ভারতে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা কেমন?
সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লাগাতার কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে দেশের শিক্ষার্থীরা। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে শিরোনামে উঠে এসেছে সংরক্ষণ ব্যবস্থা- কখনও কোটা বিরোধী আন্দোলনের হাত ধরে আর কখনোবা বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে।
শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে আসন সংরক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন দেখা গিয়েছে ভারতের বিভিন্ন অংশে। কোটার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় ছাত্ররা বিক্ষোভও দেখিয়েছেন।
ভারতের ইতিহাসে সংরক্ষণ ব্যবস্থার উপস্থিতি দীর্ঘদিনের- সেই ব্রিটিশ আমল থেকে। ব্রিটিশ শাসিত ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাধীনতার আগে থেকেই সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। মূলত ব্রাহ্মণদের আধিপত্যের কারণে সে সময় অব্রাহ্মণ এবং অনগ্রসর শ্রেণির অনেক মানুষ বৈষম্যের শিকার ছিলেন।
সংরক্ষণের উদ্দেশ্য ছিল অব্রাহ্মণ এবং অন্যান্য যে সমস্ত শ্রেণি বর্ণ বৈষম্য এবং জাতিভেদের শিকার, তাদের অগ্রসর হওয়ার পথ সুগম করা। ভারতের স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিমার্জনার মধ্যে দিয়ে গিয়ে বর্তমানের সংরক্ষণ ব্যবস্থা এসে দাঁড়িয়েছে। তবে এই দীর্ঘ ইতিহাসে রাজনৈতিক ছোঁয়া বা বিতর্ক দুটিরই আঁচ লেগেছে সংরক্ষণ ব্যবস্থার উপরে।
বর্ষীয়ান শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার বলেন, ‘ভারতে সংরক্ষণ চালু করা হয় যারা সামাজিকভাবে দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন যেমন- দলিত, অনগ্রসর জাতি, তফসিলি জাতি ও উপজাতি এবং নারীরা। মূলত পিছিয়ে পড়া মানুষদের অগ্রগতির কথা ভেবে এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল।’ কিন্তু কখনও কখনও রাজনীতিতে নির্দিষ্ট একটি শ্রেণির মানুষকে ‘তোষণ’বা ‘বিরোধিতা’ করতে বারে বারে ব্যবহার করা হয়েছে কোটাকে।
“রাজনীতির সঙ্গে সংরক্ষণের সম্পর্ক প্রাক-স্বাধীনতার যুগ থেকে আর আধুনিক সময়ে ভোটের রাজনীতিতে বরাবরই একটা বড় ইস্যু হিসাবে থেকেছে এটি,” বলেছেন সিনিয়র সাংবাদিক এবং গবেষক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য।
ভারতীয় সংবিধান কী বলছে?
ভারতের সংবিধান অনুচ্ছেদ ১৫ (৪) বলছে - ‘কোনো কিছুই সামাজিকভাবে এবং শিক্ষাগতভাবে পিছিয়ে পড়া তফসিলি জাতি এবং উপজাতি শ্রেণির নাগরিকদের অগ্রগতির জন্য কোনও বিশেষ বিধান করতে রাষ্ট্রকে বাধা দেবে না।’
সংবিধানের ৪৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে ‘রাষ্ট্র বিশেষ যত্ন সহকারে অনগ্রসর অংশের শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রচার করবে, এবং বিশেষত, তফশিলি জাতি এবং উপজাতির নাগরিকদের সামাজিক অবিচার এবং সব ধরনের শোষণ থেকে রক্ষা করবে।’
তফশিলি জাতি এবং উপজাতি মানুষেরা আর্থসামাজিক দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া বর্গ। শিক্ষা, অর্থ এবং সামাজিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষদের সমষ্টিগতভাবে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মধ্যে ধরা হয়।
সংবিধানের ১৫(৪) ও ১৬(৪) ধারায় প্রাথমিকভাবে বলা হয়েছিল যে, সংরক্ষণের সীমা কখনোই ৫০ শতাংশ ছাড়াবে না। তবে তা সংশোধিত হয়েছে। সেই সংশোধন অনুযায়ী, রাজ্য সরকার অনগ্রসর শ্রেণির সামাজিক অগ্রগতির কথা ভেবে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে পারে।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ও রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেও বলা হয়েছে, কোনও রাজ্য চাইলে ৫০ শতাংশের বেশি সংরক্ষণ দিতে পারে। তবে তা হতে হবে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যার ভিত্তিতে। কিন্তু কেন্দ্রীয় স্তরে সে সুযোগ এখনও পর্যন্ত নেই।
