১৬ মে ২০২৩, ১৫:০৯

তৃতীয় পক্ষের হাতে এরদোয়ানের ভাগ্য

  © সংগৃহীত

টিডিসি রিপোর্ট: তুরষ্কের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতপূর্ন  ১৪ মে'র নির্বাচনে কোনো প্রার্থী দরকারি ৫০ শতাংশের বেশি ভোট নিশ্চিত করতে না পারায় তুর্কির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দ্বিতীয় ধাপে গড়িয়েছে নির্বাচন প্রক্রিয়া। এ পর্যায়ে এসে সুলতান এরদোয়ানের ভাগ্য অনেকটা তৃতীয় পক্ষের হাতে আটকা পড়েছে। 

তুরস্কের নির্বাচনে মূল ফোকাস  ছিল প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রিসেপ তাইপ এরদোগান এবং কেমাল কিলিচদারোগ্লুর দিকে। তবে ১৪ মে অনুষ্ঠিত প্রথম দফা ভোটে বেশ চমক দেখিয়েছেন সিনান ওগান নামের আরেক প্রার্থী। প্রেসিডেন্ট হবার জন্য দরকারি ৫০ শতাংশের কাছাকাছি ভোট না পেলেও তাকে ভোট দিয়েছেন ৫ শতাংশেরও বেশি মানুষ। ফলে দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে তার পাওয়া ৫ শতাংশ জনমত ভাগ্য নির্ধারণ করে দিতে পারে কেমাল কিংবা এরদোয়ানের। 

ভোটের হিসাবে দেখা গেছে এরদোগান পেয়েছেন ৪৯.৫ শতাংশ আর কেমাল কিলিচদারোগ্লু পেয়েছেন ৪৪.৮৯ শতাংশ ভোট। সেখানে সিনান ওগানের পাওয়া ভোট মাত্র ৫.১৭ শতাংশ। কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডে তার এই অল্প সমর্থকগোষ্ঠীকেই প্রয়োজন পড়বে এরদোগান ও কামালের। তুর্কি আইন অনুযায়ী, ভোটের ফল চূড়ান্ত হওয়ার পর যদি কোনো প্রার্থী ৫০ শতাংশ ভোট না পান, তবে ২ সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয় দফার নির্বাচন আয়োজন করা হবে।

প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর ভোটের ব্যবধান মাত্র ৪ শতাংশের কিছু বেশি। তাই বিশ্লেষকরা বলছেন, দ্বিতীয় দফায় সিনান ওগান তার সমর্থকদের যাকে ভোট দিতে বলবেন, তিনিই পরবর্তী ৫ বছরের জন্য বসতে পারবেন তুরস্কের মসনদে।


কে এই সিনান ওগান

সিনানের জন্ম ১৯৬৭ সালে, তুরস্কের পূর্বাঞ্চলে আর্মেনিয়ার সীমান্তবর্তী ইগদির শহরে। তুর্কির ভাগ্য নির্ধারণের কলকাঠি হাতে পেয়ে যাওয়া আজারবাইজানি তুর্কি বংশোদ্ভূত এ প্রার্থী পেশায় ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ। তিনি মারমারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেন। তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি নেন মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস থেকে। একসময় এরদোগানের একে পার্টির মিত্র ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট পার্টিতেই (এমএইচপি) ছিলেন। দায়িত্ব পালন করেছেন দলে ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে। তবে ২০১৫ সালে অভ্যন্তরীণ বিরোধে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এখন সেই সিনানই হচ্ছেন কিংমেকার। তার হাতেই নির্ধারিত হবে এরদোগানের ভাগ্য। এরদোগান তার সমর্থন পাবেন কিনা তার দিকেই চোখ এখন সবার।

 

ইতোমধ্যে সমর্থন আদায় করতে কেমাল ও এরদোগান উভয়েই এখন সিনানের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করছেন। তবে সিনানের অবস্থান হলো, তিনি যাকেই সমর্থন দেন না কেনো এ জন্য তার কিছু শর্ত মেনে নিতে হবে।শুধু মানলেই হবে না একটি ‘স্বচ্ছ প্রোটোকলে’ একটি চুক্তির বিশদ স্বাক্ষর করতে হবে। এই চুক্তির বিস্তারিত জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে হবে।রাজধানী আঙ্কারায় জার্মান প্রেস এজেন্সিকে (ডিপিএ) দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি শর্তগুলো তুলে ধরেন। তার প্রথম শর্তই হচ্ছে, তুরস্কে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলাকে সবথেকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে এবং সিরিয়ার যে শরনার্থীরা তুরস্কে রয়েছে তাদেরকে দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, তুরস্কের পরবর্তী প্রেসিডেন্টকে অবশ্যই দেশের ধর্মনিরপেক্ষ নীতিগুলি নিশ্চিত করতে হবে। নিশ্চয়তা দিতে হবে  ধর্মনিরপেক্ষতা ধরে রাখার। আছে, তুর্কি প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের আদর্শ অনুসরণের শর্তও।

