২১০০ সালের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার শক্তি হবে হাইড্রোজেন জ্বালানি
জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্য সামগ্রিক অর্থনীতির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। আমাদের দেশে জ্বালানি তেল নেই, গ্যাস যা আছে তাও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তাই প্রয়োজনীয় জ্বালানি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বৈশ্বিক সংকটে পণ্যগুলোর মূল্য বৃদ্ধি পেলে দেশের অর্থনীতি অস্হিতিশীল অবস্থার দিকে ধাবিত হয়।
একটি জাতীয় দৈনিকের খবরে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জ্বালানির দাম বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, আমরা ছয়-সাত মাস ধরে তেলের মূল্যে ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করছি। যে তেল বাংলাদেশ ৭০ থেকে ৭১ ডলারে কিনতো কিন্তু তা এখন ১৭১ ডলারে কিনতে হচ্ছে। তেলের ক্ষেত্রে প্রতি দিনই সরকার বিশাল অঙ্কের অর্থ ভর্তুকি দিচ্ছে। পার্শ্ববর্তী দেশ তেলের ক্ষেত্রে প্রতি লিটারে ৩৫ থেকে ৫০ টাকা বাড়িয়েছে। আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রগুলোর ৬৪ শতাংশ চলে গ্যাস দিয়ে। আমাদের গ্যাসও অপ্রতুল এবং ধীরে ধীরে তা শেষ হয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্হায় ভবিষ্যতের সঠিক পরিকল্পনাই আমাদের জ্বালানি খাতকে সংকটমুক্ত রাখবে। বিশ্ব এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে। ২০১৫ সালের একটি তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীতে খনিজ তেলের মজুত রয়েছে ৫০ বছরের, প্রাকৃতিক গ্যাস ৫৩ বছরের এবং কয়লা ১১৪ বছরের। এর পর উন্নত বিশ্বের দেশগুলো পারমাণবিক শক্তির ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। নবায়নযোগ্য আরো একটি জ্বালানি নিয়ে উন্নত বিশ্ব কাজ করছে। তা হলো হাইড্রোজেন।
আজ থেকে প্রায় ১৩৭ বছর আগে ফ্রান্সের বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞানী জুলভার্ন বলেছিলেন যে, মানুষ একদিন চাঁদে পদার্পণ করবে। সেই ভবিষ্যদ্বাণী আজ সত্য হয়েছে। তিনি আরো একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, একদিন জীবাশ্ম জ্বালানির স্হান দখল করবে পানি। মানুষের বিস্ময়কর গবেষণামনস্কতার স্পর্শে ভার্নের এ ভবিষ্যদ্বাণীও যে একদিন সত্যে রূপান্তরিত হবে, সেই বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
হাইড্রোজেন গ্যাস পানির সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে আছে। পানির একটি অণুর মধ্যে তিন ভাগের দুই ভাগই হাইড্রোজেন। পানির এই দুই উপাদানকে তড়িৎ বিশ্লেষণের সাহায্যে সহজেই পৃথক করে ফেলা যায়। এই প্রক্রিয়ায় হাইড্রোজেন সংগ্রহের কাজে প্রধান সমস্যা হলো, প্রচুর পরিমাণ বিদ্যুৎ শক্তির প্রয়োজনীয়তা, যা উত্পাদনে আবার অন্য প্রকারের শক্তির প্রয়োজন। তবে অল্প শক্তি ব্যয়ে কীভাবে হাইড্রোজেন উত্পন্ন করা যায়, সে সম্পর্কেও বিশ্বে গবেষণা চলছে। হাইড্রোজেন একটি সহজদাহ্য পদার্থ। এটি জ্বালানো হলে, নিরুপদ্রব জলীয় বাষ্প ছাড়া অন্য কিছু নির্গত হবে না। ফলে পরিবেশ একেবারেই দূষণমুক্ত থাকবে।
মহাকাশ গবেষণায় হাইড্রোজেনকে শক্তির উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। অ্যাপোলো চন্দ্রযানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে হাইড্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করা হয়েছিল। পেট্রোলিয়াম সমৃদ্ধ দেশ সৌদি আরবও হাইড্রোজেনকে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। চীন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ভারত, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার ভবিষ্যৎ অর্থনীতির ভিত্তি হবে হাইড্রোজেন। হাইড্রোজেন জ্বালানির সার্বিক ব্যবহার বাড়াতে জার্মানিতে একটি মডেল প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। জার্মানির এই মডেল প্রকল্পের আওতায় উত্তরাংশের একটি অঞ্চলে জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানি পুরোপুরি বর্জন করার চেষ্টা চলছে।