তামিলনাডুতে ৬৯ শতাংশ, তেলেঙ্গনায় ৬২ শতাংশ এবং মহারাষ্ট্রে চাকরির ক্ষেত্রে অনগ্রসর শ্রেণির প্রার্থীদের জন্য ৫২ শতাংশ কোটা আছে। অন্যান্য অনেক রাজ্য সরকার ৫০% এর বেশি কোটা রেখেছে।
এর মধ্যে তামিলনাড়ুতে পিছিয়ে থাকা শ্রেণির মধ্যে ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস এবং সর্বাধিক পিছিয়ে থাকা শ্রেণি বা মোস্ট ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসের জন্য ৫০ শতাংশ কোটা আছে। আর তফসিলি জাতি ও উপজাতি মিলিয়ে ১৯% কোটা আছে।
তামিলনাড়ুর সর্বশেষ (২০১৮-১৯ সালের) হাউসহোল্ড প্যানেল সমীক্ষা অনুযায়ী রাজ্যটির মোট জনসংখ্যার ৪৫.৫% পিছিয়ে পড়া শ্রেণি এবং ২৩.৬% সর্বাধিক অনগ্রসর শ্রেণির মানুষ।
অভিযোগ এর মধ্যে, কয়েকটি রাজ্যে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির আওতায় মুসলিমদের বিশেষ সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। বিজেপির অভিযোগ, ভোটব্যাঙ্কের দিকে তাকিয়ে এই ‘তোষণের রাজনীতি’। এ নিয়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তোপ দাগতেও ছাড়েনি তারা। প্রসঙ্গত, ওই রাজ্যের তালিকায় পশ্চিমবঙ্গও রয়েছে।
সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে
সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে (সরাসরি নিয়োগ) সর্বভারতীয় উন্মুক্ত বিভাগে প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থায় তফসিলি জাতি ও উপজাতির জন্য ১৫% ও ৭.৫% কোটা এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্যে ২৭% কোটার কথা বলা হয়েছে।
উন্মুক্ত বিভাগ নয়, এমন সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে তফসিলি জাতি ও উপজাতির জন্য ১৬.৬৬%, ও ৭.৫% এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্য ২৫.৮৪% কোটা আছে।
সরকারি চাকরিতে গ্রুপ সি এবং গ্রুপ ডি কর্মীর নিয়োগের ক্ষেত্রে মূলত স্থানীয় বা আঞ্চলিক প্রার্থীরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আবেদন জানিয়ে থাকেন। তাই সংশ্লিষ্ট রাজ্য বা কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে বসবাসকারী তফসিলি জাতি ও উপজাতির সংখ্যার উপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট করা হয়ে থাকে। অন্যান্য অনগ্রসর গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সংরক্ষণ করা হয় ২৭%।
সরকারি চাকরিতে পদন্নোতির ক্ষেত্রেও (নন সিলেকশন মেথড) সংরক্ষণ রয়েছে। গ্রুপ এ, বি, সি, ডি সব ক্ষেত্রেই তফসিলি জাতির জন্য ১৫% এবং তফসিলি উপজাতির জন্য ৭.৫% কোটা আছে।
বয়সের ঊর্ধ্বসীমার ক্ষেত্রেও সরকারি চাকরিতে তফসিলি জাতি ও উপজাতির প্রার্থীদের বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়ে থাকে।
নিয়োগের সময় নারীদের বিশেষ প্রাধান্যের কথাও বলা হয়েছে। সেই নিয়ম মেনে ৩৩% সংরক্ষণ সহ তফসিলি জাতি, উপজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্য যে সংরক্ষিত বিভাগ রয়েছে সেখানে নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও চাকরিতে আসন এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রে সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে।
ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য চাকরি ও শিক্ষাক্ষেত্রে ১% আসন সংরক্ষণ করেছে কর্ণাটক। চলতি বছরে কলকাতা হাইকোর্টের একটি নির্দেশিকায় পশ্চিমবঙ্গে ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য চাকরিতে ১% কোটার কথা বলা হয়েছে।
মণ্ডল কমিশন
ভারতে সংরক্ষণের বিষয়ে কথা বলতে গেলে মণ্ডল কমিশনের প্রসঙ্গ আসতে বাধ্য। জাতিগত বৈষম্য নিরসনের জন্য আসন সংরক্ষণের প্রশ্ন বিবেচনা করার জন্য ১৯৭৯ সালে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয় তৎকালীন মোরারজি দেশাই সরকার।
