যেভাবে ঈদ করতেন রাসুল (সা.) ও সাহাবিরা

যেভাবে ঈদ করতেন রাসুল (সা.) ও সাহাবিরা
যেভাবে ঈদ করতেন রাসুল (সা.) ও সাহাবিরা  © ফাইল ছবি

ঈদ আরবি শব্দ। যার অর্থ ফিরে আসা। যেহেতু প্রতিবছরই এটা ফিরে আসে; তাই, একে ঈদ বলা হয়। ঈদ আমাদের জন্য এক বিরাট নিয়ামত। কিন্তু আমরা এ দিনকে নিয়ামত হিসাবে গ্রহণ করি না। এ দিনে অনেক কাজ আছে যার মাধ্যমে আমরা আল্লাহ তায়ালার নিকটবর্তী হতে পারি এবং ঈদ উদযাপনও একটি ইবাদতে পরিণত হতে পারে। ঈদের দিনে আমাদের শুধু আনন্দ উৎসবে মেতে না থেকে কিছু বিষয় খেয়াল রাখা দরকার-

ঈদের নামাজ আদায় করা: ঈদের দিনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ঈদের নামাজ আদায় করা। প্রকৃতপক্ষে একজন ঈমানদার বান্দা নামাজ আদায়ের মাধ্যমে বেশি আনন্দিত হয়ে থাকে। নবী করিম সা. ঈদুল ফিতরের দিনে বের হয়ে দু রাকাত ঈদের নামাজ আদায় করেছেন। এর পূর্বে ও পরে অন্য কোন নামাজ আদায় করেননি। [সহিহ বোখারি: ৯৮৯]

গোসল করা: হযরত ইবনে ওমর রা হতে বর্ণিত যে, রাসুল সা. ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন। [সুনানে বায়হাকী: ৫৯২০]

নতুন পোশাক পরিধান করা: ঈদে উত্তম জামা-কাপড় পরিধান করে ঈদ উদযাপন করা। এ দিনে সকল মানুষ একত্রিত হয়, তাই প্রত্যেক মুসলিমের উচিত হল তার প্রতি আল্লাহর যে নিয়ামত তা প্রকাশ করণার্থে ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায়স্বরূপ নিজেকে সর্বোত্তম সাজে সজ্জিত করা। রাসূল সা. বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা তার বান্দার ওপর তার প্রদত্ত নিয়ামতের প্রকাশ দেখতে পছন্দ করেন। [সহিহ আল জামে: ১৮৮৭]

খাবার গ্রহণ করা: রাসুল সা. ঈদুল ফিতরের দিন না খেয়ে বের হতেন না, আর ঈদুল আজহার দিনে ঈদের সালাতের পূর্বে খেতেন না। [তিরমিযি-৫৪৫] ইয়াতিম ও অভাবীকে খাবার খাওয়ানো, ইয়াতিমের খোঁজ-খবর নেয়া, তাদেরকে খাবার খাওয়ানো এবং সম্ভব হলে তাদের নতুন কাপড়ের ব্যবস্থা করে দেয়া। এটা ঈমানদারদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া: পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া রাসুল সা. এর সুন্নত। তবে ওজর রত ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য নয়। হজরত আলী রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া সুন্নত। [বুখারী :৯৮৬]

ফিতরা দেয়া: রমজান মাসে সিয়ামের ত্রুটি-বিচ্যুতি পূরণার্থে এবং অভাবগ্রস্তদের খাবার প্রদানের উদ্দেশ্যে ঈদের সালাতের পূর্বে নির্ধারিত পরিমাণের যে খাদ্য সামগ্রী দান করা হয়ে থাকে, শরিয়তের পরিভাষায় তাকেই জাকাতুল ফিতর বা ফিতরা বলা হয়। হাদিসে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ঈদের নামাজে যাওয়ার পূর্বে ফিতরা আদায় করার আদেশ দিলেন। [সহিহ বোখারি: ১৫০৩]

