বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় সমন্বয় সময়ের দাবি
বৃষ্টিস্নাত একটা দিনে সারাদিন অন্যের জমিতে কাজ করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলেন কৃষক রমিজ মিয়া। ইদানীং রমিজ মিয়া নিজের শরীরের সাথে পেরে উঠছেন না। তবুও রোদ কিংবা ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে জমি কর্ষণ করে ছেলেমেয়ের পড়ালেখার খরচ এবং পরিবারের ভরণপোষণ চালান। কষ্ট হয় তবুও তিনি নাছোড়বান্দা। নিজেকে একটু বিশ্রাম দিবে তার কোন অবকাশ নেই। তবে, এর পেছনে অন্যান্য কারণ এর পাশাপাশি মূখ্য একটা কারণ হলো- তার চতুর্থ মেয়ে নিহা এবার বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা দেবে।
তার বহুদিনের লালিত স্বপ্ন পাঁচ সন্তানের কেউ একজনকে হলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো, সরকারি উচ্চ কর্মকর্তা বানানো, দেশসেবায় নিয়োজিত করানো। কেউ না পারলেও নিহা অন্তত তার দ্বারপ্রান্তে যাবে এই আকাঙ্ক্ষা রেখেই তাকে নাছোড়বান্দা হতে হলো। কারণ এই সময়টাতে তার মেয়ের জন্য অনেক টাকার দরকার হতে পারে। অতএব, নিহার কথা ভেবে নিজের শরীর নিংড়ানো পরিশ্রম করতে একটুও কুন্ঠাবোধ করেনা কৃষক রমিজ মিয়া।
যাইহোক, জাতি গঠনের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ারের অন্যতম হলো শিক্ষা। জন্মলগ্ন থেকে আমৃত্যু প্রাতিষ্ঠানিক অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সান্নিধ্য আমরা পেয়ে থাকি। তবে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় মূলত প্রাইমারি স্কুল থেকে। তারপর ক্রমান্বয়ে মাধ্যমিক, কলেজ পার করে 'গ্রেজুয়েট' ট্যাগ লাগাতে নামতে হয় গভীর সমুদ্রে, স্রোতে ঘূর্ণন খেতে খেতে পাড়ি দিতে হয় সহস্র ঢেউ এর তীব্রতা। তবে, এই পর্যায়ে পা দেওয়ার সূচনালগ্নে কেউ কেউ ঝাপিয়ে পড়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের একটা আসন নিশ্চিত করার। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা শুধু পরীক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটা একটা গোলকধাঁধা, একটা যুদ্ধক্ষেত্র, একটা মিলনকেন্দ্র যেখানে সহস্র ঢেউ এর আবির্ভাব ঘটে। সবেমাত্র কলেজ শেষ করে এই নির্ঝঞ্ঝাট পথ পাড়ি দেওয়া কতটা কঠিন, এটা শুধু তাঁরাই জানে যারা নেমেছে। এরই মাঝে যখন নানান কৃত্রিম সমন্বয়হীনতা দেখা দেয় তখন ভাঁটা পড়ে স্বপ্নে, ধরা দেয় অনীহা, চাপিয়ে যায় কতশত দুশ্চিন্তা। এই কৃত্রিম সংকট ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের জীবনে অনেক দুর্বিষহ ও চ্যালেঞ্জিং মূহুর্ত নিয়ে আসে। বিশেষ করে যারা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়ে এই গোলকধাঁধায় পা দেয় তাদের অবস্থা বলার মতো না।
প্রথমত, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা বা ভর্তির আগেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্কুলার প্রকাশ ও ভর্তি শুরু চরম হতাশাজনক। এতে কয়েক দিক দিয়ে শিক্ষার্থীরা সংকটের মুখে পড়ে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার অনিশ্চয়তার দ্বিধা থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আট-দশ হাজার টাকা খরচ করে ভর্তি হতে হয়। পরে সে কোনো পাবলিকে চান্স পেলে তাকে আবার টাকা খরচ করে ভর্তি ক্যান্সেল করতে হয়। এতে সময়, পরিশ্রম ও টাকা সবটাই বৃথা যায়। আমিও তার ভুক্তভোগী! এছাড়াও, অনেক সময় ভর্তি ক্যান্সেল করায় তার আসনটা খালি রয়ে যায় যেটা আর এক স্বপ্নবাজ বা গ্রাজুয়েশন শেষ করতে চাওয়া কেউ পেতো! কিন্তু, সিস্টেমের মারপেঁচে পড়ে তার স্বপ্নভঙ্গ হয়, কখনোবা গ্রাজুয়েশন অধরা থেকে যায়।
