১৭ জুন ২০২২, ১৪:৪৮

বেতনবিহীন শিক্ষকের কাছে উৎসব মানে হাহাকার

মো. মমিনুল হক সরকার  © টিডিসি ফটো

বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের অন্যতম একটি ঘোষণা প্রত্যেকটি উপজেলার একটি কলেজ ও একটি স্কুল সরকারিকরণ করা। তার ধারাবাহিকতায় সারা বাংলাদেশে ধাপে ধাপে ৩৩০টি কলেজ ও ৩৩৫টি স্কুল সরকারিকরণ করে ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট গেজেট প্রকাশিত হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আজ পর্যন্ত শিক্ষক-কর্মচারীগণ সরকারিকরণের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

এরই মধ্যে অসংখ্য শিক্ষক-কর্মচারী সরকারিকরণের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে খালি হাতে বুকে চাপা যন্ত্রণা নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে ফিরেছেন। সেই সাথে স্কুল কলেজগুলো হয়েছে শিক্ষক শুন্য, কেননা সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে শুন্য পদগুলোতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষা, ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে শিক্ষার্থী।

শিক্ষার্থীদের অপূরণীয় ক্ষতি কিছুটা পূরণের লক্ষ্যে পার্টটাইম শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনার মহান এই উদ্দ্যোগ কেন যে, ভঙ্গুর অবস্থায় কচ্ছপ গতিতে চলমান তা বাংলার মানুষের কাছে একটি বিরাট প্রশ্ন।

যেহেতু স্কুল-কলেজগুলো ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট জাতীয়করণের গেজেটভুক্ত হয়েছে, সে কারণে সদ্য জাতীয়করণকৃত কলেজে কর্মরত সকল বিষয়ের তৃতীয় শিক্ষকগণ ননএমপিও থেকে গেছেন। যদিও সরকারের সংশ্লিষ্ট উদ্ধর্তন কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের সকল বেসরকারি কলেজের তৃতীয় শিক্ষকগণের এমপিওভুক্ত করার জন্য আদেশ জারি করেন। কিন্তু সদ্য সরকারিকরণকৃত কলেজগুলোর তৃতীয় শিক্ষকগণের নাম ছেঁটে দিয়ে বাকি সব বেসরকারি কলেজের তৃতীয় শিক্ষকগণের এমপিও-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: ননএমপিও শিক্ষকদের জন্য ৪৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেন প্রধানমন্ত্রী

ভাবতে অবাক লাগে, শিক্ষক নাকি জাতির বিবেক? শিক্ষক নাকি আলোক বর্তিকা, শিক্ষক জাতির দর্পন, শিক্ষক মানবতার প্রতীক এভাবে নানা নামে বিশেষায়িত করা হয় শিক্ষক সমাজকে।

সদ্য জাতীয়করণকৃত কলেজের তৃতীয় শিক্ষকগণ এমপিও হওয়ার জন্য উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করলে তাঁরা বলেন, আপনারা সরকারি তাই আর এমপিওভুক্ত করার আদেশ নাই। জাতি আজ  জানতে চায় যারা এমন আদেশ জারি করেন তাঁরা কি শিক্ষক ছাড়াই এমন বড় বড় আসনে অবস্থান করছেন? নাকি তাঁরা জন্মের পরপরই আসনটি পেয়েছেন।

সদ্য সরকারি করণকৃত কলেজের ননএমপিও (তৃতীয় শিক্ষক) দীর্ঘ ১৫-১৬ বছর ধরে বিনা বেতনে পাঠদান করে আসছেন। তাদের ও পরিবার-পরিজন, সংসার, বাবা-মা, ভাই-বোন আছেন। তাঁদেরও ইচ্ছা করে স্ত্রী-পুত্র, বাবা-মা, ভাই-বোনকে খুশি করতে বিভিন্ন উৎসবে। বৃদ্ধ বাবা-মা যখন ননএমপিও (তৃতীয় শিক্ষক)-কে বলে আমার ওষুধ নাই, জামা নাই। সন্তান যখন বলে, বাবা আমার খাতা, কলম, জামা নাই। স্ত্রী যখন বলে, তার শাড়ী প্রয়োজন তখন একজন ননএমপিও (তৃতীয় শিক্ষক) এর কি বা করার থাকে।

সে তো একজন শিক্ষক, ডিগ্রী পর্যায়ে অনেক ছাত্র-ছাত্রীর সাথে তার পরিচয় আছে। পারে না সে শ্রমিক হতে, পারে না সে রাহাযানি করতে। সে শুধু পারে বুক চাপা দিয়ে কাঁদতে তাও আবার লুকিয়ে কেহ যেন তা দেখতে না পায়। (তৃতীয় শিক্ষক) কি এমন অপরাধ করেছে যে, তারা এমন জীবন-যাপন করবে?