তাকবির বলা: আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. হতে বর্ণিত, রাসুল সা. ঈদুল ফিতরের দিন ঘর থেকে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছা পর্যন্ত ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’ তাকবীর পাঠ করতেন। [মুসতাদরাক :১১০৬]

ঈদের খুতবা শ্রবণ করা: আব্দুল্লাহ বিন সায়েব রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুল সা. এর সঙ্গে ঈদ উদযাপন করলাম। যখন তিনি ঈদের নামাজ শেষ করলেন, তখন বললেন, ‘যার ভালো লাগে সে যেন বসে আর যে চলে যেতে চায় সে যেতে পারে’। [সুনানে আবু দাউদ :১১৫৭]

দোয়া ও ইস্তেগফার করা: ঈদের দিন আল্লাহ-তায়ালা একদল লোককে এভাবে মাফ করে দেন যেমনি তাদের মা তাদেরকে নিষ্পাপ জন্ম দিয়েছিল। রসুল সা. বলেন, ‘তারা যেন এই দিনে মুসলিমদের জামাতে দোয়ায় অংশগ্রহণ করে’। [লাতাইফুল মায়ারিফ]

মুসাফাহ ও মুআনাকাহ: ঈদের নামাজের পর রাসুল সা. তার সাহাবীদের সঙ্গে মুসাহাফাহ ও মুআনাকাহ করতেন।

শুভেচ্ছা বিনিময় করা: ঈদে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো শরিয়ত অনুমোদিত একটি বিষয়। বিভিন্ন বাক্য দ্বারা এ শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। যেমন- ক. হাফেয ইবনে হাজার রহ. বলেছেন, সাহাবারা ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অপরকে বলতেন, ‘তাকাববালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম’ অর্থ- আল্লাহ-তায়ালা আমাদের ও আপনার ভালো কাজগুলো কবুল করুন। খ. ‘ঈদ মোবারক’ ইনশাআল্লাহ। গ. ‘ঈদুকুম সাঈদ’ বলে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়।

আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেয়া: ঈদের সময় বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেয়া ও তাদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার বিশেষ সুযোগ তৈরি হয়। প্রতিবেশীরও খোঁজ-খবর নেয়া ঈদের সময় প্রতিবেশীর হক আদায়ের সুযোগ তৈরি হয়।

মন-মালিন্য দূর করা: জীবন চলার পথে বিভিন্ন পর্যায়ে কারো কারো সম্পর্কের অবনতি হতে পারে। ঈদের সময় পারস্পরিক মন-মালিন্য দূর করা ও সম্পর্ক সুদৃঢ় করার উত্তম সময়।

ঈদে আমাদের যা বর্জনীয়

ঈদ মুসলিম জাতির গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। আর আমাদের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি। আমরা ঈদ পালনে অনেকে ইসলাম সমর্থন করে না এমন সব সংস্কৃতিতে নিমজ্জিত হচ্ছি। যা আমাদের বর্জন করা দরকার। ঈদে বর্জনীয় বিষয়গুলো হলো-

ঈদের দিন রোজা পালন করা: ঈদের দিন রোজা পালন করলে ঈদের দিনের কাজসমূহ যথাযথ পালন করা যাবে না। সেজন্য হাদিসে ঈদের দিন রোজা পালন করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ এসেছে। সহিহ বোখারি ও মুসলিমে বর্ণিত আছে, ‘হজরত রাসূলুল্লাহ সা. ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিনে রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন।’ [সহিহ মুসলিম: ২৭৩০]

বিজাতীয় আচরণ প্রদর্শন: বিজাতীয় আচরণ মুসলিম সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। পোশাক-পরিচ্ছদে, চাল-চলনে, শুভেচ্ছা বিনিময়ে অমুসলিমদের অনুকরণে লিপ্ত হয়ে পড়েছে মুসলমানদের অনেকেই। ঈদের দিনে এ কাজটি অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। এটা করা যাবে না। সেই সঙ্গে গান-বাজনা করা, অশ্লীল সিনেমা ও নাটক দেখা- যা ইসলাম অনুমোদন করে না, তা থেকে বিরত থাকতে হবে।

