ভারতে যেভাবে মুসলিম বিরোধী বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ছে
ভারতে ২০২৩ সালে প্রতিদিন গড়ে প্রায় দুটি মুসলিম বিদ্বেষী বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের ঘটনা ঘটেছে এবং এই ঘটনার প্রতি চারটির মধ্যে তিনটি বা ৭৫ শতাংশ ঘটনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি শাসিত রাজ্যগুলোতে ঘটেছে। সোমবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উঠে আসে এসব তথ্য।
২০২৩ সালে ওয়াশিংটন ডিসি ভিত্তিক গবেষণা গোষ্ঠী ইন্ডিয়া হ্যাট ল্যাব (আইএইচএল) দ্বারা প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুসারে চারটি প্রধান রাজ্যে রাজনৈতিক প্রচারণা এবং ভোটগ্রহণের সময়—আগস্ট থেকে নভেম্বরের মধ্যে ঘৃণামূলক বক্তব্যের ঘটনা ছিল সবচেয়ে বেশি।
আইএইচএল দ্বারা নথিভুক্ত ঘৃণাত্মক বক্তৃতার ঘটনার এক তৃতীয়াংশ দুটি সংগঠন—বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) এবং বজরং দল দ্বারা সংগঠিত হয়েছিল। যা বিজেপির আদর্শিক পরামর্শদাতা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এর সাথে যুক্ত। ২০১৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ভিএইচপি এবং বজরং দলকে “ধর্মীয় জঙ্গি সংগঠন” হিসেবে ট্যাগ দিয়েছিল।
চলতি বছরেই ভারতের জাতীয় নির্বাচন—ঠিক তার আগেই আইএইচএল সারা দেশে মুসলিম বিরোধী বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের বিস্তারকে সামনে রেখে এমন সময় রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। রিপোর্টে মোট ৬৬৮টি ঘৃণামূলক বক্তব্যের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে।
ভারতীয় সরকার গত মাসে বিতর্কিত তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) আইন ২০০০ এর অধীনে ইন্ডিয়া হ্যাট ল্যাবের ওয়েবসাইটটি ভারতে বন্ধ করে দেয়। একই সাথে সরকার হ্যাট ল্যাব কর্তৃক পরিচালিত হিন্দুত্ব ওয়াচ-এর ওয়েবসাইটও ব্লক করে দেয়—যা ছিল একটি স্বাধীন হেট ক্রাইম ট্র্যাকার।
প্রথমবার কোনো গবেষণা গোষ্ঠী ভারতের এক বছরের মধ্যে ঘৃণাত্মক বক্তব্যের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। এর সাথে এই ঘটনাগুলো কীভাবে ভৌগোলিকভাবে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে, ঘটনার পিছনে হোতা কে এবং কখন ঘটে তার বিস্তারিত তথ্য অনর্ভূক্ত করে এই নথিতে।
ছবি: আল-জাজিরা
ভারতের বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের কেন্দ্র:
ইন্ডিয়া হ্যাট ল্যাব সংস্থাটি ভারতের ১৮টি রাজ্য এবং তিনটি ফেডারেল শাসিত অঞ্চল জুড়ে মোট ৬৬৮টি ঘৃণামূলক বক্তব্যের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ঘটনা ঘটে; ১১৮টি ঘটে পশ্চিমের মহারাষ্ট্রে, ১০৪টি ঘটে উত্তর প্রদেশে এবং ৬৫টি ঘটে মধ্য ভারতের মধ্য প্রদেশে।
এই তিনটি রাজ্যকে বিজেপির বৃহত্তম ঘাঁটি হিসেবে ধরা হয়। ২০২৩ সালের রেকর্ড অনুযায়ী মোট ঘৃণামূলক বক্তব্যের ৪৩ শতাংশের জন্য সম্মিলিতভাবে দায়ী এ রাজ্যগুলো। তবে উত্তর ভারতের হরিয়ানা এবং উত্তরাখণ্ডের মতো অপেক্ষাকৃত ছোট রাজ্যগুলোও এর থেকে দায়মুক্ত নয়।
অন্তররাষ্ট্রীয় হিন্দু পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান সভাপতি প্রবীণ তোগাদিয়া ২০ নভেম্বর হরিয়ানায় একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন: “আজ ইসরায়েলের পালা। সেই একই ফিলিস্তিন আমাদের গ্রামে ও রাস্তায় উঠছে। তাদের হাত থেকে আমাদের সমৃদ্ধি, আমাদের নারীদের বাঁচানো আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।”
হরিয়ানা প্রদেশে ৪৮টি ঘৃণাত্মক বক্তব্যের ঘটনা প্রত্যক্ষ কর হয়েছে—যা প্রায় ৭.২ শতাংশ। উত্তরাখণ্ডে তার ৬ শতাংশ ঘটনা ঘটেছে। উভয় রাজ্যই মুসলিম বিরোধী সহিংসতার জন্য উদীয়মান স্থান হিসেবে রয়েছে।
২০২৩ সালের আগস্টে হরিয়ানার নুহ অঞ্চলে সহিংসতায় সাতজন মারা যায় এবং ৭০ জনেরও বেশি আহত হয়। এই মাসের শুরুর দিকে উত্তরাখণ্ডের হলদওয়ানি শহরে একটি মসজিদ এবং একটি ধর্মীয় বিদ্যালয় ধ্বংসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে পাঁচজন মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছিল।
বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র প্রেম শুক্লা আইএইচএল এর রিপোর্টের ঘটনায় এক ফোনালাপে আল-জাজিরাকে বলেছেন, দলটি “ইসলামী মৌলবাদী শক্তির” বিরোধিতা করছে এবং তিনি অভিযোগ করেন যে এই রিপোর্টে আইএইচএল এক পাক্ষিক চিত্র উপস্থাপন করেছে।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, অন্যান্য তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলো ঘৃণাত্মক বক্তৃতা দ্বারা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়কে টার্গেট করছে। কিন্তু কেউ এটি সম্পর্কে কথা বলবে না। তিনি আইএইচএল রিপোর্টকে প্রত্যাখ্যান করে বলেন—বিজেপিকে ধ্বংস করার শপথ নিয়েছে যারা তারা এর পিছনে রয়েছে।
কে সবচেয়ে ঘৃণামূলক বক্তব্য দিয়ে রাজ্য শাসন করে?
