এবার কি টিকতে পারবেন এরদোয়ান?
১৪ মে কি তাহলে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের ২০ বছরের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অবসান হতে যাচ্ছে? নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গ সঙ্গে এমন প্রশ্ন চাউর হতে শুরু করেছে। বিরোধীরা সবাই একাট্টা হলেও তুখোড় এ রাজনৈতিক খেলোয়াড়ের কৌশলের কাছে শেষ পর্যন্ত মার খেতে পারেন তারা।
তবে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান যে রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের এক অগ্নিপরীক্ষায় মুখোমুখি সে বিষয়ে একমত না হওয়ার সুযোগ নেই। নির্বাচন কেন্দ্রিক বেশ কয়েকটি জনমত জরিপে দেখা গেছে, তুর্কির নয়া সুলতানের চেয়ে কিছুটা হলেও এগিয়ে বিরোধীদলীয় প্রার্থী কেমাল কিলিচদারোগলু। তবে সে জরিপের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
আগামী সপ্তাহে অনুষ্ঠিতব্য এ নির্বাচনে দেশটির সাড়ে ৬ কোটি নাগরিক ভোটারধিকার প্রয়োগ করবেন। এরমধ্যে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা তুর্কি নাগরিক আছেন অর্ধ লাখের কাছাকাছি। যারা ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে ইতোমধ্যে ভোট দিয়েছেন।
ভয়াবহ সংকটে তুর্কি অর্থনীতি
বেশ কয়েক বছর ধরে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি তুর্কি অর্থনীতি। সে সময় মরার উপর খরার ঘা হয়ে আঘাত হানে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্প। ইউএনডিপির হিসেবে এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের মতো। তুর্কি মসনদে এরদোয়ানের প্রথম এক দশকের মেয়াদে তুরস্ক উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল। কিন্তু পরবর্তী দশক থেকে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে।
ডলারের বিপরীতে তুর্কি মুদ্রা লিরার মান কমে যাওয়া এবং জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে গত কয়েক বছরে এরদোয়ানের প্রতি জনসমর্থন কিছুটা কমতে শুরু হয়। তবে এ প্রবণতা শুরু হয়েছে মূলত ২০১৩ সাল থেকে। সেসময় দেশ জুড়ে তার সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ হতে দেখা গেছে, এতে ব্যাপক ধরপাকড় চালানো হয়ে বিক্ষোভকারীদের উপর।
সেসময় ২০১৩ সালের শুরু থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তুরস্কে বিনিয়োগ বন্ধ করে দিতে থাকেন। এতে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার বাজার, আমানত ও ঋণের বাজার ক্রমান্বয়ে অনেক বেশি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ে। ফলে সংকট বাড়তে থাকে দিন দিন। কিন্তু গত ১৮ মাসের অর্থনৈতিক সংকট এরদোয়ানের জনপ্রিয়তায় ভাটা নামিয়েছে অনেকটা।
সবকিছুর পরও ভোটাররা তাকে একেবারেই ফেলে দিবেন না সেটা বুঝা যায় ইস্তাম্বুলের ইসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান সেদা দিমিরাইপের কথায়। তিনি বলেন, অতীতে এরদোয়ান তাঁর সমর্থকদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে পারতেন। এখন অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হয়েছে। তাঁর সমর্থকেরা এখনো তাঁকে পছন্দ করেন, ভালোবাসেন। কিন্তু এ জন্য তাঁদের যে মূল্য চোকাতে হচ্ছে, তা নিয়ে তাঁরা অখুশি।
আতাতুর্কের কেমাল
একে পার্টি ও আরও কিছু ডানপন্থী দলের জোট পিপলস এলায়েন্সের প্রার্থী এরদোয়ানের প্রধান প্রতিপক্ষ কেমাল কিলিচদারোগলু। স্বাধীন তুর্কি প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা কামাল আতাতুর্কের দল বামপন্থী রিপাবলিকান পিপলস পার্টির নেতা তিনি। আগের কয়েকটি নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো বলতে গেলে এরদোয়ানকে মোটামুটি চ্যালেঞ্জ করতে পারে এমন শক্তিশালী প্রার্থী পর্যন্ত দিতে পারেনি।
আসলে নিজেদের মধ্যকার মতানৈক্য থাকায় শক্তিশালী প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হতে হয়নি এরদোয়ানকে। কিন্তু এবার বিরোধী ৬ দল একমত হয়ে একক প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়েছে ৭৪ বছর বয়সী কেমালকে। এই জোটকে অনেকে ৬ জনের টেবিল হিসেবেও অভিহিত করেন। গণতন্ত্রপন্থী ও দুর্নীতিবিরোধী শক্ত অবস্থানের জন্য খ্যাতি থাকলেও বিরোধীরা তার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের সাথে অতি ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ তুলে থাকেন।
আরও পড়ুন: ভূমিকম্পে নিহতদের লাশ কাঁধে নিয়ে যাচ্ছেন এরদোগান
আবার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে তিনি তুরস্ককে আবারও প্রধানমন্ত্রীর শাসনে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। আছে কুর্দি সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে তুরস্কে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর। তবে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি, নির্বাচিত হলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়াবে তার দেশ।
