প্রবাসী বাংলাদেশি শিশুদের আনন্দের সাথে বাংলা ভাষা শেখান তারা
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করা প্রবাসী বাংলাদেশি শিশুদের বাংলা ভাষা শেখাতে কাজ করছে নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশি এড-টেক স্টার্টআপ ‘টিংকার্স টেকনোলোজিস লিমিটেড’। শিখন-শেখানোর গতানুগতিক ধারা থেকে বের হয়ে বাংলা শেখাকে আরও সহজ ও আনন্দময় করতে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।
কোম্পানিটি ‘আমার ভাষা’ নামক প্রকল্পের অধীনে শিশু ও কিশোর বয়সী প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ওয়ান-টু-ওয়ান টিউটোরিং, বিভিন্ন বই, প্রিন্টযোগ্য ওয়ার্কশীট, গেইম, ভিডিও, অডিও ইত্যাদি নানান শিক্ষা উপকরণ প্রদান করছে। সবার জন্য একই রকম ক্লাস-পরীক্ষা ধারনা থেকে বেরিয়ে ‘প্রতিটি শিশুই অনন্য’ এ ধারনা নিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
টিংকার্স বলছে, ভাষা একটি সংস্কৃতি ও জাতির মেলবন্ধনের মাধ্যম; কেউ ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে সে সংস্কৃতি থেকেও অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাই, মূলত ভাষা শেখানোর উদ্যোগ হলেও এটি আসলে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সাথে দেশ, দেশের মানুষ এবং আমাদের শেকড়ের সাথেই সংযুক্তি। তারা বলছেন, টিংকার্স ‘আমার ভাষা’ শুধুমাত্র বাংলা ভাষা শেখায় না; বাংলাদেশ এবং বাংলা সংস্কৃতির শেকড় ও ঐতিহ্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও সৌন্দর্য তুলে ধরে প্রবাসী শিশু-কিশোরদের কাছে। একজন ছোট শিশু যখন বাংলা ভাষা শেখে, তখন তার বাংলাদেশের প্রতিও মমতা সৃষ্টি হয়, বাংলাদেশকে জানার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। আর এভাবেই ভাষা শেখানোর আদলে, টিংকার্স টেকনলোজিস লিমিটেড কাজ করে চলেছে, প্রবাসী ছেলেমেয়েদের তাদের বাংলাদেশি শেকড়ের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে।
প্রতিষ্ঠানটির ‘আমার ভাষা’ সেবাটি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানি, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশে থাকা একজন শিক্ষক অনলাইন ভিডিও কলিংয়ের মাধ্যমে দেশের বাইরে থাকা কোনো একজন শিক্ষার্থীকে সরাসরি কথোপকথনের মাধ্যমে বাংলা ভাষা শেখানোর কাজটি করে থাকেন। পাশাপাশি প্রতিটি ক্লাস শেষে ওই শিক্ষার্থীকে এমন কিছু পাঠ্যেপকরণ দেওয়া হয়, যা দিয়ে শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে নিজেরাই চর্চা করতে পারে নিজেদের মতো করে। এছাড়াও বাংলা শেখাকে আরও আনন্দের করতে টিংকার্স বর্তমানে কম্পিউটার গেইম বানানোর কাজ করেছে। একইসাথে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইকে আরও সুন্দর ও আকর্ষণীয় করতে প্রতিষ্ঠানটি কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
‘আমার ভাষা’র শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সাথে ব্যক্তিগত সুসম্পর্কে জোর দিয়ে তাদের আরও ভালো ভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেন। এতে শিক্ষার্থীদের জন্য সেবাটি পার্সোনালাইজ (ব্যক্তিগত) করা সম্ভব হয়। অনলাইনে হওয়া প্রতিটি ক্লাসের ভিডিও রেকর্ড পর্যবেক্ষণ করে প্রতিষ্ঠানটির মান নিয়ন্ত্রক দল। তাদের পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষককে ক্লাসের মান আরও বাড়ানোর ব্যাপারে পরামর্শ প্রদান করা হয়। শিক্ষকরা সেই পরামর্শ অনুযায়ী ক্লাসগুলো আরও পার্সোনালাইজ; অর্থাৎ, শিশুর পছন্দ-অপছন্দ, শিশুর ব্যক্তিত্ব এবং চাহিদা অনুযায়ী ক্লাসের কন্টেন্ট ও শিক্ষা উপকরণ পরিবর্তন করে ক্লাসটিকে আরও প্রাণবন্ত করেন।