দ্বিতীয়ত, প্রতিটা ছেলেমেয়ের পছন্দের একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থাকে। তো সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা বা ফলাফলের আগেই যদি চান্স পাওয়া অন্য আর এক বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি শুরু করে দেয়, তখনও তাকে এই নিকৃষ্ট সিস্টেম এর শিকার হতে হয়। পনেরো-বিশ হাজার টাকা খরচ করে বাধ্য হয়ে ভর্তি হতে হয়। অন্যথায়, তার সিট হারাবে। পরবর্তীতে পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলে আবার হাজার তিন-এক খরচ করে পূর্বের ভর্তি ক্যান্সেল করে পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয়। এক্ষেত্রে, ২০২০-২১ সেশনে 'বি' ইউনিটে প্রথম হওয়া জাকারিয়ার কথা বলতে পারি যে কিনা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪র্থ তম হয়েও ভর্তি নিয়ে চরম দ্বিধায় পড়ছিলো। কারণ রাবির ভর্তির লাস্ট ডেট এর ঠিক চার দিন পরেই ঢাবির রেজাল্ট। এখন সে যদি ভর্তি না হয় তাহলে সিট হারাবে, পছন্দের সাব্জেক্টও পাবেনা। আর, ভর্তি হলে পনেরো-বিশ হাজার টাকা গুনতে হবে যা অফেরতযোগ্য। তার ভাষ্যমতে, “বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একচেটিয়া সিদ্ধান্তে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের অনেক ভোগান্তির শিকার হতে হয়। সময় টাকা দুটোই নষ্ট হয়। এক্ষেত্রে সমন্বয়টা এখন সময়ের দাবি। ইউজিসিকে এগিয়ে আসতে হবে। একটা সুন্দর নীতিমালা তৈরি করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি কার্যক্রমে অবশ্যই সমন্বয় করবে বা তাদেরকে করতে বাধ্য করতে হবে। অন্যথায়, অনেক শিক্ষার্থী তাদের ইচ্ছাশক্তি হারিয়ে ফেলে, আর্থিক সংকটে পড়ে স্বপ্নভঙ্গ হয় যা খুবই দুঃখজনক!
তৃতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়িত্বশাসিত হওয়ায় তাদের সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ থাকেনা। ফলশ্রুতিতে তারা তাদের ইচ্ছেমতো পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা ও ভর্তি কার্যক্রম চালায়। গত বছর এমনও হয়েছে, অক্টোবর এর ২৩ তারিখ ঢাবি 'ডি' ইউনিট এর পরীক্ষা আবার পরদিন গুচ্ছের পরীক্ষা। এখন যাদের কেন্দ্র দূরে পড়েছে, এবার তাদের অবস্থা চিন্তা করুন। এমনও দেখেছি, ২৩ তারিখ ঢাবির পরীক্ষা দিয়ে আর বাসায় যেতে পারেনি বরং যেতে হয়ছে পরদিন যেখানে পরীক্ষা ওখানকার কেন্দ্রের আশেপাশে। এরকম অসংখ্য উদাহরণ আছে। তো এই যে সমন্বয়হীনতা এগুলো শিক্ষার্থীদের চরম বিপাকে ফেলে, ভোগান্তির শিকার হতে হয়। তাই প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ইউনিটের পরীক্ষা একটা নির্দিষ্ট গ্যাপ দিয়ে ধারাবাহিকভাবে হওয়া দরকার।
