০৯ এপ্রিল ২০২২, ১৩:১২

অফুরান প্রেরণার উৎস হয়ে বেঁচে থাকবেন জাতীয় অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদ

অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদ  © ফাইল ফটো

আজ ৯ এপ্রিল। বাংলাদেশের প্রথম নারী জাতীয় অধ্যাপক, ভাষা সংগ্রামী, একুশে পদকপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের কৃতি শিক্ষার্থী ও অধ্যাপক প্রয়াত ড. সুফিয়া আহমেদ-এর দ্বিতীয় মৃত্যু বার্ষিকী। এই দিনে তাঁকে বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।

উপমহাদেশের প্রখ্যাত আইনবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের শিক্ষক ও উপাচার্য এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের আইনমন্ত্রী বিচারপতি মুহাম্মদ ইব্রাহীম ও লুৎফুন্নেছা ইব্রাহীম দম্পতির সুযোগ্য সন্তান ছিলেন সুফিয়া আহমেদ। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব অরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ School of Oriental and African Studies’ (SOAS) থেকে Some Aspects of the History of the Muslim Community in Bengal (1884-1912) শিরোনামে অভিসন্দর্ভ রচনা করে ১৯৬০ সালে পিএইচ. ডি. ডিগ্রি লাভকারী সুফিয়া আহমেদ শিক্ষকতা করতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কাজ করেছেন তুরস্কের বসফোরাস বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি ফুলব্রাইট ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলভার্নো কলেজেও।

ড. সুফিয়া আহমেদ একজন বিদগ্ধ গবেষক ছিলেন। তাঁর শিক্ষা ও গবেষণার বিচরণ ক্ষেত্র মূখ্যত ভারত, পাকিস্তান ও বাংলদেশের মুসলমানদের রাজনৈতিক ইতিহাস, উনিশ ও বিশ শতকের তুরস্কের ইতিহাসের বিকাশধারা এবং বাংলাদেশ ও তুরস্কের নারী উন্নয়ন বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সোয়াসে সম্পাদিত তাঁর উপর্যুক্ত গবেষণা অভিসন্দর্ভটি The Muslim Community in Bengal (1884-1912) শিরোনামে ১৯৭৪ সালে প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ২০০২ সালের বাংলা একাডেমি থেকে বাংলার মুসলিম সম্প্রদায় (১৮৮৪-১৯১২) শিরোনামে এই গ্রন্থটির বাংলা সংস্করণ প্রকাশিত হয়। অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদ তাঁর প্রয়াত পিতা বিচারপতি মুহাম্মদ ইব্রাহীমের স্মরণে Justice Muhammad Ibrahim (1898-1966) Memorial Volume (একাডেমিক প্রেস এন্ড পাবলিশার্স, ঢাকা ২০০৬) নামে একটি গ্রন্থ সম্পাদনা ও সংকলন করেছন। তাঁর সম্পাদনায় ইতোমধ্যে Diaries of Justice Muhammad Ibrahim (1960-1966) (একাডেমিক প্রেস এন্ড পাবলিশার্স, ঢাকা ২০১১) শীর্ষক আরো একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থ ছাড়াও তাঁর রচিত বিভিন্ন বিষয়ে বহু গবেষণা প্রবন্ধ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণা জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। ড. সুফিয়া আহমেদ The Dhaka University Studies এর সম্পাদনা পরিষদ ছিলেন। তিনি Asiatic Society of Bangladesh কর্তৃক ৩ খণ্ডে প্রকাশিত History of Bangladesh এবং History and Heritage, Encyclopedia of Bangladesh প্রকল্পের সম্পাদনা পরিষদের সদস্যরূপেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ড. সুফিয়া আহমেদ আধুনিক তুরস্কের রাজনৈতিক ইতিাসের উপর একজন বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত হিসেবে এ বিষয়ে দেশ বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ দান ছাড়াও বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়ন এবং শিক্ষামূলক ও বুদ্ধিবৃত্তিক যোগাযোগ সাধনে বিশিষ্ট ভূমিকা রেখেছেন। এরই স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৭ সালে তুরস্কের তৎকালীন মহামান্য রাষ্ট্রপতি সোলায়মান ডেমিরেল স্বয়ং ঢাকার তুর্কি দূতাবাসে তাঁকে একটি স্মারকপত্রেএবং ও তাঁর নিজের স্বাক্ষরকৃত একটি ছবি উপহার দেন। তিনি Turkey-Bangladesh Friendship Society (TBFS) এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

সুফিয়া আহমেদ ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে। তাঁর প্রয়াত স্বামী বাংলাদেশের প্রখ্যাত আইনজীবী সাবেক এটর্নী জেনারেল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা (দু’মেয়াদে, ১৯৯৬ ও ২০০১) ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদও একজন ভাষা সংগ্রামী ছিলেন। ছাত্র জীবনে রাজনীতি করলেও স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতির সাথে কখনো যুক্ত ছিলেন না। ড. সুফিয়া আহমেদ সরাসরি রাজনীতির সাথে যুক্ত না থাকলেও তিনি বরাবরই একজন রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন। একজন সচেতন, দায়িত্বশীল কর্মনিষ্ঠ নাগরিক হিসেবে দেশের বিভিন্ন ক্রান্তিকালে তিনি সংকট উত্তরণে সবসময় প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে ভূমিকার রাখার প্রয়াস রেখেছেন।