বিগত ২০২০-২০২১ সালে করোনাকালীন সময়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেন যে, সদ্য জাতীয়করণকৃত কলেজে কর্মরত ননএমপিও (তৃতীয় শিক্ষক) গণকে যেন প্রতিষ্ঠান থেকে ছয় মাসের বেতন প্রদান করা হয়। কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয় অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধান এই প্রজ্ঞাপনকে আমলেই নিলেন না।

এই প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর অনুসন্ধান করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন উপ-সচিব মহোদয়কে শনাক্ত করে তাঁর সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি শিক্ষার ডিজি মহোদয়ের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। শিক্ষার ডিজি মহোদয়ের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি আঞ্চলিক শাখার ডিডি মহোদয়ের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। ডিডি মহোদয়ের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি শুনে কোন সমাধান তো দিলেনই না বরং তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে বিদায় দিলেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে প্রজ্ঞাপনের কোন মূল্য নাই সে প্রজ্ঞাপন জারি করার কি প্রয়োজন ছিল? অর্থ নাই বা বেতন নাই তাই ভালো ছিল, এমন মিথ্যা আশা জাগিয়ে লাভ কি ছিল? ছয় মাসের বেতন পাবে এই আশায় আশান্বিত হয়ে এই অবোধ (তৃতীয় শিক্ষক) তাঁর বৃদ্ধ বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী, পুত্র-কন্যাকে আবার প্রতারণা করবে কে জানত? প্রতি বছর অন্যান্য শিক্ষক-কর্মচারীর ন্যায় ননএমপিও শিক্ষক কর্মচারীরও বিভিন্ন উৎসব আসে। তারা ভাবে এবারে তো বেতন বোনাস পেলাম না হয়তো সামনের বার অবশ্যই পাব। তখন পূর্বের সমস্ত শূন্যতা পূরণ করব। তা আর হয়ে উঠে না।

এবারেও পূর্বের মতো অবস্থা। উৎসব মানে আনন্দ, উৎসব মানে খুশি, ঈদ মানে নতুন জামা, উৎসব মানে অনেক কিছু। কিন্তু একজন বেতন-বিহীন শিক্ষকের কাছে উৎসব মানে সমস্যার দিন, উৎসব মানে হাহাকার, উৎসব মানে তিরস্কার, উৎসব মানে ধিক্কার, সন্তানের কাছে অযোগ্য পিতা, স্ত্রীর কাছে কাপুরুষ, বাবা মায়ের কাছে অপদার্থ সন্তান।

অনেকের কাছে প্রশ্ন হতে পারে আপনারা কেন এই পেশায় নিয়োজিত আছেন? যেখানে বেতন নাই। তাঁদের জন্য বলতে ইচ্ছে করে বিগত ১৫/১৬ বছর শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থাকার পর আর কোন পেশায় যাওয়ার রাস্তা আছে দয়া করে জানাবেন।

লিখতে গিয়ে দু’চোখ ঝাপসা হয়ে আসতেছে। চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারছিনা। ভাষাগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আসলে বেতন-বিহীন শিক্ষকের লেখা কি পত্রিকায় ছাপানো হবে? কেননা, যে বেতন-বিহীন শিক্ষকের সমাজে কোন মূল্যায়ন নাই। পরিবারে মূল্যায়ন নাই, তার আর কোথায় যায়গা আছে- যে বাংলাদেশে ভিক্ষুক অনুদান পায়, দরিদ্র সাহায্য পায়, অভাবী তার অভাব নিবারনের জন্য রেশন কার্ড পায়।

সে বাংলাদেশে ১৫/১৬ বছর যাবৎ বিনা বেতনে শিক্ষার্থীদের কষ্টের হাসি মুখে, অভিনয়ের হাসি হেসে বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে পাঠদান করে যাচ্ছে। যারা বেতন-বিহীন শিক্ষক তাঁরা আন্দোলনও করতে পারে না। পারে না অনলাইনে জুম মিটিং করতে। কেননা, নাই তাদের স্মার্টফোন, নাই ফোন কেনার মতো টাকাও।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে ইদানিং কালে সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছে যে, সদ্য জাতীয়করণকৃত কলেজের অধ্যক্ষগণ অনেক দুর্নীতির সাথে জড়িত। কারো নামে ১ কোটি, কারো নামে অর্ধকোটি টাকা অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তারা আবার স্ব-পদে বহাল থেকে যথারীতি বহাল তবিয়তে আছেন।

এমনি একটি দেশে আমাদের বসবাস। যেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনেত্রী, বঙ্গবন্ধুর দেশরত্ন শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন সেখানে এমন অন্যায় দুর্নীতি করে কিভাবে এখনো বুক ফুলে ঘুরে বেড়ান আমার বোধগম্য নয়। আর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাবৃন্দ মুখে আঙুল চুষছেন? অবাক বাংলাদেশ অবাক কর্মকর্তা।

“বাংলাদেশে থাকি মোরা
বাংলায় গান গাই-
নন-এমপিও শিক্ষক মোরা
কোথাও জায়গা নাই।”

তাই আমরা হতাশায় পর্যবসিত হয়ে বলতে চাই-

“আর চাই না সরকারি, বে-সরকারি দরকার
সরকারির আশায় থাকলে জীবন হবে ছারখার।”

জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাছিনা সরকারের সীমাহীন উন্নয়নের পাশাপাশি নন-এমপিও শিক্ষকগনের জীবনমান উন্নয়ন করতে এই সরকার শিক্ষাখাতের এই ক্ষুদ্র অংশটির প্রতি দৃষ্টি আর্কষণ করবেন বলে আমি আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
 
লেখক: প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, বদরগঞ্জ সরকারি কলেজ, রংপুর