সামাজিক বা শিক্ষাগতভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণিগুলো চিহ্নিত করার জন্য মণ্ডল কমিশন গঠন করা হয়, যার সভাপতিত্ব করেন বি পি মণ্ডল। অনগ্রসরতা নির্ধারণের জন্য এগারোটি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত সূচক ব্যবহার করা হয়েছিল।
১৯৮০ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির কাছে তার রিপোর্ট পেশ করে মণ্ডল কমিশন। সেখানে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মানুষের জন্য ২৭% সংরক্ষণ কোটার সুপারিশ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ভি পি সিং ১৯৯০ সালের আগস্টে সুপারিশগুলো কার্যকর করেন।
সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণ চালু করার প্রসঙ্গে ভারতে তীব্র প্রতিবাদ দেখা দেয়। ‘ঐতিহাসিকভাবে হয়ে আসা অন্যায় সংশোধন’ করতে নির্দিষ্ট জাতিকে সরকারি চাকরি দেওয়ার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখান বহু মানুষ।
ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে এই সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলন। সংরক্ষণের বিরোধিতা করতে গিয়ে আত্মাহুতি দেওয়ার চেষ্টা করেন অনেক ছাত্র, এদের মধ্যে অনেকের মৃত্যুও হয়।
এই ক্ষোভ প্রশমিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত জনতা দল পার্টির ভারতের প্রধানমন্ত্রী ভি পি সিংকে পদত্যাগও করতে হয়।
ছবির ক্যাপশান,ফাইল ছবি- শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণ নিয়ে বিতর্ক বহুদিনের।
সাম্প্রতিক সময়ে এ নিয়ে বিতর্ক সাম্প্রতিক লোকসভা ভোটেও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির আওতায় মুসলিম সম্প্রদায়কে বিশেষ সুযোগ দেওয়ার ইস্যু নিয়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল বিজেপি।
অন্যদিকে গত মে মাসে কলকাতা হাইকোর্ট তার রায়ে ২০১০ সালের পর থেকে জারি করা রাজ্যের সমস্ত 'অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি' বা ওবিসি সার্টিফিকেট বাতিল করে দিয়েছে।
অভিযোগ নিয়ম বহির্ভূতভাবে জারি করা হয়েছিল ওই শংসাপত্র। এর ফলে বাতিল হয়ে যায় পাঁচ লক্ষ ওবিসি সার্টিফিকেট। এই তালিকায় রয়েছে মোট ৭৭টি শ্রেণিকে দেওয়া অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির (ওবিসি) শংসাপত্র, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন মুসলিম।
তবে ইতোমধ্যে ওই শংসাপত্র দেখিয়ে যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছেন, চাকরি পেয়েছেন, ইন্টারভিউ-এর প্যানেলে রয়েছেন বা পদোন্নতি হয়েছে, তাদের উপর কোনো রকম প্রভাব পড়বে না বলে জানানো হয়েছিল।
তবে ওই শংসাপত্র দেখিয়ে রায়ের পর কেউ কোনও রকম সুবিধা পাবেন না, তা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে।
রাজ্য সরকারের তীব্র সমালোচনা করে আদালত জানিয়েছে, মূলত 'নির্বাচনি মুনাফার' জন্য ওই ৭৭টি শ্রেণিকে ওবিসি তালিকায় যোগ করা হয়েছিল। যা শুধুমাত্র সংবিধানের লঙ্ঘনই নয়, মুসলিমদের অবমাননাও।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
রাজনৈতিক ছোঁয়া আর বিতর্ক বরাবরই সঙ্গী থেকেছে ভারতের সংরক্ষণ ব্যবস্থা বা কোটা প্রথার। তবে এখানে শুধুমাত্র রাজনীতি নয়, শোষণ এবং বর্ণ বৈষম্যের মতো একাধিক বিষয়ও ছিল।
আঠেরোশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকেই ব্রাহ্মণদের আধিপত্যের কারণে অব্রাহ্মণ এবং অনগ্রসর শ্রেণির 'দুরবস্থার' কথা প্রকাশ্যে এনে সংরক্ষণ শুরু হয়েছিল।
কোলাপুরের রাজা ছত্রপতি শাহু অব্রাহ্মণ ও অনগ্রসর শ্রেণির জন্য সংরক্ষণ চালু করেছিলেন, যার বেশিরভাগই ১৯০২ সালে কার্যকর হয়েছিল। সেখানে শিক্ষা, চাকরির সুযোগসহ একাধিক বিষয়ে অনগ্রসর শ্রেণির জন্য সংরক্ষণের কথা বলা হয়।