চতুর্থত, ভর্তি পরীক্ষা সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের রদবদল। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। ভর্তি পরীক্ষা কেমন হবে বা পরিবর্তন আসবে কিনা সেটা এইচএসসি পরীক্ষার পরপরই জানিয়ে দেওয়া উচিত। এখন দেখা যায় শিক্ষার্থীরা প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে, টাকা খরচ করে কোচিং এ ভর্তি হয়েছে, টানা তিন-চার মাস কাঠখড় পরিশ্রম করেছে। পরীক্ষার আগে এসে হুট করে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলো বা শর্ত বেঁধে দিলো। এখন যারা এতদিন দিন-রাত এক করে পড়াশোনা করেছে, হুট করে একটা সিদ্ধান্তের কারণে যদি পরীক্ষা দিতে না পারে, তাদের অবস্থা কী হবে একবার চিন্তা করুন। যেমন, গুচ্ছে গত বছর আইসিটি ছিলো এবং যারা শুধু গুচ্ছে পরীক্ষা দিবে ভাবছে তারা সে অনুযায়ী কষ্ট করে আইসিটি পড়ে আসছে। কিন্তু, হুট করে সিদ্ধান্ত দিলো আইসিটি হবেনা। আচ্ছা, এই সিদ্ধান্ত কি আগে দেওয়া যেতোনা? এখন নতুন করে আইসিটির পরিবর্তে সাধারণ জ্ঞানের এই সীমাহীন সিলেবাস শেষ করা কতটা কষ্টদায়ক হবে শিক্ষার্থীদের জন্য তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। এছাড়াও, সিলেকশন, জিপিএ কত হতে হবে, পরীক্ষার মান বন্টন ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনেক দেরিতে সিদ্ধান্তের রদবদল হয় যা শিক্ষার্থীদের জীবনকে বিমর্ষ করে তোলে, ইচ্ছাশক্তিকে মাড়িয়ে দেয়।
পঞ্চম, পরীক্ষার আবেদন ফি প্রসঙ্গ। এই সময়টাতে একটা স্টুডেন্টের অনেক টাকার প্রয়োজন হয়, একইসাথে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ইউনিটে আবেদন করতে হয়, যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয় যা সবার জন্য সম্ভব হয়ে উঠেনা। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেককে দেখেছি একটা ইউনিটে আবেদন করে আর করার সাহস করেনা আর্থিক অনটনের কারণে। এমনকি দূরে কোথাও পরীক্ষাও দিতে চায়না যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়ার খরচ এর কথা ভেবে। ফলশ্রুতিতে একই প্রস্তুতি নিয়েও কয়েকটা ইউনিটে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে পারেনা। এভাবে স্বপ্নের দ্বারপ্রান্তে গিয়েও ছুঁতে না পারার বেদনা কতটা তিক্ত ও বেদানাদায়ক তা বর্ণনাতীত।
আমি কোন বিশ্ববিদ্যালয়কে ছোট করে দেখছিনা বরং ভর্তি পরীক্ষা ও পদ্ধতির কথা বলছি যেগুলো পরিবর্তন দরকার। কারণ, দেখা যায় একচেটিয়া সিস্টেম এর মারপেঁচে পড়ে চরম হতাশা ও ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যেতে হয় ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের, মরে যায় তাদের উচ্চশিক্ষার ইচ্ছাশক্তি, দমে যায় তাদের নিশ্বাস। অথচ, এটা একটা কৃত্রিম সংকট। একটু উদ্যোগী হলেই এটার সুরাহা করা সম্ভব। তাই, ইউজিসিকে অন্তত এগিয়ে আসতে হবে। দেশের সব পাবলিক বিশ্বিবদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা ও ভর্তি কার্যক্রমে একটা সুন্দর ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রনয়ণ করতে হবে। অন্যথায়, উচ্চশিক্ষার আদি লগ্নেই ঝরে পড়বে লাখো শিক্ষার্থী, জীবন গঠন ও সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনায় ব্যাঘাত হবে যা ভবিষ্যত বাংলাদেশের জন্য খুব একটা সুখকর নয়। তাই আশা রাখি দ্রুত সময়ের মধ্যে একটা সুন্দর ও সুশৃঙ্খল নীতিমালা প্রণয়ন করে উচ্চশিক্ষার দ্বারকে সহজ করে দিবে। এবার লিখার শুরুতে উল্লেখিত গল্পের প্রধান চরিত্র রমিজ মিয়ার জায়গায় দেশের লাখো বাবাকে চিন্তা করার মধ্য দিয়ে শেষ করছি...।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইনস্টিটিউট অফ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়