শিক্ষকতার পাশাপাশি অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদ একজন সমাজসেবক ও নারী সংগঠক হিসেবেও সক্রিয় ছিলেন। নারী শিক্ষা ও নারী মুক্তি আন্দোলন, তাদের উন্নয়ন এবং সামাজিক ও জনহিতকর কার্যে তিনি ছিলেন এক সোচ্চার এক কন্ঠ। সুফিয়া আহমেদ জাতীয় মহিলা সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং গার্ল গাইডের ইন্টারন্যাশনাল কমিশনারসহ বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। বাংলা ভাষায় ইতিহাস চর্চার পথিকৃত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ। তিনি এই সংগঠনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং আট মেয়াদে এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য, বাংলাদেশ পাবলিক এ্যাডমিনিস্ট্রেশন ট্রেনিং সেন্টারের (BPATC) বোর্ড অব গভর্ণরস এর সদস্য (১৯৮৭-১৯৮৯), ICDDRB-এর ‘এথিক্যাল রিভিউ কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের সদস্য (১৯৭৮, ১৯৮২), জন্টা ইন্টরন্যাশনাল ক্লাব, ঢাকা-১ এর সদস্য এবং Cheshire Foundation Homes এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি যেসব সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন সে সব সঙগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি বহির্বিশ্বে বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৫২ সালে তিনি তুরস্কে সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদলের ছাত্রী সদস্য হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি ১৯৬৯ সালে প্রথমবার এবং ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয়বারের মত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের দেশের প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টম্যান্টের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত সম্মানজনক International Visitors Programme এ একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি প্যারিসে অনুষ্ঠিত UNESCO এর অধিবেশনেও দেশের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি Bangladesh Girl Guides Association এর International Commissioner হিসেবে ১৯৭৫ সালে ইংল্যান্ডের সাসেক্সে, ১৯৭৮ সালে ইরানের রাজধানী তেহরানে, ১৯৮১ সালে ফ্রান্সের Orleans এ এবং ১৯৮৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত Girl Guides World Conference-এ বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন।

ভাষা সৈনিক জাতীয় অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদ ও ব্যারিষ্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ দম্পতি পারিবারিক জীবনেও ছিলেন অত্যন্ত সফল মানুষ। সুফিয়া আহমেদ ও সৈয়দ ইশতিয়াক আহমদের দাম্পত্য জীবনকে আলোকিত করেছেন তাঁদের দুই সুযোগ্য সন্তান। তাঁদের বড় সন্তান সৈয়দ রেফাত আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি অর্জনের পর উচ্চ শিক্ষা লাভ করেছেনে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে অবস্থিত Tufts বিশ্ববিদ্যালয়ের Fletcher School of Law and Diplomacy –তে। শেষোক্ত প্রতিষ্ঠান থেকেই তিনি Non-Documented Immigrants বিষয়ের উপর গবেষণা করে পি-এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন। পিতার মতো ড. রেফাতও সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবী হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের মাননীয় বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন এবং সম্প্রতি তিনি অবসরগ্রহণ করেন। অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদের একমাত্র কন্যা ডা. তাসনীম রায়না ফাতেহ্ ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এম.বি.বি.এস. ডিগ্রি অর্জন করেন এবং বর্তমানে লন্ডনের দুটি খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানে সিনিয়র সাইকোথেরাপিষ্ট হিসেবে সুনামের সাথে কাজ করছেন।

ড. সুফিয়া আহমেদ একজন সৎ, আদর্শবান ও কর্তব্যনিষ্ঠ শিক্ষক ছিলেন। ব্যক্তি মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন উদার, ধর্মনিরপেক্ষ, নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। পারিবারিক পরিমণ্ডলে একজন মাতা হিসেবে নিজ সন্তানদের যেমন নিজের আদর্শে গড়ে তোলার শিক্ষা দিয়েছন, তেমনি একজন দায়িত্বশীল শিক্ষক ও অবিভাবক হিসেবে তাঁর শিক্ষার্থীদের সৎচিন্তায়, সৎপথে ও উদার জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। পেশার প্রতি নিষ্ঠাবান থাকা; সর্বোপরি আদর্শ মানুষ হওয়ার শিক্ষা তিনি তাঁর শিক্ষার্থীদের সারা জীবন দিয়ে গেছেন।

কোভিড মহামারির মধ্যে ২০২০ সালের ৯ এপ্রিল জাতীয় অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদ মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যু একটি জীবনের ইতি ঘটায়, কিন্তু তাঁর কর্মের নয়। জাতীয় অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদের ক্ষেত্রেও এ কথাটি ধ্রুব সত্য। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাঁর দেহান্তর হয়েছে। তবে তিনি তাঁর কৃতি ও কর্মের মাঝে বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন যুগ থেকে যুগান্তরে। কর্ম ও জীবনাদর্শের মাধ্যমে প্রিয় শিক্ষাগুরু সুফিয়া আহমেদ আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন অফুরান প্রেরণার উৎস হয়ে। জীবদ্দশায় তিনি যেমন ছিলেন সম্মানীয় পারলৌকিক জীবনেও যেন তেমনি থাকেন-পরম করুণাময়ের কাছে এটিই বিনীত প্রার্থনা।

লেখক: অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়