২০ জুলাই ২০২২, ২১:৫৮

এতো বিদ্যুৎ গেল কই?

সজীব ওয়াফি  © টিডিসি ফটো

কিছুদিন আগে পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে শতভাগ বিদ্যুতায়িত ঘোষণা করা হলো। তারও আগে সাংসদ সদস্যসহ দায়িত্বশীল কতৃপক্ষ জানালেন বাংলাদেশ এখন বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং উদ্বৃত্তের দেশ। এটা খুবেই আশা-আকাঙ্ক্ষার বিষয়। কেননা যারা গত বিএনপি-জামাতের শাসনামল দেখেছে, লোডশেডিং কি সেটা হাড়ে হাড়ে জানে।

কিন্তু ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ফূর্তি করা উদ্বৃত্তের দেশে হঠাৎ সরকারের উপরস্থ মহল থেকে লোডশেডিং-এর নির্দেশ আসলো কেন! বিদ্যুতের উদ্বৃত্ত বিষয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সংসদ সদস্য বলেছিলেন বিদ্যুৎ কারো লাগবে না, উদ্বৃত্ত জিনিস ফেরিওয়ালারা খদ্দেরের কাছে বিক্রির জন্য ঘুরে বেড়াবেন। হঠাৎ করে এতো এতো বিদ্যুৎ তাহলে গেল কই?

দেশের জ্বালানি পন্যের বিরাট অংশই আমদানি নির্ভর। জ্বালানি তেল, তরল প্রকৃতিক গ্যাস, পেট্রোলিয়াম পুরোটাই অন্য দেশ থেকে কিনতে হয়। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যার ধ্বস নেমেছে। অন্যদিকে ডলার সংকটে জ্বালানি তেল আমদানিতে ঋণপত্র খুলতেও বানিজ্যিক ব্যাংকগুলোর গড়িমসি। সহজে এই দুরবস্থা যে কাটছে না সেটা স্বীকার করেছে দায়িত্বে থাকা স্বয়ং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)।

বিদ্যুৎ উৎপাদন জ্বালানির উপর নির্ভরশীল হওয়ায় বিপর্যয়ে মুখোমুখি হয়েছে বিদ্যুৎ খাত। জ্বালানি খাতের সংকটের জন্য সরকারপক্ষ থেকে সতর্কতার সাথে নেওয়া হয়েছে বেশকিছু পদক্ষেপ। দেওয়া হবে এলাকা ভিত্তিক লোডশেডিং, আছে সরকারি-বেসরকারি বৈঠক ভার্চুয়ালি করার সিদ্ধান্ত, পেট্রোল পাম্প বন্ধ থাকবে সপ্তাহে একদিন। রাত ৮ টার পর বন্ধ থাকবে দোকানপাট, শপিংমল। চিন্তা করা হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি অফিস এক থেকে দুই ঘন্টা কমিয়ে আনার। 

আপাতত এই লোডশেডিং এক ঘন্টা হলেও ভবিষ্যতে যে বাড়বে সেই শঙ্কা এখনই আঁচ করা যাচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব যে উৎপাদন খাতে পরছে, অর্থনীতিতে পরছে এটা বাস্তব।

জ্বালানি সংকটের পরিনতিতে প্রবেশের আগে আমাদের পায়ের নিচের গ্যাস সম্পর্কে একটু ঘুরে আসা যাক। গ্যাস এবং ডিজেল দিয়ে বর্তমানে দেশের অধিকাংশ প্লান্টে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। আমাদের আছে বেশকিছু সংখ্যক গ্যাসক্ষেত্র। নতুন গ্যাস সন্ধানের সম্ভাবনাও আছে, আছে সামুদ্রিক ব্লকের নানা সম্ভাবনা। কিন্তু আমরা সেগুলোকে কখনোই কাজে লাগানোর পথে যাইনি।

আরও পড়ুন: বিদ্যুত ব্যবহার ২৫ শতাংশ কমানোসহ সরকারের ৭ সিদ্ধান্ত

দেশীয় মালিকানায় স্থলভাগ এবং সমুদ্রভাগের গ্যাস উত্তোলন করা আমাদের চিন্তার বাইরে। উত্তোলন করার মতো দক্ষ জনশক্তি প্রস্তকরণেও যাচ্ছেতাই অবহেলা। বরং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সেগুলো অন্য রাষ্ট্রের কাছে প্রতিনিয়ত বিক্রি হয়, গলা টিপে ধরা হয় নতুন নতুন সম্ভাবনা। আবার মাথার উপর বছরের অধিকাংশ সময় সূর্যের প্রচন্ড তাপ। সারা পৃথিবী যেখানে নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে ছুটেছে, সেখানে আমরাই কেবল বিদেশ নির্ভর হয়েছি।