২০১৯ সালে যাত্রা শুরু করা প্রতিষ্ঠানটি গতানুগতিক পাঠদান পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করছে নতুন পদ্ধতিতে আনন্দের সাথে শিশুদের পাঠদান নিশ্চিতে। আর একাজে নিরলস ভাবে শ্রম দিচ্ছেন টিংকার্সের কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট ও রিসার্চ টিম। এর আগে বাংলাদেশের প্রবাসী ছেলেমেয়েদের জন্য বাংলা ভাষা শেখানোর কারিকুলাম এরকম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আগে কখনো বানানোর উদ্যোগ দেখা যায়নি।
টিংকার্স ‘আমার ভাষা’ কার্যক্রমে শিক্ষক হিসেবে কাজ করাদের ৯০ শতাংশ শিক্ষকই নারী; যারা মাতৃ-সুলভ যত্নে শিশুদের বাংলা শেখানোর দায়িত্ব পালন করছেন। শিক্ষকদের সবাই বাংলাদেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রী বা সদ্য স্নাতকসম্পন্নকারী। শিশু ও অভিভাবকদের সুবিধাজনক সময়ে ক্লাসগুলোর সময়সূচী নির্ধারণ করা হয়। ফলে ‘আমার ভাষা’র বেশিরভাগ ক্লাস বাংলাদেশ সময়ে রাতে বা ভোরে হয়ে থাকে।
শিক্ষা নিয়ে কাজ করার চিন্তা থেকেই এমন উদ্যোগ জানিয়ে টিংকার্স ‘আমার ভাষা’র সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং চীফ স্ট্রাটেজি অফিসার মুনেম শাহরিয়ার বলেন, ২০১৯ সালের শেষের দিকে আমাদের উদ্যোগটির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দাঁড় করাতে পারি; তখন আমরা বেশ কয়েকটি জায়গা থেকে ফান্ডিং পেয়েছিলাম। আমরা শিশুদের জন্য কাজ করতে চাই, বাংলা ভাষা এবং বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করার চিন্তা থেকেই আমাদের উদ্যোগটি চূড়ান্ত হয়। তখন আমরা চূড়ান্ত করি প্রবাসী বাংলাদেশি শিশুদের জন্য ভাষা শেখানোর কাজটি শুরু করি এবং আমরা এখন বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছি।
শেখানোর ক্ষেত্রে গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে আসা এবং পাঠদানকে আনন্দময় করা চ্যালেন্জিং জানিয়ে এই তরুণ বলছেন, আমরা যদিও বাংলা ভাষা শেখাই; কিন্তু, এ শেখানো শুধুমাত্র ভাষায় সীমাবদ্ধ থাকে না। এটি একজন শিশু বা শিক্ষার্থীকে তার শিকড়ের সাথে মেলবন্ধন করিয়ে দেয়। সে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা কিংবা অস্ট্রেলিয়া যেখানেই থাকুক না কেন-সে যখন বাংলা শেখে তখন সে অন্তরে বাংলাকে ধারণ করে। আর যেসব শিশুরা কোন না কোনভাবে বাংলাদেশি, কিন্তু তারা বাংলা শিখতে পারছে না; ফলে বাংলাদেশ তাদের কাছে তোর বেড়ে ওঠা দেশ ছাড়া শুধুমাত্রই একটি দেশ, বিদেশ।
ভাষা একটি সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন তৈরি করে দেয়। ভাষার মাধ্যমেই সাংস্কৃতিক এবং অন্যান্য সকল ভাবের আদান-প্রদান হয়। তাই, প্রবাসী বাংলাদেশিরা যেন আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায়— সে কাজটিই করছি আমরা। আমার ভাষা, আমার দেশ, আমার সংস্কৃতি এবং আমার শিকড় এই চারটি বিষয় নিয়েই ’টিংকার্স আমার ভাষা’— যুক্ত করেন মুনেম শাহরিয়ার।