০২ অক্টোবর ২০২৫, ২১:৩৫

‘পড়ালেখার খরচ দিয়েও পরিবারের জন্য কিছু টাকা পাঠাতে পেরে ভালো লাগে’

রাজধানীর সড়কে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিকের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও কাজ করছেন  © টিডিসি সম্পাদিত

গত বছরের ৫ আগস্টের পর রাজধানীর সড়কে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিকের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরও কাজে লাগানো হচ্ছে। প্রতিদিন দুই শিফটে তারা এ দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে এ কাজে নিয়োজিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় এক হাজার। প্রতি শিফটে চার ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করে জনপ্রতি ভ্যাট-ট্যাক্সসহ ৫৬০ টাকা সম্মানী পেয়ে থাকেন তারা।

জানা গেছে, খণ্ডকালীন চাকরিরত এসব শিক্ষার্থী মাধ্যমিকে পড়ুয়া কিংবা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। পড়াশোনার পাশাপাশি খণ্ডকালীন চাকরি করে নিজের ব্যয়ভার বহন করে কিছু টাকা পরিবারের জন্য পাঠান তারা। আবার কেউ কেউ ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়ও করেন। তবে এ পেশায় পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় দায়িত্ব পালন করা শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিকভাবে সমস্যায় পড়ার কথাও জানিয়েছেন।

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর রাজধানীর ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা কার্যত ভেঙে পড়েছিল। সে সময় সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে দিন-রাত কাজ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। টানা ছয় দিন তারা ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে বেশ বেগ পেতে হয় ট্রাফিক পুলিশকে। রাজধানীবাসীকে সচেতন করতে সে বছরের ২১ অক্টোবর থেকে ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে ‘ট্রাফিক পক্ষ’ আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ট্রাফিক পক্ষের শুরুর দিকে পুলিশের পাশাপাশি ঢাকার সড়কে কাজ করার জন্য এক হাজার শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। শুরুতে এর সঙ্গে যুক্ত হন ২৯১ শিক্ষার্থী। বর্তমানে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় যুক্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক হাজারের মতো।

রাজধানীর সড়কে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিকের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও কাজ করছেন

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, রাজধানীতে ৮টি ডিভিশন শিক্ষার্থী দায়িত্ব পালন করেন। এসব ডিভিশন আবার কয়েকটি জোনে ভাগ করা হয়েছে। তাদের প্রথম শিফট শুরু হয় সকাল ৮টায়। এটি থাকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। আর দ্বিতীয় শিফট চলে বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত। এই দায়িত্ব পালনের জন্য প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে দৈনিক সম্মানী দেওয়া হচ্ছে ৫০৫ টাকা (ভ্যাট ট্যাক্স বাদে) করে। যারা এ দায়িত্ব পালন করেন, তাদের ট্রাফিক সহায়তাকারী গ্রুপ (TAG) বলা হয়। মূলত পিক আওয়ারে (অফিস শুরু ও শেষ) তারা দায়িত্ব পালন করেন।

বনানী জোন প্রতিনিধি মো. নিশান হোসাইন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘৫ আগস্টের পর রাজধানীর সড়কে যখন কোনো ট্রাফিক ছিল না, তখন আমরা সড়কে টানা ১৫ দিনের মতো কাজ করেছি। এরপর সরকারের সিদ্ধান্তে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস থেকে ফিটনেস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ট্রাফিক সহায়তাকারী গ্রুপ (TAG) হিসেবে কাজ করছি। বর্তমানে আমাদের সংখ্যা প্রায় এক হাজার।’

তিনি বলেন, ‘পড়াশোনার পাশাপাশি এরকম খণ্ডকালীন চাকরি আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক উপকারী। শুধু রাজধানীতে নয়, অন্যান্য মহানগরীতেও এ উদ্যোগ চালু করা যেতে পারে।’

যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন এক শিক্ষার্থী

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিকের যুগ্ম পুলিশ কমিশনার মো আনিছুর রহমান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক সহায়তাকারী গ্রুপ (TAG) সদস্য হিসেবে প্রায় এক হাজার সদস্য নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রতিদিন কাজে যোগদানের ভিত্তিতে তাদের পারিশ্রমিক দেওয়া হয়ে থাকে। জনপ্রতি ভ্যাট ট্যাক্সসহ ৫৬০ টাকা প্রদান করা হয়।

তারা কত দিন কাজের সুযোগ পাবেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জুন থেকে জুন আমাদের বাজেট/চুক্তি হয়ে থাকে। আগামী বাজেটে এই (TAG) সদস্যদের চুক্তি বহাল না বাতিল, তা এখন বলা যাচ্ছে না।’