আমরা এমনভাবে আমাদের সমস্ত সম্ভাবনাময় খাত বিকিয়ে দিয়েছি যে পঙ্গু হওয়ার দশা। আমরা দ্রুত ধনী রাষ্ট্র হওয়ার পাল্লা দিয়েছি অন্যের উপর নির্ভর করে! যে দেশে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ চালনা করার মতো জ্বালানি অথবা কাঁচামাল নিশ্চিত না করে, নির্ভর করতে অন্যদের উপর; সে দেশে ব্যক্তিগত গাড়ির রমরমা বানিজ্য।

আমাদের হুঁশ নেই ভবিষ্যতে জ্বালানির টান লাগতে লাগতে পারে। এই গাড়িগুলো চলবে কিসে সেই পরিকল্পনা অনুপস্থিত। পরিবেশ উপযোগী বাড়িঘর তৈরীতে উৎসাহিত না করে সুবিধা দেওয়া হলো এয়ার কন্ডিশনার আমদানিতে। আমদানি সুবিধা বন্ধ না করে জনগণকে এয়ার কন্ডিশন বন্ধ করতে বলা তামাশার সামিল।

জ্বালানি খাতে বিশেষ করে গ্যাস বিদ্যুতের টান তৈরি হলে তার বিরূপ প্রভাব গিয়ে পরে উৎপাদনে। জটিলতা তৈরি হবে কৃষকের সেচ কাজে। পরিবহন খাতের ৯০ শতাংশ যানবাহন জ্বালানি নির্ভর হওয়ায় তৈরি হবে নৈরাজ্য। উৎপাদনে যে নিশ্চিত প্রভাব পরতে যাচ্ছে তা তো সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্তেই স্পষ্ট। উৎপাদন কমলে সেই দ্রব্যের চাহিদা বাড়বে, চাহিদা তৈরি হলে বাড়বে দ্রব্যমূল্য।

মুদ্রাস্ফীতির সমস্যা তো আমরা বর্তমানেই টের পাচ্ছি, দ্রব্যমূল্যের এই নাভিশ্বাস আরো কি পর্যায়ে উঠবে সেটা অকল্পনীয়। উৎপাদন সংকট মোকাবিলায় সকল পন্যের আমদানি আরো বাড়বে; ডলার সংকটে তৈরি হবে রাষ্ট্রীয় দুর্গতি! ক্রমে ক্রমেই অগ্রসরমান হবে নিম্নবিত্ত গরিব খেটে খাওয়া মানুষের মৃত্যুর উপত্যকায়!

দেশে বড় বড় বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র যার অন্যতম। রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র এখনো চালু হয়নি। পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলো এ বছরের প্রথমভাগে। যার উৎপাদন সক্ষমতা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট। পাশাপাশি এ বছরের শেষ নাগাদ চালু হতে পারে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র। অপেক্ষমাণ আছে মাতারবাড়ীসহ আরো কয়েকটি।


রূপপুর বাদে এই সকল বিদ্যুৎ কেন্দ্র কয়লা নির্ভর হলেও কয়লা তুলতে আমাদের পর্যাপ্ত প্রযুক্তি জ্ঞান নেই। ফলতঃ ভারত থেকেই আমাদের কয়লা আমদানি করতে হবে। সারা পৃথিবী যখন পরিবেশ বিধ্বংসী কয়লা এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সরে আসছে, খোদ ভারত নিজেদের কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দিচ্ছে তখন আমারা একটার পর একটা কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র করে যাচ্ছি, পারমাণবিক শক্তিতে জোর দিয়েছি।

পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে পারমাণবিক ও কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিরোধী আন্দোলন দেশজুড়ে সারা ফেলেছিলো। সেদিক থেকে ঐ সকল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করতে বর্তমান লোডশেডিং জনসমর্থন পাওয়ারও কার্যকরী কৌশল। নিজের কোমর ভেঙ্গে আমরা কেবল পর নির্ভরতাই শিখলাম!

