তুরস্ক-সিরিয়ার ভূমিকম্প কেন এত বিধ্বংসী হলো?
শক্তিশালী একটি ভূমিকম্পের ঘটনায় তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তবর্তী এলাকায় এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৫ হাজার মানুষের। যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, রিখটার স্কেলে ঐ ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৮। তীব্র ঠাণ্ডা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি না থাকাসহ নানা কারণে ব্যাহত হচ্ছে সেখানকার উদ্ধার তৎপরতা। এর মধ্যেই বৃষ্টির কারণে তাপমাত্রা নেমে হিমাঙ্কের কাছাকাছি চলে গিয়েছে। পাশাপাশি, আজ সেখানে ভূমিকম্প পরবর্তী কম্পনের মাত্রা (আফটার শক) রেকর্ড করা হয়েছ ৭ দশমিক ৫ মাত্রার সমান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আফটার শকের মাত্রাটিও ছিল একটি শক্তিশালী ভূমিকম্পের সমান। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন এতো বিধ্বংসী হয়েছে তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তবর্তী ঐ এলাকায় সংঘটিত ভূমিকম্পটি?
কেন এত বিধ্বংসী হলো?
এটি একটি বড় ধরণের ভূমিকম্প যা ফল্ট লাইন বরাবর প্রায় ১০০ কিলোমিটার ধরে আঘাত হেনেছে এবং এর কারণে ঐ এলাকায় অবস্থিত ভবন ও স্থাপনাগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ইন্সটিটিউট ফর রিস্ক অ্যান্ড ডিজাস্টার রিডাকশনের প্রধান অধ্যাপক জোয়ানা ফাউর ওয়াকার বিবিসিকে জানিয়েছেন, যেকোনো বছরের এটি তুলনায় সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প। গত ১০ বছরের মধ্যে মাত্র দুটি ভূমিকম্প এ মাত্রার ছিল, আর এর আগের ১০ বছরে মাত্র চারটি ভূমিকম্প এ মাত্রার ছিল। তবে শুধু কম্পনের শক্তির কারণেই এতো বেশি ধ্বংসযজ্ঞ হয়নি। এই ঘটনাটি ঘটেছে ভোরের দিকে, যখন মানুষ ঘরের ভেতরে ঘুমাচ্ছিল। ভবনের দৃঢ়তাও একটি বিষয়। যার ফলে সেখানকার ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়েছ।
এ নিয়ে পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভলকানো এন্ড রিস্ক কমিউনিকেশন বিভাগের রিডার ড. কারমেন সোলানা জানিয়েছেন, দুর্ভাগ্যবশত দক্ষিণ তুরস্ক এবং বিশেষ করে সিরিয়ায় অবকাঠামোগুলো খুব একটা ভূমিকম্প প্রতিরোধী নয়। তাই জীবন বাঁচানো এখন নির্ভর করবে উদ্ধার তৎপরতার উপর। জীবিতদের উদ্ধারে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত ৪৮ ঘণ্টা পর জীবিত মানুষের সংখ্যা অনেক কমে যায়।
এটি এমন একটি অঞ্চল যেখানে গত ২শ বছর বা তার চেয়েও বেশি সময় ধরে কোনও বড় ভূমিকম্প হয়নি বা কোনও সতর্কতা সংকেতও ছিল না। তাই প্রায়ই ভূমিকম্প মোকাবেলা করে এমন অঞ্চলের তুলনায় এখানকার প্রস্তুতির মাত্রা বেশ কম হবে বলেও জানান তিনি।
সাধারনত প্রাণঘাতী ভূমিকম্প হিসেবে ধরা হয় রিখটার স্কেলে ৭ কিংবা ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে। এই মাত্রার ভূমিকম্পগুলো তীব্রভাবে অনুভূত হয় এবং এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বেশি হয়ে থাকে। ৮ মাত্রার বেশি কোন ভূমিকম্প যে কোনো কিছুর ভয়াবহ ক্ষতি করতে পারে এবং এর কেন্দ্রে থাকা কমিউনিটি বা অঞ্চলকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতে পারে।
তুরস্ক-সিরিয়ায় ভূমিকম্পটি সংঘটিত হওয়ার কারণ কী?
পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ আলাদা প্লেট দিয়ে গঠিত, যাকে টেকটনিক প্লেট বলা হয়, যা একে অপরের পাশাপাশি অবস্থান করে। এই প্লেটগুলি প্রায়শই নড়াচড়া করার চেষ্টা করে। কিন্তু পাশে থাকা অন্য আরেকটি প্লেটের সাথে ঘর্ষণের মাধ্যমে এই নড়াচড়া প্রতিরোধ করা হয়। তবে চাপ বেশি বেড়ে গেলে কখনো কখনো একটি প্লেট হঠাৎ করে ঝাঁকুনি দেয়ায় ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগ সরে যায়। ফলে পৃথিবীপৃষ্ঠে সংগঠিত হয় ভূ-কম্পন।
এবার এরাবিয়ান প্লেটটি উত্তর দিকে সরে যায় এবং উত্তর দিকে সরে যাওয়া আনাতোলিয়ান প্লেটে গিয়ে ধাক্কা দেয়। প্লেটগুলোর এ ধরণের ঘর্ষণের কারণে অনেক ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছে। পৃথিবী সৃষ্টির আদিতে এই প্লেটগুলো একসঙ্গে ছিল, এগুলো ক্রমে সরতে সরতে এখন বিভিন্ন মহাদেশের আলাদা অবস্থান তৈরি করেছে। সঞ্চালনশীল এই প্লেটগুলোর সীমানা ‘সিস্টেম অব ফল্টস’ হিসেবে পরিচিত। ফল্ট হচ্ছে দুই প্রস্থ পাথরের মধ্যখানের ফাটল বা চ্যুতি। টেকটোনিক প্লেটের এই ফল্টগুলোর হঠাৎ যে কোনো নড়াচড়াই ভূমিকম্পের কারণ। অ্যারাবিয়ান ও ইউরেশিয়ান এই দুই বিশাল টেকটোনিক প্লেটের ধাক্কাধাক্কিতে তুরস্ক চিপসে যাওয়ার মতো এক পরিস্থিতিতে পড়েছে। যার ফলে সেখানে এতো বেশি মৃত্যু ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
সিএনএনের আবহাওয়াবিদ ও দুর্যোগকালীন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ চ্যাড মেয়ারস বলেছেন, তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশের ভূ-অভ্যন্তরে মিলিত হয়েছে অ্যারাবিয়ান ও ইউরেশিয়ান এই দুই বিশাল টেকটোনিক প্লেট। এই ‘ফল্ট লাইন’ বরাবর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত নড়াচড়া করেছে প্রায় ১০০ মাইল জুড়ে।
নিউজউইক জানিয়েছে, তুরস্কের ভূতল দিয়ে এমনই দুটি ফল্ট লাইন চলে গেছে যার নাম ‘নর্থ আনাতোলিয়ান ফল্ট লাইন’ ও ‘ইস্ট আনাতোলিয়ান ফল্ট’। এই দুই ফল্ট লাইনের উপর অবস্থিত হওয়ায় তুরস্ক বিশ্বের অন্যতম ভূমিকম্প-প্রবণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত।
সিএনএনের আরেক আবহাওয়াবিদ ক্যারেন ম্যাগিনিস সতর্ক করে বলেছেন, এই ভূকম্পনের বৈশিষ্ট্যের কারণে আফটার শক পরের কয়েক সপ্তাহ, এমনকি কয়েক মাস পর্যন্তও অনুভূত হতে পারে; তা নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
সর্বশেষ অবস্থা:
তুরস্কের দুর্যোগ ও জরুরি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ (এএফএডি) জানিয়েছে, ভূমিকম্পে তুরস্কে মৃতের সংখ্যা ৩ হাজার ৪শ ১৯ জন ছাড়িয়েছে। দেশটির মালটিয়া, সানলিউরফা, ওসমানিয়ে ও দিয়ারবাকির প্রদেশে এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
আর সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সানা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে জানিয়েছে, সিরিয়ার আলেপ্পো, হামা, লাতকিয়া ও টার্টাসে কমপক্ষে ১৬০০ জন নিহত হয়েছেন।
এএফএডির কর্মকর্তা ওরহান তাতার জানিয়েছেন, ভূমিকম্পে ৫৭৭৫টি ভবন ধ্বংস হয়েছে, এ পর্যন্ত ২৮৫টি পরাঘাত হয়েছে এবং সব-মিলিয়ে ২০৪২৬ জন আহত হয়েছেন।
আর তুরস্কের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এ পর্যন্ত মোতায়েন করা হয়েছে ১৩৭৪০ জন উদ্ধারকর্মী এবং ৪১ হাজারেরও বেশি তাঁবু, এক লাখ বিছানা ও তিন লাখ কম্বল পাঠানো হয়েছে দুর্গত এলাকাগুলোতে।
জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস) বলছে, স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে ভূমিকম্পটি শুরু হয়ে প্রায় এক মিনিট স্থায়ী হয়। এর উৎপত্তি গাজিয়ানতেপ শহরের কাছে ভূপৃষ্ঠের ১৭ দশমিক ৯ কিলোমিটার (১১ মাইল) গভীরে।
অন্যদিকে জার্মান রিসার্চ সেন্টার ফর জিওসায়েন্স (জিএফজেড) বলছে, ভূমিকম্পটির উৎপত্তি তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর কাহরামানমারাসের কাছে ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার (৬ মাইল) গভীরে। সুনামির সম্ভাবনা পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে বলে ইএমএসসি মনিটরিং সার্ভিস জানিয়েছে।
ভূমিকম্পটি অনুভূত হয়েছে তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারা ও দেশটির অন্যান্য শহরের পাশাপাশি পুরো অঞ্চল-জুড়ে। প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো বলেছে, স্থানীয় বাসিন্দারা প্রচণ্ড শীতের মধ্যে তুষারে ঢাকা রাস্তায় নেমে আসতে বাধ্য হয়েছেন ভূমিকম্পের তীব্রতায়। ভূমিকম্পে বহু ভবন ধসে পড়েছে আর এসব ভবনের ধ্বংসস্তূপে বহু মানুষ আটকা পড়েছে বলেও খবর আসছে।
তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুলেইমান সোইলু জানিয়েছেন, ভূমিকম্পে গাজিয়ানতেপ, কাহরামানমারাস, হতাই, ওসমানিয়ে, আদিয়ামান, মালাটিয়া, সানলিউরফা, আদানা, দিয়ারবাকির ও কিলিস-এই ১০টি শহর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, আলজাজিরা, রয়টার্স, সিএএনএন, আনাদোলু ও সানা