববার ছিল ‘আমরা তিলোত্তমা’ নামক একটি মঞ্চের কর্মসূচি। পহেলা সেপ্টেম্বর দুপুরে কলেজ স্কোয়্যার থেকে হেঁটে একটি মিছিল ধর্মতলায় আসে। কলকাতার শিল্পীদের ডাকা জমায়েতে সামিল হয়েছিলেন সাধারণ মানুষ। মিছিল শেষে প্রশাসনের কাছে তাদের দাবি জানিয়ে উত্তরের অপেক্ষায় রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে ধর্নায় বসেন তারা। ধর্না চলে সকাল পর্যন্ত, যদিও প্রশাসনের তরফে কোনও সদুত্তর মেলেনি।
তৃণাঙ্কুর দাশ নামে এক কলেজ পড়ুয়া বলেন, ‘এর আগে রাতের রাস্তায় মেয়েদের এমন নিশ্চিন্ত জমায়েত আগে দেখিনি। ১৪ আগস্ট রাত দখল আমাদের প্রথম সাহস জুটিয়েছিল। তারপর ধীরে ধীরে প্রতিবাদে রাত সামিল হচ্ছে। প্রতিবাদ কর্মসূচি কিন্তু এখন শুধু দিনের বেলাতেই আটকে নেই, রাতেও হচ্ছে।’
কয়েক সপ্তাহে রাতে মেয়েদের জমায়েত, গণ আদালতের ডাক-সহ একাধিক কর্মসূচির সাক্ষী থেকেছে এ রাজ্য। ৪ সেপ্টেম্বর আবার ‘রাত দখলের’ ডাক দেওয়া হয়েছে। তার পরদিনই সুপ্রিম কোর্টে এ মামলা সংক্রান্ত শুনানি হওয়ার কথা। রাতের রাস্তায় নিজেদের উপস্থিতি জানান দেওয়াই কী তাহলে প্রতিবাদের নতুন ভাষা হয়ে উঠছে?
এ প্রসঙ্গে সমাজকর্মী শবনম হাসমি বলেছেন, ‘রাত কিন্তু মেয়েদের নিরাপত্তার লড়াইয়ে প্রতীক হয়ে উঠছে। কারণ সে সময় রাস্তা-ঘাট জনশূন্য থাকে। শুধু রাস্তাই নয়, মেয়েদের সংখ্যা রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সর্বত্র কমতে থাকে। তাদের পরিখা হয়ে দাঁড়ায় নিজেদের বাড়ি এবং এই বিধিনিষেধ মেয়েদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘মেয়েদের যে বারবার বলে দেওয়া হয়, কখন, কোথায় থাকবে তার উপরে নির্ভর করবে তোমার নিরাপত্তা। তার স্বাধীনতাকে নজরদারিতে রাখা হয়, নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু প্রশাসন বা অবকাঠামোগত উন্নতির মাধ্যমে সেটাকে কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, সেটা দেখা হয় না। গণপরিসরে যতক্ষণ নারী এবং প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছি না, ততক্ষণ সমাজকে সুরক্ষিত পরিসর হিসাবে গড়ে তুলতে পারব না। সে জন্য শুধু একদিন রাস্তায় একদিন রাত জাগা নয়। দিনের পর দিন রাত জাগতে হবে, রাতের দখল আদায় করে নিতে হবে।’
সে কারণেই এই ‘অধিকার আদায়’ করে নিতেই কি রাতের রাজপথ নারী সুরক্ষার দাবিতে শুরু এই প্রতিবাদের ভাষা হয়ে দাঁড়াচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘রাত দখল সত্যিই আস্তে আস্তে প্রতিবাদ ও স্বাধীনতার ভাষা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। একটা ক্ষোভের জায়গা থেকে প্রথমবার রাত দখল করতে রাস্তায় নেমেছিল মানুষ, যে তাদের আর কত দমিয়ে রাখা হবে? আজ সেটাই প্রতিবাদের ভাষা। তাই একের পর এক কর্মসূচি রাতে হচ্ছে।’
পেশায় নার্স সুকন্যা গোস্বামীর মতে, মেয়েরা দিনের যে কোনও সময়ে সুরক্ষিত নন। কিন্তু তাও প্রতিবাদের জন্য রাতের সময়কে বেছে নেওয়ার পিছনে বিশেষ অর্থ আছে। তার ভাষ্য, ‘মেয়েরা কিন্তু ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কখনওই সুরক্ষিত নয়। ৯ আগস্ট আরজি কর হাসপাতালের ঘটনা ঘটার পর থেকে একাধিক যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে এবং সেটাও দিনের বেলায়।’
তিনি বলেন, ‘রাতকেই যে প্রতিবাদের ভাষা বলে বেছে নেওয়া হয়েছে, তার কারণ দু’টো। প্রথমত ওই চিকিৎসক তার কর্মক্ষেত্র হাসপাতালে রাতে সুরক্ষিত ছিলেন না, আর দ্বিতীয়ত মেয়েদের উপর চাপিয়ে দেওয়া নিয়মকানুন। ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি সন্ধ্যের আগে বাড়ি ফিরতে হয়।’
আরো পড়ুন: আরজি করে ধর্ষণ-হত্যার ঘটনায় ২৪ দিন পর গ্রেপ্তার অধ্যক্ষ সন্দ্বীপ
চিকিৎসককে খুনের ঘটনার পরপরই একটি বাংলা সংবাদমাধ্যমের জন্য কলম ধরেছিলেন শিক্ষিকা ও ফেমিনিস্ট অ্যাক্টিভিস্ট শতাব্দী দাশ। ডাক দিয়েছিলেন মেয়েদের রাত দখলের। যদিও সেখানে দিনক্ষণের উল্লেখ ছিল না। রিমঝিম সিনহা, শতাব্দী দাশ এবং তাদের মতো আরও কয়েকজন সমবেত হয়ে সমাজমাধ্যমে সেই বার্তা দেন। তারপর ১৪ আগস্টের ছবিটা সবার জানা।
১৯৭৭ ইংল্যান্ডের লিডস্ শহরে ‘রিক্লেম দ্য নাইট’ আন্দোলনের মতোই নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে ওই রাতে রাস্তায় নামেন নারীরা। নেমেছিলেন পুরুষরাও। শতাব্দী দাশ বলেন, ‘রাত আর রাস্তা এই দু’টো টাইম (সময়) আর স্পেসকে (স্থান) বোঝাচ্ছে। এই যে কিছু সময় ও স্থান বেঁধে দিয়ে বলা হয় এ সময়ে এ জায়গায় তুমি সুরক্ষিত। এর বাইরে তোমার দায়িত্ব নিচ্ছি না, এটা বন্ধ হওয়া দরকার। এই দৃষ্টিভঙ্গিটা পিতৃতান্ত্রিক এবং সেখান থেকেই রাত দখলের ভাবনাটা এসেছিল।’
রাত দখলের ডাকের এমন সাড়া পাবেন কল্পনা করেননি তিনি বা অন্যান্য আহবায়করা। রাতকে প্রতিবাদের ভাষা হিসাবে বেছে নেওয়ার অন্য একটা কারণও জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘একজন নারী তিনি রাতে হাসপাতালেই কর্মরত হন বা পার্টি করতেই যান, একজন নাগরিক হিসাবে তিনি সুরক্ষিত থাকবেন না কেন? আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমরা সমস্ত স্থান এবং কালকে রিক্লেম করছি সবার জন্য।’ খবর: বিবিসি বাংলা।