জানা যাচ্ছে, এরদোগান এবং কেমালের দল তাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। তবে তিনি এখনও কোনদিকে যাবেন তার সম্ভাব্য অবস্থান নির্ধারণে গুরুতর আলোচনা শুরু করতে পারেননি। ‘অনিশ্চয়তা এড়াতে’ এই সপ্তাহেই একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আশা করছেন। তিনি বলেন, আজকে আমি যদি নির্বাচনে না লড়তাম তাহলে বিজয়ী এরদোগান গত রাতেই তার বারান্দা থেকে বিজয়ী ভাষণ দিতেন। যদিও আঙ্কারায় তার দলের সদর দপ্তরের বারান্দায় হাজির হয়েছিলেন এরদোগান। তবে তিনি বিজয়ী হিসেবে ভাষণ দিতে পারেননি। দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে উল্লাসে যোগ দিয়েছেন এবং দ্বিতীয় দফায় জয়ের আত্মবিশ্বাস প্রকাশ করেছেন। ওগান জানান, কিংমেকারের ভূমিকা পালন করতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। তিনি নিশ্চিত যে, তাকে ভোট দেয়া ২৮ লাখ মানুষ তার সমর্থিত প্রার্থীকেই ভোট দেবে। 

মিল আছে এরদোয়ান সমর্থকদের সাথে

ওগান নিজেও এরদোগানের মতো ডানপন্থী রাজনীতিবিদ। ফলে এরদোগান ও তার সমর্থকদের মধ্যে বহু ইস্যুতে মিল রয়েছে। সেদিক থেকে কেমালের পশ্চিমা উদারপন্থী রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য সমকামি অধিকারসহ পশ্চিমা ধ্যানধারণাকে তুরস্কে প্রতিষ্ঠিত করার কথা বলেন তার দলের লোকেরা। এ বিষয়ে ওগান বলেন, কামাল কিলিচদারোগ্লু তুরস্কের ডানপন্থীদের উত্থানকে উপেক্ষা করে হিসাবে ভুল করেছেন। এ কারণেই তার ধর্মনিরপেক্ষ ও জাতীয়তাবাদী ছয় দলীয় বিরোধী জোট জনগণের সমর্থন পেতে ব্যর্থ হয়েছে। 

ওগানের এটিএ জোট তুরস্কে থাকা ৩৪ লাখ সিরীয় শরণার্থীকে দেশে ফেরত পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। একইসঙ্গে তারা কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার এবং পিকেকে-পন্থী পিপলস' ডেমোক্রেটিক পার্টিকে (এইচডিপি) নিষিদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারা। পিকেকে কুর্দি ‘সন্ত্রাসীদের’ সমর্থনকারী দল হিসেবে বিবেচনা করে তুরস্কের অনেক রাজনৈতিক দল। 

ইস্তাম্বুল-ভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ক্যান সেলচুকি বলেছেন,  প্রথম রাউন্ডে কামাল জিতবেন সেটি হয়ত কম মানুষই আশা করেছিল, কিন্তু এরদোগান তার থেকে ৪ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়েছেন! এটি বেশ চমকপ্রদ। এখন যদি ওগানের সব সমর্থন কামালের পক্ষেও যায়, তবুও এরদোগানই হবেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট। 

তুরস্কে এমন সময় এই নির্বাচন হয়েছে যখন দেশটিতে অর্থনৈতিক সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এছাড়া গত ফেব্রুয়ারিতে জোড়া ভূমিকম্পের কারণে দেশটি মহা সংকটে পড়েছিল। প্রায় অর্ধলক্ষ তুর্কি মারা যায় ওই ভূমিকম্পে। দেশটির পূর্বাঞ্চল পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে যায়। তবে ভূমিকম্প আঘাত হানা প্রদেশগুলোতে এরদোগান একতরফা ভোট পেয়েছেন। 

এবারের নির্বাচন ছিল শান্তিপূর্ণ এবং অপ্রীতিকর কোনো ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। এরদোগান এবং কামাল উভয়ই তাদের সমর্থকদের ভোট গণনা করা ভেন্যুতে সতর্কভাবে অবস্থান করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট এরদোগানের একে পার্টির সঙ্গে ইসলামপন্থী দলগুলো মিলে পিপলস অ্যালায়েন্স জোট তৈরি করেছে। এই জোটে আছে কট্টর জাতীয়তাবাদী এমএইচপি এবং অন্য দুটি দল। অন্যদিকে কেমালের সঙ্গে আছে মধ্য বামপন্থী দলগুলো। 

২০১৬ সালে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর এরদোগান প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতা অনেকখানি বাড়িয়ে নিয়েছেন। ২০১৭ সালে গণভোটের মাধ্যমে তুরস্কের সরকার সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে প্রেসিডেন্ট শাসিত ব্যবস্থায় পরিবর্তিত হয়। এবারের নির্বাচনে এরদোগানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কেমাল নির্বাচিত হলে প্রেসিডেন্টের 'অতিরিক্ত' ক্ষমতার বিধান বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট শাসিত রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে পার্লামেন্টারি ব্যবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল তার।

এর আগে ২০১৮ সালে নির্বাচনের সময় এরদোগান সমর্থকরা অনেকটা জিতবেন এমন নিশ্চয়তা নিয়েই ভোট দিতে গিয়েছিলেন। তবে এবার তাদের মনে আশঙ্কা ছিল। কারণ অবশ্য এই সিনান ওগানই। তিনি ৫ শতাংশ ভোট বাগিয়ে না নিলে এই ভোটই পেতেন এরদোগান।