ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক সবার অন্তরে

মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক
মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক  © টিডিসি ফটো

ঈদ মানে আনন্দের জোয়ার। ঈদ মানে খুশির সঞ্চার। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর রমজানের শেষ দিনে আকাশের এক কোণে বাঁকা চাঁদের মিষ্টি হাসি ঈদের জানান দিয়ে দেয় সবাইকে, সবাই একই সুরে গেয়ে ওঠে কাজী নজরুল ইসলামের সেই অমর সংগীত, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’

ঈদুল ফিতর প্রতিবছর এক অনন্য-বৈভব বিলাতে নিয়ে আসে খুশির বার্তা। বছরে একবার এই উৎসব দিবসটি খুশি ও কল্যাণের সওগাত নিয়ে ফিরে আসে। এ জন্য এটাকে ঈদ বলা হয়। ঈদ শব্দের অর্থ আদত বা অভ্যাস। অর্থটি এ জন্য যে, মহান আল্লাহ প্রতি বছর ঈদের মাধ্যমে বান্দাকে তাঁর দয়া, এহসান ও করুণা বর্ষণ করে থাকেন।

সিয়াম পালনের দ্বারা রোজাদার যে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার সৌকর্য দ্বারা অভিষিক্ত হন, ইসলামের যে আত্মশুদ্ধি, সংযম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, দানশীলতা, উদারতা, ক্ষমা, মহানুভবতা, সাম্যবাদিতা ও মনুষ্যত্বের গুণাবলি দ্বারা বিকশিত হন, এর গতিধারার প্রবাহ অক্ষুণ্ণ রাখার শপথ গ্রহণের দিন হিসেবে ঈদুল ফিতর আগমন হয়।

আল্লাহর পক্ষ থেকে ঈদ হচ্ছে বান্দার জন্য বিরাট আতিথেয়তা। এ দিন যে আনন্দধারা প্রবাহিত হয়, অফুরন্ত পুণ্যময়তা দ্বারা পরিপূর্ণ। সুদীর্ঘ এক মাস রোজার পর মুসলমানের ঘরে নিয়ে আসে ঈদ আনন্দ। এদিন নতুন জামা-কাপড় পরিধান করা, ঈদগাহে নামাজ পড়া ও কোলাকুলি সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হন। ফিরনি-সেমাই খাওয়া প্রভৃতি ঈদের দিনের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি।

ঈদ হলো আল্লাহর নিয়ামত ও জিয়াফত ভোগ করার চিরন্তন অভ্যাস বা আচার অনুষ্ঠান। এই জিয়াফত ভোগ করতে যেয়েই আমরা একটু বেপরোয়া হয়ে পড়ি। দীর্ঘ এক মাস রোজা আমাদের নিয়মমাফিক চলা ও পরিমিত খাদ্য গ্রহণ করার ফলে জীবনাচরণের একটি ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়। এই ইতিবাচক প্রভাবটি যেন নেতিবাচক না হয়ে যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

ঈদে ঘরমুখো মানুষগুলো বাড়ি যাওয়ার জন্য খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বাস, ট্রেন ও লঞ্চের ছাদে চড়ে ঝুঁকিপূর্ণ সফর করেন, এতে অনাকাক্সিক্ষত বিপদ-আপদের শিকার হন। কয়েক বছরের পরিসংখ্যানে দেয়া যায়, অন্য সময়ের চেয়ে ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ বাড়ে। এজন্য সফরে সতর্ক ও সাবধান থাকতে হবে, কোনোভাবেই অসতর্কভাবে চলাফেরা করা যাবে না।

আরও পড়ুন: এক বছরে তিনটি ঈদ ও দুটি রমজান একসঙ্গে পাবেন মুসলিমরা

আমরা যখন ঈদের আনন্দে মেতে উঠব, ঠিক এর আগ মুহুর্তেই বিশ্বজুড়ে অসংখ্য মানুষ যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় মৃত্যুর প্রহর গুনছে। হাজারো অভিবাসনপ্রত্যাশী মানুষের কান্নাকাতর ধ্বনি আমাদের ব্যথাতুর করবে। দেশে দেশে মজলুম মানুষের আহাজারি শোনা যাবে। তার পরও মুসলিম উম্মাহর ঘরে ঘরে ঈদ আসবে। তাই ঈদের আনন্দে সব মজলুম ও অসহায় মানুষের জন্য বস্তুগত কিছু করা সম্ভব না হলেও আমাদের দোয়ার হাত যে আরশের প্রভুর দরবারে উঠবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আত্মীয়স্বজন, পাড়া-পড়শিদের নিয়ে আনন্দ উপভোগ করার এই বিরল সুযোগ হয়তো অনেকেই হাতছাড়া করবেন না। আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, ঈদ উৎসব অন্য দশটি উৎসবের মতো নয়, এটি ইবাদতকেন্দ্রিক উৎসব। তাই উৎসবের নামে বাড়াবাড়ি পরিহার করার সর্বাত্মক চেষ্টা করা সবার কর্তব্য।