ট্রাফিক-ওয়ারী বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মো. আজাদ রহমান দ্য ডেইলি ক্যম্পাসকে বলেন, ডিএমপির ওয়ারী বিভাগে একশত ট্রাফিক সহায়তাকারী গ্রুপ সদস্য কাজ করে। প্রতি টিএজি সদস্য ডিউটি করলে ৫৬০ টাকা করে জনপ্রতি তাদের সম্মানী দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, ‘এই ট্রাফিক সহায়তাকারী গ্রুপের সদস্যরা সকাল ও বিকেল দুই শিফটে কাজ করেন। তাদের কোনো জোরপূর্বক কাজ করানো হয় না। তাদের গ্রুপ লিডারদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তাদের মাধ্যমে এই ছাত্রদের পরিচালনা করে থাকি এবং যেদিন যে কতজন ডিউটিতে আসে, সে অনুপাতে তাদের সম্মানী প্রদান করা হয়।’

তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মো. রফিকুল বলেন, ট্রাফিক সহায়তাকারী গ্রুপের সদস্যদের নিজের নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিতে হবে। ধুলাবালিময় পরিবেশে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক। জনসাধারণের সঙ্গে আচরণে সর্বদা ধৈর্য ও পেশাদারত্ব বজায় রাখতে হবে এবং যেকোনো বিতর্ক এড়িয়ে চলতে হবে। সমস্যার সম্মুখীন হলে দ্রুত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে অবহিত করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, পেশাদার মনোভাব, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার মাধ্যমে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়েই ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব।

তেজগাঁওয়ের এডিসি ট্রাফিক তানিয়া সুলতানা দ্য ডেইলি ক্যম্পাসকে বলেন, ‘তেজগাঁও জোনে প্রথমে ট্রাফিক সহায়তা গ্রুপের ১৬০ সদস্য নিয়োগ দেওয়া হয়। বর্তমানে শতাধিক সদস্য আমাদের সঙ্গে কাজ করেন।’

ট্রাফিক সহায়তাকারী গ্রুপ (TAG) হিসেবে পরিচিত তারা

কদমতলী থানায় কর্মরত ট্রাফিক সহায়তাকারী গ্রুপ সদস্য আবদুস সাত্তার দ্য ডেইলি ক্যম্পাসকে জানান, তাদের এই ট্রাফিক অ্যাসিট্যান্ট হিসেবে কাজ করতে পারায় দেশ ও জনসেবায় নিজেদের নিয়োজিত রাখতে পেরে ভালো লাগছে। এখান থেকে প্রতিদিন কাজের পর যে সম্মানী দেওয়া হয়, তা দিয়ে শিক্ষা খরচ দিয়েও পরিবারের জন্য কিছু টাকা পাঠাতে পেরে ভালো লাগে।

ধোলাইপার এলাকায় দায়িত্ব পালনকালে সবুজ নামের একজন ভলানটিয়ার বলেন, তারা ট্রাফিক সহায়তাকারী গ্রুপের সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু তার ট্রাফিক সহায়তাকারী গ্রুপের সদস্য না হলেও তাদের বেতন বা সম্মানী দেন অটোমালিক সমিতির পক্ষ থেকে। সেই টাকা দিয়ে তাদের লেখাপড়ার খরচ চলছে।

রবিউল নামের এক সদস্য বলেন, ‘আমরা এই কর্মে আসার পেছনে অর্থনৈতিক সংকটই মূল কারণ। আমরা কাজের বিনিময় টাকা পাচ্ছি বটে। কিন্তু যেহেতু এ পেশায় পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কোমর ও পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূব হয়। প্রতিনিয়ত গাড়ির শব্দে রাতে ঘুমাতে সমস্যা হয়। এ ছাড়া অটোরিকশা সিএনজিচালকদের দুর্ব্যবহার তো রয়েছেই।’

মহাখালীতে দায়িত্ব পালন করা মেহেদী হাসান নামের এক সদস্য জানান, এটি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য একটি আয়ের সুযোগ তৈরি করে। হাত খরচ, পড়াশোনার খরচ, বই কেনা বা ব্যক্তিগত হাতখরচ চালানোর জন্য আর্থিক স্বাধীনতা এনে দেয়। পাশাপাশি খরচ মিটিয়ে উপার্জনের মাধ্যমে ভবিষ্যতের জন্য হালকা কিছু টাকা সঞ্চয় করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।