আনন্দের বারতায় নিরানন্দে ক্যাম্পাসে ঈদ
ঈদ খুশি আর আনন্দের বারতা নিয়ে এলেও তা সবসময়ই খুশি ও আনন্দের হয়না সবার জন্য। ইদের আনন্দ বঞ্চিতদের তালিকায় যারা থাকেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা। নানা কারণে ক্যাম্পাসে ঈদ করতে হয় এসব শিক্ষার্থীদের। তবে, এ সংখ্যা খুব বেশি নয়—যারা ক্যাম্পাসে ঈদ পালন করে থাকেন। ফলে, ঈদের ছুটি শুরু হওয়া মাত্রই অনেকটাই স্পন্দনহীন হয়ে পড়ে সহস্র প্রাণের কলরবে মুখরিত জনাকীর্ণ ক্যাম্পাসগুলো; ক্যাম্পাসে আচমকাই নেমে আসে জনহীন কোন এক গহীন অরণ্যের নীরবতা।
সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, চূড়ান্ত পরীক্ষা, চাকরির পরীক্ষার ইত্যাদি কারণে ক্যাম্পাসেই ঈদ পালন করেন শিক্ষার্থীরা। যারা নানা কারণে থেকে যান ক্যাম্পাসে তাদের ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে হয় সহপাঠীদের সঙ্গেই। তবে, ঈদকে ঘিরে যারা ক্যাম্পাসে থেকে যান তাদের জন্য নানা রকম আয়োজন থাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের; হলগুলোতে থাকে বিশেষ খাবারের আয়োজন। এসবের পর তবুও মন কাঁদে প্রিয়জনদের জন্য; একসঙ্গে ঈদ করতে না পারার কষ্ট জমা হয় নীরবে, আড়ালে। তবুও জীবন বাস্তবতায় সময়কে এগিয়ে নিতে হয় বাস্তবতার দাবিতে; বিসর্জন কিংবা আনন্দের ভেলায় ভাসিয়ে দিতে হয় ইদের আনন্দকে।
এ সময় চোখে পড়ে না রুটিনে থাকা ক্লাস, পরীক্ষার ভিড়ে শিক্ষার্থীদের ঘুম জড়ানো মলিন মুখে চোখ ডলতে ডলতে ক্লাসে হাজির হওয়া বা দিন শেষে রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে হলে ফেরার চিত্র। এসময় শিক্ষাঙ্গন-গুলোয় শুনশান নীরবতায় জড়িয়ে থাকা গুমোট আনন্দের প্রহরা নিজেকে প্রকাশ করতে চাইলেও সে প্রকাশ করতে পারে না তার চিরচেনা প্রকাশকে। ফলে আনন্দ নিজেই প্রকাশ করে নিজেকে নিজের মতো করে—একাকী নীরবে। তখন ক্যাম্পাসে থেকে যাওয়াদের আড্ডা আর গান জমে না, সময় জমে বইয়ের পাতার নীরব শব্দে, নিঃশব্দে। তখন চিরচেনা লাইব্রেরি এবং হলের রিডিং রুমের ফাঁকা চেয়ার-টেবিলগুলো কিছু সময়ের জন্য উদারভাবে নিজেকে আবৃত করে ধুলার চাদরে; উৎসাহ দেয় মাকড়শা আর ছত্রাকের অস্থায়ী আবাস সৃষ্টিকে।