যাহোক জ্বালানি পন্যের এই জটিলতা কাটানোর তবে উপায় কী? সোজা কথায় সাশ্রয়ী হতে হবে। মোটাদাগে বললে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্য করতে হবে। কেননা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা জনসাধারণ বিদ্যুৎ বিল নিজের পকেট থেকে পরিশোধ করে। ফলে তাদের বিদ্যুৎ অপচয়ের প্রবণতা কম, অপচয় যা হওয়ার তা কেবল সরকারি নানান কিসিমের প্রতিষ্ঠানে হয়। অফিস এবং আবাসিকতায় সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ করতে হবে এয়ার কন্ডিশনার।

যে সকল গ্রাহক এই বাধ্যবাধকতা মানবেন না, কঠোর হস্তক্ষেপ করার জন্য শুধুমাত্র তাদের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করতে কার্যকরী ব্যবস্থা জরুরি। বাঙালির দেশে ইংরেজি কায়দার স্যুট-টাইটা খুলে ফেলুন, দেখবেন অফিসিয়াল এয়ার কন্ডিশনের প্রয়োজনীয়তার অর্ধেক সমস্যা সমাধান। শিল্প ও বানিজ্যিক অঞ্চল নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ চালু রাখতে গ্রাম এবং আবাসিক এলাকায় সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রাখা যেতে পারে, কিন্তু এলাকা ভিত্তিক লোডশেডিং দেওয়া সমীচীন হবে না। এতে বরঞ্চ সবকিছু বুমেরাং হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

গুরুত্বপূর্ণ ল্যাম্পপোস্ট ব্যতীত সারাদেশের সকল আলোকসজ্জা বন্ধকরণ, বিশ্ববিদ্যালয় হলগুলোতে রান্না করার বৈদ্যুতিক হিটার তুলে নেওয়া; এমনকি ব্যক্তিগত গাড়িতে জ্বালানি সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে পাবলিক পরিবহন ব্যবহার করতে উৎসাহিত করা সংকটকালীন সময়ের যথোপযুক্ত পদক্ষেপ।

জোড় বিজোড় নাম্বার অনুযায়ী গাড়ির ব্যবহার জনগণের জন্য অতিরিক্ত ভোগান্তি তৈরি করবে। তাতে জনরোষ বাড়বে বৈ কমবে না। সুতরাং এই সকল আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে দূরে থাকাই বাঞ্ছনীয়। বিদ্যুতের মাধ্যমে ব্যাটারি চালিত ভ্যান-রিকশা নিয়ন্ত্রণ উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা রাখতে হবে। কুইক রেন্টাল বন্ধ করে সৌরশক্তি প্রযুক্তির প্রাধান্য দিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করতে প্লান্ট নির্মানের দায়িত্ব রাষ্ট্রীয়।

রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তি পর্যায়ে ক্রমেই গাছপালা-বনের বিনাশ ঘটছে, জলবায়ুর পরিবর্তন এবং আধুনিক নানা যন্ত্রপাতি চলানায় বিদ্যুতের চাহিদা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাবে। অথচ আমাদের কোন স্থায়ী পরিকল্পনা না থাকা দুঃখজনক! কোভিড-১৯ মহামারী আমাদের শিখিয়েছে কিভাবে সামষ্টিক লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়। জ্বালানির মাধ্যমে অর্থনীতির সম্ভাব্য বিপর্যয়ে প্রবেশ মোকাবিলার এই ক্ষেত্রেও সে পথেই হাটতে হবে।

যে উন্নয়ন পরিকল্পনা দূরদর্শিতার অভাবে হাওয়া হয়ে যায়, জনগণ সেই উন্নয়ন কখনোই চায়নি। রাজনৈতিক চালবাজি না করে দূরদর্শী পরিকল্পনার কার্যক্রম বাস্তবায়ন সময়ের দাবি। নতুবা গণতন্ত্রহীন সিদ্ধান্তে আমরা সমূহ বিপদের সম্মুখীন। গণতান্ত্রিক সংকটকে পুঁজি করে যারা অর্থনীতিতে শ্রীলঙ্কার স্বপ্ন দেখছেন তা কেবলই বাতুলতা, নিজ পায়ে কুড়াল মারা। সাধারণ নাগরিক, সরকারি দল এবং সরকার বিরোধী সকলের বোধদয় কাম্য।

লেখক: প্রাবন্ধিক, ঢাকা