নিশ্চিত মৃত্যু থেকে যেভাবে বেঁচে ফিরেন আয়রন ডোম হ্যাক করা ওমর
তুরস্কের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এমআইটি) ওমর এ. নামের এক কম্পিউটার বিজ্ঞানীকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে। প্রতিভাবান এ তরুণ ইসরায়েলি ডিফেন্স সিস্টেম আয়রন ডোম হ্যাক করতে সফল হয়েছিল। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ অনেকবার তাকে অপহরণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। সর্বশেষ মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর থেকে অপহরণ করে নিয়ে গেলে তাঁকে উদ্ধার করে এমআইটি।
ওমর এ. নামের এ তরুণকে ২০১৬ সাল থেকে খুঁজছে মোসাদ। ২০১৫ সালে আয়রন ডোম হ্যাক করে হামাসকে তথ্য দিলে হামাসের আল কাসসাম বিগ্রেড ইসরাইলে রকেট হামলা করার সুযোগ পান। মোসাদ ২০১৬ সালের দিকে জানতে পারে তাদের সিস্টেমটি হ্যাক করে ওমর। তারপর থেকেই তাঁকে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে তারা।
২০১৫ সালে আয়রন ডোম হ্যাক করে হামাসকে তথ্য দিলে হামাসের আল কাসসাম বিগ্রেড ইসরাইলে রকেট হামলা করার সুযোগ পায়। মোসাদ ২০১৬ সালের দিকে জানতে পারে তাদের সিস্টেমটি হ্যাক করে ওমর। তার পর থেকেই তাঁকে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে তারা।
গাজা ইসলামিক ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেন ওমর। ফিলিস্তিনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন্য ওমর একটি হ্যাকিং সফটওয়্যার প্রোগ্রাম করেন। যা দিয়ে যেকোনো অ্যান্ড্রয়েড ফোনে অনুপ্রবেশ করা যায়। এরপর থেকেই মূলত মোসাদ তাঁকে পেতে মরিয়া হয়ে উঠে।
২০২০ সালে ওমর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে চলে যায়, মোসাদ সেখানেও তাঁর পিছু নেয়। যদিও তুরস্কের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এমআইটি ওমরের সম্পর্কে আগে থেকেই খবর নিয়ে তাঁকে সচেতন করেছিল এবং তাদের নজরে রেখেছিল।
এমআইটি হেডকোয়াটার, আঙ্কারা
২০২১ সালের এপ্রিলে ফ্রান্সের একটি কোম্পানির এইচআর ম্যানেজার পরিচয়ে রায়েদ গাজাল নামের এক মোসাদ এজেন্ট ওমরের সাথে যোগাযোগ করে। দু’বার ইন্টারভিউ নিয়ে তাকে বিভিন্নভাবে তাঁদের কোম্পানিতে নেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ওমর তাতে রাজি হয়নি।
পরে গাজালের সাথে অন্য এক মোসাদ এজেন্টসহ ওমর সালাবি নামের আরেকজন আবার দেখা করে। পরে তাঁকে তাদের কোম্পানিতে জন্য ১০ হাজার ডলার দেয়ার প্রস্তাবে একটি সফটওয়্যার কোডিং করে দিতে বলে। ওমর তাদের কাজটি করে দেয়। পরে তারা তাঁকে কথা মত অর্থও দেয়।
আরও পড়ুন: ফ্রি ওয়াইফাই ব্যবহারে সতর্ক না হলে চুরি হতে পারে ব্যক্তিগত তথ্য
২০২২ সালের জুনে আবার নিকোলো রাদোনজি নাম দিয়ে এক মোসাদ এজেন্ট ওমরের সাথে যোগাযোগ করে। আর তাঁকে তাদের কোম্পানিতে ব্রাজিল অথবা ইস্তাম্বুলে চাকরির প্রস্তাব দেয়। ওমরের যাতে সন্দেহ না হয় তাই আরও তিনজন এজেন্টকে তাদের ডেভেলপার টিমের সদস্য পরিচয় দিয়ে তাঁর বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা করে। তারা তাঁকে তাদের অনলাইন প্রজেক্ট টিমে নেয়ার জন্য বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখায়।
রাদোনজি বিভিন্নভাবে ওমরকে বিদেশে ভ্রমণের জন্য রাজি করানোর চেষ্টা করে। মোসাদের মূল লক্ষ্য ছিল তাঁকে কোনভাবে তুরস্ক থেকে বের করে তেল আবিবে নিয়ে যাওয়া। তাদের প্রস্তাবে প্রায় রাজি হয়ে গিয়েছিল ওমর। কিন্তু শেষে এমআইটি ওমরের সাথে যোগাযোগ করে এবং তাঁকে মোসাদের পরিকল্পনার ব্যাপারে সতর্ক করে।
কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্ট থেকে ওমরকে অপহরণ করে রাজধানী থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে একটি ক্যাবিনে নিয়ে যাওয়া হয়। মালয়েশিয়ায় মোসাদের এজেন্টরা তাঁকে সেখানে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে আবার তেল আবিব থেকে মোসাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভিডিও কলের মাধ্যমে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