ইদের ছুটিতে ক্যাম্পাস-গুলোয় বিভিন্ন দাবিতে প্রতিদিন নিয়ম করে স্লোগানমুখর ছাত্র সংগঠনগুলোর বিদ্রোহী আওয়াজও কানে বাজে না কিছুদিন। বড়জোর দুই একটা কাকের ডাক মাঝে মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করতে সাহায্য করে, দীর্ঘ এ ছুটিতে। ফলে মনকে পরিপূর্ণ রূপে মনোনিবেশ করা যায় আপন কর্মে; এখানে বাধা সৃষ্টি করার বা বিঘ্ন ঘটানোর কেউ থাকে না—যেন অনেকটা জনশূন্য রাজ্যে ভিন্ন রাজত্বের আবেশে। আবাসিক হলগুলো সাধারণত সারা বছরই প্রায় সারারাত শিক্ষার্থীদের হৈ-হুল্লোড় আর আড্ডায় প্রাণোচ্ছল থাকলেও ছুটির সময় সন্ধ্যার পর হলের কোনো রুমে অবস্থান করলে মনে হবে জনমানবের উপত্যকা ছেড়ে দূরবর্তী কোনো এলাকার একটি জনশূন্য স্থান; যেখানে কালেভদ্রেই সাড়া মেলে মানব অস্তিত্বের।
ছুটিতে পরিবার-পরিজন বা শৈশবের প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে ইদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে যেতে না পারা শিক্ষার্থীরা যখন ক্যাম্পাসে থাকে, তাদের একাকীত্ব থামে মসজিদ অথবা ঈদগাহে, ইদের জামাতে। তখন আত্মীয় স্বজন ছেড়ে থাকাদের স্বজন হয়ে ওঠেন ক্যাম্পাসে থাকা শিক্ষার্থী কিংবা পরিচিত-জনরা। ইদের জামাত কেন্দ্রিক মসজিদগুলোতে একটু ভিড় সাময়িক প্রাণোচ্ছল করে একাকীত্বে থাকা শিক্ষার্থী আর নীরব, নিশ্চল থাকা ক্যাম্পাসকে। ক্যাম্পাসে ঈদ পালন করতে থেকে যাওয়া শিক্ষার্থীরা ইদের জামাত শেষে সুযোগ হলে চলে যান ক্যাম্পাসের আশেপাশে অবস্থানরত আত্মীয়-স্বজন কিংবা বন্ধু-পরিচিত জনদের ঠিকানায়।
এরপরও শত আত্মীয় বা স্বজনের ভিড়ে যাদের তেমন কোনো আত্মীয় থাকে না; তাদের ঈদ কাটে ক্যাম্পাসের পরিচিত এলাকায়, ক্যাম্পাসে থেকে যাওয়া কোন সমাগম বা আড্ডায়। এছাড়াও কারো ক্যাম্পাসের ঈদ কাটে কোনো বিনোদন কেন্দ্রে ঘুরতে গিয়ে বা সিনেমা দেখার আনন্দে। আর এতো সব আনন্দের ভিড়ে যাদের কিছুই করার সুযোগ হয় না তাদের ক্যাম্পাসের ঈদ কাটে অন্তর্জালের জঞ্জালে, ফোনে বা ইন্টারনেটে শুভেচ্ছা বিনিময়ে।
এরপরও ঈদ আনন্দের, ঈদ উচ্ছ্বাসের; চিরচেনা কোলাহলে কিংবা পরিবারকে নিয়েই যে ঈদ সবসময় হতে হবে তার ধরাবাঁধা নিয়ম থেকে বেরিয়ে ঈদে যারা নিতান্তই বাধ্য হয়ে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ করে উঠতে পারেন না, অন্তত তাদের কারণে হলেও কিছুটা প্রাণের ছোঁয়া পায় দেশের বিদ্যায়তনগুলো। মমতা মাখানো সে আঙিনা হয়তো সবাইকে মায়ের আদর-মাখা ভালোবাসা দিতে পারে না কিন্তু উৎসবে আগলে রাখার নির্ভার দায়িত্ব নিয়ে দিব্যি আনন্দ দিতে পারে একটি নীরব, শান্তিপূর্ণ আনন্দের, একটি ইদের, একটি আপন ইদের; যে ঈদ সারাজীবন গল্পোচ্ছ্বলে বলে বেড়ানো যায়—নিখাদ, নীরব ভার-চাপা আনন্দে।