বেহুদা কাজে সময় ব্যয় করা: অনেকে বেহুদা কাজে ঈদে রাত জাগরণ ও দিনে বেহুদা কাজে সময় নষ্ট করে থাকে। সেজন্য বেহুদা কাজে সময় নষ্ট করা থেকে বিরত থাকা দরকার। কোরআনে মুমিনের গুণাবলি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আর যারা অনর্থক কথা-কর্ম থেকে বিমুখ থাকে। [সূরা মুমিনুন: ০৩]

জামাতের সঙ্গে ফরজ নামাজ আদায়ে অলসতা করা: ঈদের আনন্দে এমনভাবে উদাসীন থাকেন যে, ফরজ নামাজ আদায়ে অলসতা করেন, যা গ্রহণযোগ্য নয়। কোরআনে বলা হয়েছে, অতএব সেই নামাজ আদায়কারীদের জন্য দুর্ভোগ, যারা নিজেদের নামাজে অমনোযোগী। [সূরা মাউন: ৪-৫]

অপচয় ও অপব্যয় করা: ঈদের কেনাকাটা থেকে শুরু করে এ উপলক্ষে সব কিছুতেই অপচয় ও অপব্যয় করা হয়। অথচ কোরআনে বলা হয়েছে, আর তোমরা কোনভাবেই অপব্যয় করো না, নিশ্চয়ই অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই। -সূরা বনি ইসরাঈল: ২৬-২৭

ঈদের দিনকে কবর জিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট করা: অনেকে এ দিনকে কবর জিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট করে থাকেন, যা হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে সাব্যস্ত হয়নি। অতএব ঈদের দিনকে কবর জিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট করা যাবে না। এজন্য রাসূল (সা.) বলেছেন, যে এমন ইবাদত করল যাতে আমাদের কোনো নির্দেশনা নেই তা পরিত্যাজ্য হিসাবে গণ্য হবে। -সহিহ মুসলিম: ৪৫৯০

জুয়া খেলা ও আতশবাজি: এগুলো শরিয়ত বিরোধী কাজ। আল্লাহ-তায়ালা বলেন, হে মুমিনগণ, নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদী ও ভাগ্য-নির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। [সূরা মায়িদা: ৯০]

মানুষকে কষ্ট দেয়া: ঈদের দিনে অনেকে এমন কাজ করেন যা মানুষকে কষ্ট দেয়। যেমন, রাস্তা আটকিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা নেয়া, এমন আনন্দ করা যাতে অন্যরা কষ্ট পায়। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, মুসলিম ওই ব্যক্তি যার হাত ও জিহ্বা থেকে অন্যরা নিরাপদ। [সহিহ বোখারি : ৬৪৮৪]

ঈদের নামাজ আদায় না করে কেবল আনন্দ ফুর্তি করা: অনেকে ঈদের আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে নতুন জামা-কাপড় পরিধান, সেমাই, ফিরনী ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, ঈদের নামাজ আদায় করার কথা ভুলে যান। অথচ এই দিনে ঈদের নামাজ আদায় করা হচ্ছে মূল করণীয়।

ঈদ একটি ইবাদত, আনন্দ ও ফুর্তি করার মাধ্যমেও যে ইবাদত পালন করা যায়, ঈদ তার অন্যতম উদাহরণ। শরিয়াহ সম্মতভাবে আনন্দ প্রকাশ করার বিষয়ে কোরআনে এসেছে, বল, এটা আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত, সুতরাং এ নিয়েই যেন তারা খুশি হয়। এটি যা তারা জমা করে তা থেকে উত্তম। [সূরা ইউনুস : ৫৮]


সর্বশেষ সংবাদ