এদিকে, মোসাদের কর্মীরাও হাল ছাড়েননি। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ওমর মালয়েশিয়ায় ছুটি কাটাতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। এমআইটির ইন্টিলিজেন্স বিভাগ ইস্তাম্বুল শাখা ওমরকে বিদেশে সম্ভাব্য অপহরণের ব্যাপারে সতর্ক করে এবং তাঁর ফোনে একটি ট্রেকিং ডিভাইস লাগিয়ে দেয়। যাতে ফোন বন্ধ হলেও তাঁকে ট্রেস করা যায়।
কয়েকদিন পর কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্ট থেকে ওমরকে অপহরণ করে রাজধানী থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে একটি ক্যাবিনে নিয়ে যাওয়া হয়। মালয়েশিয়ায় মোসাদের এজেন্টরা তাঁকে সেখানে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। তেল আবিব থেকে মোসাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভিডিও কলের মাধ্যমেও তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
ওমরকে আয়রন ডোম হ্যাক এবং অ্যান্ড্রয়েড সিস্টেমে অনুপ্রবেশের সফটওয়্যার তৈরি করতে কি পদ্ধতি ব্যবহার করেছে তা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল।
এমআইটি তাকে অপহরণের ব্যাপারটি জানতে পারে এবং মালয়েশিয়ার প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করে। তাদেরকে ট্রেকিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে ওমরের অবস্থান নিশ্চিত করে। মালয়েশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী ওই এলাকায় রেইড দিয়ে ওমরকে উদ্ধার করে। সেসময় তাকে অপহরণ করা ১১ জনকেও গ্রেফতার করে তারা। পরে ওমর তুরস্কে ফিরে আসেন এবং তাঁকে এমআইটির একটি নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।
ইস্তাম্বুলের কাউন্টার টেরোরিজম পুলিশের সহায়তায় এমআইটি ফুয়াদ ওসামা হিজাজি নামের একজনকে গ্রেফতার করে। ফুয়াদ মোসাদের এজেন্টদের একজন যে নিকোলা রাদোনজির সাথে কাজ করতো।
গ্রেফতারকৃত এজেন্ট
এর আগে ২০১৮ সালে ফিলিস্তিনি এক ইঞ্জিনিয়ার ফাদি আল বাতসকে কুয়ালালামপুরে নিজ বাসার সামনে ফজরের নামাজ পড়তে মসজিদে যাওয়ার সময় গুলি করে হত্যা করা হয়। তাঁর পরিবার এ হত্যার জন্য মোসাদকে দায়ী করে। তৎকালীন ইজরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী আভিগডর লিবারম্যান বিষয়টিতে ইজরায়েলের সম্পৃক্ততার বিষয়টি অস্বীকার করেন।
মোসাদ এর আগেও দেশের বাইরে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী অনেক মানুষকে গুপ্ত হত্যা করেছে। ১৯৯৭ সালে জর্ডানে মোসাদের এজেন্টরা তৎকালীন হামাসের রাজনৈতিক প্রধান খালিদ মিশালকে কানে বিষ স্প্রে করে হত্যা চেষ্টা করে। পরবর্তীতে অনেকদিন চিকিৎসা নিয়ে তিনি সুস্থ হন।
২০১০ সালে দুবাইয়ে একটি হোটেলে মাহমুদ আল মাভহুহ নামের এক হামাস নেতাকে হত্যা করে মোসাদ। ইজরাইল হত্যাকাণ্ডটির দায় স্বীকার করেনি আবার অস্বীকারও করেনি।
এর আগে তুরস্কের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এমআইটি ফিলিস্তিনিদের উপর গুপ্তচরবৃত্তি করার জন্য ৫৬ জন এজেন্টসহ ‘গোস্ট’ নামের একটি সেলের খোঁজ পান। এই এজেন্টদের সবাই বিদেশি নাগরিক যারা মোসাদের হয়ে তুরস্কে কাজ করছে। তারা অনলাইন রাউটিংয়ের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের টার্গেট করে তাদের বায়োগ্রাফিক্যাল তথ্য সংগ্রহ করতো। তারা ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক হ্যাক করে ডিভাইস থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে চুরি করতো এবং জিপিএস ট্রেক করে তাদের গতিবিধির উপর সর্বদা নজর রাখতো।
তুরস্কের সংবাদ মিডিয়া সূত্রে জানা যায়, গত মে মাসে এমআইটি ১৫ জন এজেন্টসহ ইস্তাম্বুল অবস্থিত মোসাদের আরেকটি সেল ধ্বংস করে। মোসাদ তাদের এজেন্টদের ইউরোপে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দিতো আর সেখান থেকে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করতে তুরস্কে পাঠাতো।
সম্প্রতি তুরস্ক ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম ‘ডেইলি সাবাহ‘ আলোচিত ঘটনাটি প্রচার করেন।