রিপোর্ট অনুসারে ৪৯৮টি ঘৃণাত্মক বক্তব্যের ঘটনা ঘটে—যার মধ্যে ৭৫ শতাংশ বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে বা কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে কার্যকরভাবে শাসন করে এমন অঞ্চলগুলোতে সংঘটিত হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি ঘৃণাত্মক বক্তব্যের ঘটনা সহ ১০টি রাজ্যের মধ্যে ছয়টি বছরজুড়ে বিজেপি শাসিত ছিল।
৭৭ শতাংশেরও বেশি বক্তৃতা যেখানে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সরাসরি সহিংসতার আহ্বান রয়েছে যা বিজেপি শাসিত রাজ্য ও অঞ্চলগুলোতেও দেওয়া হয়েছিল।
আইএইচএল দ্বারা নথিভুক্ত ঘৃণাত্মক বক্তৃতার ঘটনার এক তৃতীয়াংশ দুটি সংগঠন—বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) এবং বজরং দল দ্বারা সংগঠিত হয়েছিল। যা বিজেপির আদর্শিক পরামর্শদাতা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এর সাথে যুক্ত। ২০১৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ভিএইচপি এবং বজরং দলকে “ধর্মীয় জঙ্গি সংগঠন” হিসেবে ট্যাগ দিয়েছিল।
“আমাদের বিশ্লেষণ দেখায় যে মুসলিম বিরোধী বিদ্বেষমূলক বক্তব্যকে স্বাভাবিক করা হয়েছে এবং ভারতের সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রের অংশ হয়ে উঠেছে” বলেছেন আইএইচএলের প্রতিষ্ঠাতা রকিব হামিদ নায়েক। তিনি ভোটারদের মেরুকরণের জন্য আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম বিরোধী বিদ্বেষের ব্যাপক ব্যবহারের পূর্বাভাস দেন।
আইএইচএলের প্রতিবেদনটিতে নথিভুক্ত মোট ৬৬৮টি ঘৃণাত্মক বক্তব্যের মধ্যে ৬৩ শতাংশই ইসলামফোবিক ষড়যন্ত্রকে ইঙ্গিত করছে। ৪৮ শতাংশেরও বেশি ঘটনা ভারতের রাজ্য নির্বাচনে আগস্ট থেকে নভেম্বরে মধ্যে ঘটেছে।
আইএইচএল রিপোর্টে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও ঘৃণার আহ্বান জানিয়ে বক্তৃতা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়ার বোর্ডের চেয়ারম্যান আকার প্যাটেল আল জাজিরাকে বলেছেন, “এ ধরনের বক্তৃতার মোকাবেলা করতে, বৈষম্য নির্মূল করতে এবং বৃহত্তর সমতা বৃদ্ধির জন্য দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।”
মূলত ভারতে জাতীয় নির্বাচনের আগে ঘৃণাত্মক বক্তৃতার ঘটনাগুলো সমগ্র ভারত জুড়ে মুসলিম বিরোধী বিদ্বেষ জাগাতে ব্যবহৃত হয়।
ছবি: আল-জাজিরা
ভারতীয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে সর্বশেষ ঘৃণার অস্ত্র:
৭ অক্টোবর থেকে ভারতীয় ডানপন্থী দলগুলো দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের আক্রমণ এবং গাজায় ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধকে ভারতবিরোধী মুসলিম ভয় ও ঘৃণা জাগানোর জন্য অস্ত্র তৈরি করছে।
৭ অক্টোবর থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত প্রতি পাঁচটি ঘৃণামূলক বক্তৃতার মধ্যে একটি ইজরায়েলের যুদ্ধ কেন্দ্রিক হয়েছিলে। যা নভেম্বর মাসে সবচেয়ে বেশি ছিল। আইএইচএল রিপোর্ট অনুসারে।
অন্তররাষ্ট্রীয় হিন্দু পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান সভাপতি প্রবীণ তোগাদিয়া ২০ নভেম্বর হরিয়ানায় একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন: “আজ ইসরায়েলের পালা। সেই একই ফিলিস্তিন আমাদের গ্রামে ও রাস্তায় উঠছে। তাদের হাত থেকে আমাদের সমৃদ্ধি, আমাদের নারীদের বাঁচানো আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।”
একই মাসে, কপিল মিশ্র, একজন বিজেপি নেতা, বলেছিলেন: “ইসরায়েল যার মুখোমুখি হয়েছে আমরা ১৪০০ বছর ধরে তার মুখোমুখি হচ্ছি।”
অন্যান্য বিশ্লেষকরা দেখেছেন যে ভারতও ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের বিষয়ে ভুল তথ্যের কেন্দ্রস্থল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। [সূত্র: আল-জাজিরা]