কামাল আতাতুর্কের দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কেমালের এসব প্রতিশ্রুতি ক্ষমতাসীন একেপি'র নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির একেবারেই বিপরীত। যেখানে তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হতে চাওয়া এরদোয়ান চান ২০১৪ সালে তার গড়া প্রেসিডেন্ট শাসিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় থাকবেন। দুই প্রার্থীর পরষ্পর বিরোধী প্রতিশ্রুতি বুঝিয়ে দিচ্ছে নির্বাচন কতটা ভাবনাচিনÍা করে ভোট দিতে হবে তুর্কি নাগরিকদের।
নির্বাচনী দাবার গুটি
অর্থনীতি
যদিও এরদোয়ানপন্থীরা দাবি করে থাকেন, এরদোয়ানই তুর্কির অর্থনৈতিক বিপ্লবের নায়ক, যিনি অসংখ্য বড় বড় অবকাঠামো উন্নয়ন করেছেন, অনেকগুলো অঞ্চলের ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন যা আগের সরকারের সময় অবহেলিত থেকেছে। কিন্তু ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের দিনে যখন দিনকে দিন তুর্কি লিরার মান পতন হচ্ছিল, তখনও নানা মহলের চাপ উপেক্ষা করে উল্টো সুদের হার কমিয়েছেন এরদোয়ান।
এখন ২৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সাড়ে ৮৫ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি দেখছে তুর্কি অর্থনীতি। কিন্তু নির্বাচনের কয়েক দিন আগে সরকারি চাকুরীজীবিদের বেতন ৪৫ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়ে তার ভোটের নৌকার পালে নতুন হাওয়া লাগিয়েছেন। সাথে সাথে মুদ্রাস্ফীতির হার এক অংকের ঘরে নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন এরদোয়ান।
ভূমিকম্প
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আঘাত হানা ভয়াবহ ভূমিকম্পে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায় দেশটিতে। দেশটির অন্তত দেড় কোটি মানুষ এ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যা মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ। অব্যাহত চাপের মুখে থাকা অর্থনীতির আকাশে বজ্রপাতে রূপ নেয় এ ভূমিকম্প। নির্বাচনে ভোটাদের প্রভাবিত করার অন্যতম ফ্যাক্টর বিবেচনা করা হচ্ছে এ ভূমিকম্পটাকে।
এরদোয়ানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে, তার সরকার পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়েছে এবং সেকারণে বিধ্বংসী ভূমিকম্পে এতো বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বিধ্বস্ত শহরগুলোর বাসিন্দারা বলছেন, দুর্গত লোকজনের কাছে পৌঁছানোর জন্য সরকারের দুর্যোগ ও জরুরি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। সাথে যুক্ত হয় গৃহায়ণ ও অবকাঠামো নির্মাণ খাতের দুর্নীতির লাগাম টানতে না পারার ব্যর্থতার প্রশ্ন।
ইসলামি মূল্যবোধ
প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ২০১৩ সালে এরদোয়ান সরকারি চাকুরীজীবি নারীদের উপর থেকে হিজাব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। কামাল আতাতুর্কের দল এই হিজাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। এরদোয়ান বলছেন, তিনি হারলে তারা আবারও সে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবেন। একই সাথে প্রধান প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে "এলজিবিটিকিউ"র প্রতি সমর্থনের অভিযোগ তুলে ব্যালটের মাধ্যমে কবর দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমে অধিপত্য
এরদোয়ানের বিরোধীরা তার বিরুদ্ধে দেশটির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস বা কুক্ষিগত করার অভিযোগ তোলেন। বিশেষত ২০১৬ সালের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান ও তার পরবর্তী দেশব্যাপী ধরপাকরে হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে গণতন্ত্রপন্থীরা ক্ষুদ্ধ। বিরোধীদের দাবি এরদোয়ানের সময়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে সবচেয়ে বেশি। দেশটির ৯০ শতাংশ মিডিয়া এরদোয়ান কিংবা তার ঘনিষ্ঠদের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে।
তুর্কির এবারের নির্বাচনে যতো ভোট পড়বে, কোনো প্রার্থী যদি তার ৫০ শতাংশের বেশি পান, তাহলে তিনি সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। কিন্তু এমনটা না হলে অর্থাৎ কোনো প্রার্থী যদি ৫০ শতাংশের বেশি ভোট নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয় তাহলে নির্বাচনের দুই সপ্তাহ পর সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া দুই প্রতিদ্বন্ধী প্রার্থীর মধ্যে দ্বিতীয় দফায় ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হবে
এই শতকের শুরুর দিক থেকে অর্থাৎ ২০০৩ সাল থেকে এরদোয়ান তুরস্ক শাসন করে আসছেন। কিন্তু এবারের নির্বাচনে প্রায় ৬০ লাখ তরূণ ভোটার ভোট দেবেন যারা এরদোয়ান ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক নেতাকে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে দেখেন নি। বিভক্ত তুর্কি সমাজ, বিপর্যস্ত অর্থনীতি, পশ্চিমাদের সাথে অব্যাহত খারাপ সম্পর্ক এবারের নির্বাচনে এরদোয়ানকে ক্ষমতা থেকে ছিটকে ফেলতে পারে কিনা সে সমীকরণ মেলানোর জন্য তুর্কি ভোটারদের দিকে চেয়ে থাকতে হবে ১৪ মে'র নির্বাচনের ফলাফল পর্যন্ত।