১৯১৮ সালে প্রশাসনে ব্রাহ্মণ আধিপত্যের সমালোচনার পর মহীশূর রাজা নলভাদি কৃষ্ণরাজ ওয়াদিয়ার সরকারি চাকরি ও শিক্ষায় অব্রাহ্মণদের জন্য সংরক্ষণ বাস্তবায়নের জন্য একটি কমিটি তৈরি করেছিলেন। এমন আরওঅনেক নজর রয়েছে ভারতের ইতিহাসে।
“মহারাষ্ট্রে জ্যোতিরাও গোবিন্দরাও ফুলে ও তার স্ত্রী যে স্কুল চালাতেন সেগুলো ব্রাহ্মণ বিরোধী শুধু নয়, মারাঠা বিরোধীও ছিল। একইসঙ্গে মিশনারিদের পক্ষে। ফুলে দম্পতি দেখিয়েছিলেন, সে সময় মারাঠা ও ব্রাহ্মণদের আধিপত্য ছিল এবং তারা দলিতদের পায়ের নিচে রাখতে চায়। মিশনারিদের হাত ধরেই দলিতদের শিক্ষার সুযোগ হয়েছে,” বলেছেন গবেষক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য।
আধুনিক রাজনীতির ইতিহাসেও সংরক্ষণের প্রসঙ্গের সঙ্গে রাজনীতি এবং বিতর্ক বারে বারে জুড়েছে।
“উচ্চবর্ণের হিন্দু এবং বাকি হিন্দুদের মধ্যে এই বিরোধ অন্তত দেড়শ বছরের। তার আগে দলিতদের মধ্যে এবং পরে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মানুষের মধ্যে বঞ্চনা নিয়ে একটু একটু করে ক্ষোভ জমতে দেখা যায়। মণ্ডল কমিশন আসার পর এই পুরো সমীকরণটা বদলে যায়।কারণ চাকরি, শিক্ষা এবং অন্যান্য জায়গায় উচ্চবর্ণের হিন্দুরাই সবচেয়ে বেশি,” বলেছেন তিনি।
সংরক্ষণের বিষয়ে সাম্প্রতিক আলাপ-আলোচনা বা বিতর্ক- দুই ক্ষেত্রেই যে ‘যুক্তি’ বারে বারে উঠে এসেছে তা হলো, সংরক্ষণের পরিবর্তে যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্বাচন হোক।
এই প্রসঙ্গে মি. ভট্টাচার্য মনে করেন, “আসলে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা কখনোই চায় না, সংরক্ষণ থাক। তারা বলে, যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্বাচন হোক। কিন্তু প্রশ্ন হলো ঐতিহাসিকভাবে যে অন্যায় করা হয়েছে সেটি। প্রশ্নটা হলো, সেই ঐতিহাসিক ভুলকে সংশোধন করার।”
তার কথায়, “হিন্দু কাস্ট সিস্টেম সমাজকে ধারাবাহিকভাবে বিভাজিত করেছে। সমাজের একটা বড় অংশকে উঠতে দেয়নি, সেই জাত্যাভিমানকে আজও তারা বয়ে নিয়ে চলে, নীচু শ্রেণির হিন্দুকে তারা মানুষ বলে মনে করে না তা বাস্তব জীবনের উদাহরণ থেকে আমরা সবাই বুঝতে পারছি। সেই পরিস্থিতিতে ভারতে সংরক্ষণের উপস্থিতি খুবই উল্লেখযোগ্য।”
এ প্রসঙ্গে তার মত প্রকাশ করেছেন শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার। তিনি বলেন, “আসলে রাজনীতি সব আঙিনাতেই ঢুকে পড়ে। সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও তা হয়েছে। আর রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে ঢুকেছে দুর্নীতি। রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় জাল শংসাপত্র বানিয়ে যারা এই সুবিধা পেতে পারেন না, তারাও এর সুযোগ নিচ্ছেন। এই দুর্নীতির জায়গাটা বন্ধ হওয়া উচিৎ। যারা সত্যিই পিছিয়ে পড়া শ্রেণির রয়েছেন তারা আমার মতে এই সংরক্ষণ পেতে পারেন।”
কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরেও কেন সবাইকে একসারিতে আনা গেল না, এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “এটা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক যে আমরা স্বাধীনতার এত বছর পরেও যাদের অগ্রগতির জন্যে এই সুযোগ সুবিধা তাদের সবাইকে একসঙ্গে সামনে আনতে পারিনি। তা না হলে আমাদের দেশে এখনও এত নিরক্ষর মানুষ থাকেন! এটা কোথাও একটা গিয়ে আমাদের না পারার খতিয়ান।”
একইসঙ্গে অন্য একটি দিক তুলে ধরেছেন ভট্টাচার্য। “আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সংরক্ষণ নিয়ে বড়সড় রাজনৈতিক মতানৈক্য দেখা যাবে কারণ রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস এবং অন্যান্য সহযোগী দল অন্যান্য অনগ্রসর জাতির সংরক্ষণ নিয়ে চাপ দিতে থাকবে। আর এই চাপ নেওয়া বিজেপির পক্ষে নেওয়া সমস্যার। কারণ বিজেপির মূল সমর্থক উচ্চ বর্ণের এবং তারা এই সংরক্ষণের বিরুদ্ধে। আর দ্বিতীয় বিষয় হলো সংঘপরিবার আদর্শগতভাবে এর বিরোধী,” যোগ করেন তিনি। [সূত্র: বিবিসি বাংলা]