শুধু হাইড্রোজেনের ওপর নির্ভর করে এটা করা হচ্ছে। এই প্রকল্পে হাইড্রোজেনচালিত বাস নিয়মিত যাত্রী পরিবহনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই সংকটকালে জ্বালানি হিসাবে হাইড্রোজেনের ব্যবহার নিয়ে নতুন উদ্যমে আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশ্বে ৩৫০টির বেশি প্রকল্প চলমান রয়েছে হাইড্রোজেন নিয়ে। ২০৩০ সাল নাগাদ এই গ্যাসের পেছনে সর্বমোট বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০০ বিলিয়ন ডলার। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বছরে ৬০০ বিলিয়ন ডলারের হাইড্রোজেন বিক্রি হতে পারে। বর্তমানে ১৫০ বিলিয়ন ডলার হাইড্রোজেন বিক্রি হয়। বিশ্বের কার্বন নিঃসারণের ৮ শতাংশের জন্য দায়ী ইস্পাতশিল্প। এই শিল্পে কাজ করতে হয় কয়লা পুড়িয়ে। বায়ুশক্তি দিয়ে কয়লাকে প্রতিস্হাপন করা না গেলেও হাইড্রোজেন দিয়ে করা যাবে। ২০২০-এর আগস্টে হাইড্রোজেন জ্বালানি দিয়ে তৈরি বিশ্বের প্রথম সবুজ ইস্পাত বিক্রি করেছে সুইডিস প্রতিষ্ঠান হাইব্রিট।
সরকারের উচিত, জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেনের ব্যবহারকে উৎসাহিত করা। হাইড্রোজেনের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও পরিচ্ছন্ন জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধিতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। হাইড্রোজেনের ব্যবহার ও উত্পাদন যদি আমাদের লক্ষ্য হয়, তাহলে কর্মপন্থা হওয়া উচিত পানি থেকে হাইড্রোজেন পৃথকীকরণের সহজলভ্য ও কম খরচের পদ্ধতি আবিষ্কারের নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। গবেষণায় অভিজ্ঞতা অর্জনে আমাদের যুক্ত হতে হবে সেই দেশগুলোতে, যারা হাইড্রোজেন ব্যবহারে অনেকাংশে এগিয়েছে।
প্রথম বারের মতো হাইড্রোজেন জ্বালানি উত্পাদন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্পগবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর)। একটি প্রকল্পের আওতায় ২০২২-এর জুন থেকে পরিবেশবান্ধব ও নবায়নযোগ্য এই জ্বালানি উত্পাদনের প্রস্ত্ততি নেওয়া হচ্ছে। বিসিএসআইআরের তথ্যানুযায়ী, গৃহস্হালি আবর্জনা ও পানি যথাক্রমে বায়োমাস গ্যাসিফিকেশন এবং তড়িত বিশ্লেষণ (ইলেকক্টে্রালাইসিস) প্রক্রিয়ায় জ্বালানিতে রূপান্তর করা হবে। এর জন্য বিসিএসআইআর ইতিমধ্যে একটি প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে।আরেকটি ইউনিট স্থাপনের কাজ পূর্ণোদ্যমে চলছে।
আমার মতে, এই প্রকল্পকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেখানে নবায়নযোগ্য শক্তির ইনস্টিটিউট আছে এবং যেখানে রসায়নবিদ্যার দক্ষ জনবল ও শিক্ষক আছে, সেখানে এ ধরনের আরো ইউনিট খোলা যেতে পারে। এতে গবেষণার কাজ ত্বরান্বিত হবে। আমি বিশ্বাস করি, সরকার হাইড্রোজেনের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধিতে বদ্ধপরিকর। শুধু দরকার সঠিক কর্মপম্হা নির্ধারণ। এ সংক্রান্ত প্রকল্পগুলোতে জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে হতে হবে সর্বোচ্চ সতর্ক। কারণ জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে যে অবৈধ ও অনৈতিক চাপ থাকে সেই চাপের কাছে নতি স্বীকার করলে এ ধরনের প্রকল্পগুলো শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ৩০ বছর পিছিয়ে যাবে।
আজকের নিয়োগকৃত একজন অযোগ্য ব্যক্তির চাকরি তদবির বা অন্যকিছুর মাধ্যমে হলে ঐ ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানকে কিছু দিতে পারে না বরং তার চাকরির ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত সে প্রতিষ্ঠানকে অন্তত ৩০ বছর পিছিয়ে দেয়। ফলে সমগ্র গবেষণার প্রক্রিয়াটাই পশ্চাত্পদতার একটি অনন্ত চক্রের মধ্যে আবর্তিত হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো প্রতিষ্ঠানের সাফল্য মাত্র ২০ ভাগ নির্ভর করে তার ভৌত অবকাঠামোর ওপর আর ৮০ ভাগ নির্ভর করে ঐ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগকৃত জনবলের মেধা, দক্ষতা, সততা ও নিষ্ঠার ওপর।
আমার মতে, ২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশ এবং ২১০০ সালের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার শক্তি হবে হাইড্রোজেন জ্বালানি। তাই সঠিক পরিকল্পনা করি, জ্বালানিসমৃদ্ধ ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গড়ি।
লেখক: উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়