০৭ আগস্ট ২০২২, ১১:০৪

রাশিয়া- ইউক্রেনের যুদ্ধবিরতি বাচাঁতে পারে বিশ্ব অর্থনীতি

মো. হাসান তারেক  © ফাইল ছবি

কোভিড মহামারি কাটিয়ে যখন স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল বিশ্ব ঠিক তখনই রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। শুরুর দিকে অনেকে ধারণা করেছিলেন যে, রাশিয়া হয়তো খুব দ্রুতই এই যুদ্ধে জয়লাভ করবে। কিন্তু, পরে দেখা গেল ইউক্রেনীয়দের প্রতিরোধের মুখে রাশিয়া কখনও পিছু হটেছে আবার কখনও এগিয়েছে।

যুদ্ধের এই জোয়ার ভাটায় অতিবাহিত হয়েছে পাঁচ মাসের অধিক সময়। দীর্ঘ সময়ব্যাপী চলমান এই যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে সারা বিশ্বব্যাপী। হু হু করে বেড়েছে জ্বালানি থেকে ভোজ্যতেলসহ সবকিছুর দাম। ১২ মিলিয়ন মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে রাশিয়া ও পশ্চিমাদের এই প্রক্সি যুদ্ধের কারণে।

ইউক্রেন ও রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম প্রধান দুটি খাদ্যশস্য সরবরাহকারী দেশ হওয়ায় বিশ্বব্যাপী খাদ্যসঙ্কট ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলনিয়সের গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে মোট গম উৎপাদনের ৩০ শতাংশ হয় ইউক্রেন ও রাশিয়ায়। ভূট্টা উৎপাদনের ২০ শতাংশ হয় রাশিয়া ও ইউক্রেনে। যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে, এই দুই দেশ থেকে খাদ্যপণ্য রফতানিব্যবস্থা সঙ্কটে পড়েছে।

তবে,আশার কথা হচ্ছে, তুরস্কের মধ্যস্থতায় ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে খাদ্যচুক্তি সম্পাদিত হওয়ায় কৃষ্ণ সাগরের বন্দরগুলোতে আটকে থাকা লক্ষ লক্ষ টন শস্যের মজুত রপ্তানি আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছে।

কিন্তু, এখন সবচেয়ে বেশি মাথাব্যাথার কারণ হচ্ছে রাশিয়ার তেল-গ্যাসের ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার ফলে সারাবিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম উর্ধ্বমুখী। যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে ভোগ্যপণ্যের ওপর। এশিয়া ও আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোতে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ও খাদ্য সঙ্কটের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা শুধু ছোট অর্থনীতির দেশগুলোতে নয় বড় অর্থনীতির দেশগুলোতেও নজিরবিহীনভাবে পড়তে শুরু করেছে।

আরও পড়ুন: নাগরিকদের শান্ত থাকার আহ্বান ইউক্রেন সরকারের।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গত এক বছরের ব্যবধানে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে প্রায় ১০৭ শতাংশ। দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতি সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ৬ হয়েছে। এদিকে, যুক্তরাজ্যের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি গত এপ্রিলে দশমিক ৩ শতাংশ কমেছে। অপর ইউরোপীয় দেশ জার্মানীতে, জ্বালানি খরচ বেড়ে গিয়েছে ৩০-৮০ শতাংশ। এই যুদ্ধ চলমান থাকলে আগামীতে সেটি দ্বিগুণ বা তিনগুণ হতে পারে বলে আভাস দিয়েছে দেশটির নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এই যুদ্ধের প্রভাব নিউইর্য়কের কফিশপ থেকে ঢাকার রাস্তার পাশের চায়ের দোকান পর্যন্ত পড়েছে। সর্বত্র প্রভাব বিস্তারকারী এই যুদ্ধের সমাপ্তি জরুরি হলেও কোন পক্ষই হাল ছেড়ে দিতে রাজি নয়।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন মনে করছেন কৌশলগত ধৈর্য ধারণ করার মাধ্যমে তিনি লাভবান হবেন। কারণ, দীর্ঘ যুদ্ধের ফলে পশ্চিমা দেশগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়বে এবং তারা নিজেদের অর্থনৈতিক সঙ্কট সামাল দিতে চাইবে, পাশাপাশি চীনের অব্যাহত হুমকির ব্যাপারে অধিক মনোযোগী হবে। তবে, কার্যত পশ্চিমারা এমনটি করছে না। তারা আরো দৃঢ় সংকল্পের পরিচয় দিচ্ছে এবং জয়ী হবার ইচ্ছায় ইউক্রেনে আরো অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে।

কিন্তু, এই দুইপক্ষের নাছোড়বান্দা অবস্থানের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু হয়েছে বিশ্ব অর্থনীতি , দরিদ্ররা আরো দরিদ্র হচ্ছে। এখন কথা হচ্ছে, কিভাবে হতে পারে এই যুদ্ধের সমাধান ? পশ্চিমারা কি ধরনের সমাধান চাইছেন ? তারা কি চাইছেন ইউক্রেন থেকে রাশিয়ার সকল সৈন্য প্রত্যাহার হোক ?  কোন ধরনের ছাড় নয়। যদি পশ্চিমারা এমনটি চায় তাহলে এই যুদ্ধ চলতেই থাকবে। এই যুদ্ধ চলমান থাকলে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ বেশি হতে পারে। বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে দরিদ্র দেশগুলো। তাহলে যৌক্তিক সমাধান কী ?

প্রথম সমাধানের উপায় হতে পারে, দ্রুত সময়ের মধ্যে যুদ্ধবিরতি। বিশ্ব অর্থনীতি এতে বাঁচার সম্ভাবনা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, রাশিয়ার সাথে আলোচনা শুরু করা যেতে পারে। এই আলোচনা হতে পারে দুই স্তরে । প্রথম স্তরে, আলোচনা হতে পারে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে। দ্বিতীয় স্তরে, আলোচনা হতে পারে রাশিয়া ও পশ্চিমাদের মধ্যে।

যদি এই আলোচনা সফল করা যায়, ইউক্রেনীয়দের জীবন যেমন বাঁচবে, তেমনি বিশ্ববাসীও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে। এমনটি কি হতে পারে ? অবশ্যই, কেন নয় ? তুরস্ক যদি মধ্যস্থতা করে ইউক্রেন ও রাশিয়াকে খাদ্য চুক্তি সম্পাদনে সম্মত করতে পারে তাহলে যথাযথ উদ্যোগের মাধ্যমে এই প্রচেষ্টাকে আলোর মুখ দেখানো সম্ভব।
 
কেননা, রাজনীতিতে শেষ বলে কোন কথাই নাই। সমঝোতায় রাজনীতির সর্বশ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য্য। যে সমঝোতায় কিনা সকলের কিছু প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকে। আশা থাকবে , সমঝোতাই পথ দেখাবে বিবাদ নিষ্পত্তির।

লেখকঃ মো. হাসান তারেক
শিক্ষক ও কলামিস্ট