ঈদের করণীয়

১. ফজরের সালাত আদায় করা। ২. মিসওয়াক করা। ৩. রোজা না রাখা। এদিন রোজা রাখা হারাম। ৪. গোসল করা। ঈদের দিন গোসল করা সুন্নাত। ৫. সকালবেলা কিছু খাওয়া। ঈদের নামাজে যাওয়ার পূর্বে কিছু খাওয়া সুন্নাত। ৬. সুগন্ধি ব্যবহার করা। আতর বা সুগন্ধি ব্যবহার করা সুন্নাত। ৭. সুন্দর পোশাক পরিধান করা। এ দিনটিতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সুন্দর পোশাক পরিধান কর।

৮. সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা। যে ব্যক্তি সাদাকাতুল ফিতর ঈদের নামাজের পূর্বে আদায় করে, তা কবুল করা হবে। আর যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের পরে আদায় করবে, তা সাধারণ সাদাকাহ হিসেবে পরিগণিত হবে।

৯. পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া। পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া সুন্নাত। ১০. ঈদের জামাতে যাওয়া-আসার পথ ভিন্ন হওয়া। এটি সুন্নাত। এতে দীর্ঘ হাটা এবং বেশি মানুষের সাথে মিশার উপকারিতা রয়েছে। ১১. তাকবীর বলা। তাকবীর বলে ঈদগাহে যাওয়া সুন্নাত। আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু, অল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, অলিল্লাহিল হামদ।

১২. ঈদে কুশল বিনিময়। পারস্পরিক ঈদে কুশল বিনিময় করা সুন্নাত। সাহাবায়ে কেরাম এই দিনে একে অপরকে বলতেন তাকাব্বালুল্লাহা মিন্না ওয়া মিনকুম। ১৩. ঈদের সালাত আদায় করা। ১৪. খুতবাহ শুনা ও দুআ করা। এটি পালন করা ওয়াজিব। ১৫. কবর যিয়ারত করা। কেননা এটি তা মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

ঈদের বর্জনীয়

১. জামাতের সাথে ফরজ সালাত আদায়ে অলসতা। ২. ঈদের দিন সিয়াম পালন করা। ৩. বিজাতীয় আচরণ প্রদর্শন করা। ৪. নারী-পুরুষ একে অপরের বেশ ধারণ করা। ৫. নারীদের খোলামেলা অবস্থায় রাস্তাঘাটে বের হওয়া। ৬. গান-বাজনা করা। ৭. অযথা কাজে সময় নষ্ট করা। ৮. অপচয় ও অপব্যয় করা। ৯. আতশবাজি করা। ১০. ঈদের সালাত আদায় না করে কেবল আনন্দ-ফূর্তি করা।

ঈদ আমাদের আনন্দ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উৎসব। আমাদের সকলকে ঈদের তাৎপর্য বুঝতে হবে।  ঈদ বলতে আমরা আনন্দ ছাড়া আর কিছুই বুঝিনা। তবে সেই আনন্দের নামে আমাদের সমাজে যে অশ্লীলতা, জৌলুস, অপব্যয়, নগ্নতা ও বেহাল্লাপনা তা মেনে নেয়া যায়না। মুসলমানের ঈদ-উৎসবে নেই কোনো নগ্নতা, খেল-তামাশা ও কোনো বেহাল্লাপনা।

মুসলমানদের ঈদ উদযাপন হবে ইবাদত, রিয়াজত তাদের ইতিহাসের ও ঐতিহ্যের আলোকে। শরীয়ত সম্মতভাবে আমাদের সকলকে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে হবে। পৃথিবীর মানুষের জন্য এই ঈদ যেন বয়ে আনতে পারে সত্যিকারের আনন্দের অনাবিল এক আবহ। ঈদ হোক সবার জীবনে আনন্দের উৎস। আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও মুদ্রণ ব্যবস্থাপক


সর্বশেষ সংবাদ