বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের অন-ক্যাম্পাস কাজের সুযোগ প্রসঙ্গে
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ভিসির বরাত দিয়ে অনেকেই বলছে, সেই ক্যাম্পাসে ছাত্রদের চাকরি/কাজের সুযোগ তৈরি করা হবে। অনেক ভালো উদ্যোগ, প্রকৃতই যদি বুয়েট এটা বাস্তবায়ন করতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরণের ব্যবস্থা কাগজে-কলমে বহুকাল আগ থেকেই আছে। সম্ভবত, লাইব্রেরি বা রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের কাজে কয়েকজন ছাত্রের নিয়োগদানের ব্যবস্থা আছে। কাজের বিনিময়ে মজুরি যেটা আমাদের সময়ে ছিলো সেটা পুরোটা প্রহসন। সম্ভবত, বেতন মাসে কয়েকশত টাকা। ২০০৭-২০০৮ এর দিকে বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম, এখনকার বাস্তবতা জানিনা।
আমার এখনকার ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াইতে প্রায় ৪ হাজার শিক্ষার্থী অন-ক্যাম্পাস চাকরি করে। রেগুলার শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীর বাহিরে এসে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪ হাজারকে কর্মের সুযোগ করে দেওয়াটা এটা নির্দেশ করে যে একটা বিশ্ববিদ্যালয় কেবলই ডিগ্রি দেয়না, নিজেই বড়সড় চাকুরির বাজার। রেগুলার আরএ/জিএ/টিএ এসবের বাহিরে শিক্ষার্থীরা এখানে ঘন্টা বেতনে বা চুক্তিতে কাজ করে। হাওয়াইতে ন্যুনতম মজুরি ঘন্টায় ১১ ডলারের মত, ক্যাম্পাসে ম্যাক্সিমাম ২৮ ডলার পর্যন্ত দেখেছি। আমেরিকান বা অন্য যেকোন দেশের ছেলে-মেয়েরা সেমিস্টার চলাকালে সপ্তাহে সর্বোচ্চ ২০ ঘন্টা কাজ করতে পারে। সামারে ৪০ ঘন্টা।
আরও পড়ুন: ‘টিউশনে শিক্ষার্থীদের সময় নষ্ট, তাই অন ক্যাম্পাস জব চালু হবে’
বরাবরের মতোই অনেকেই বিরক্ত হবেন এই মর্মে যে, আমেরিকান বাস্তবতা নিশ্চয় দেশের সাথে মিলবেনা। অথচ দেশের ক্যাম্পাসগুলোতে শিক্ষার্থীদের চাকরির ব্যবস্থা কিন্তু খুব কঠিন কিছু না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই যদি বিবেচনা করি; নীলক্ষেত, শাহবাগ এবং ফার্মগেটের গ্রীনরোডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কয়েকশ দোকান পড়ে আছে সেসব চাইলেই ভার্সিটি ব্যবসার আওতায় আনতে পারে এবং সেখানে পুরোটাই ছাত্রদের দিয়ে পরিচালনা করতে পারে। ক্যাম্পাসের ভেতরেই অসংখ্য ক্যান্টিন/ফুড কোর্ট আছে। এসবের ব্যবস্থাপনায় ভার্সিটির আয় তো নিশ্চিতভাবেই বাড়বে। পাশাপাশি, টাকার অভাবে সারারাত না খেয়ে- শীতের রাতে হলের বারান্দায় ঘুমানো ছেলেটার জন্য একটা আয়ের জোগান দেওয়া তার ভবিষ্যত বদলে দেওয়ার সংগ্রামে কতোবড় সাপোর্ট হতে পারে সেরকম পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে না গেলে টের পাওয়া যাবেনা।
ক্যাম্পাসে ছাত্রদের কাজের আরো বহুবিধ ধরণ নিয়ে বলবার আগে আমার কর্মস্থল রুয়েট (রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) প্রসঙ্গে বলি। নিশ্চিতভাবেই ঢাকার বাস্তবতা আর রুয়েট-রাজশাহীর মতো বিভাগীয় বা আরো ছোট শহরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিস্থিতি এক রকম না। মজার ব্যাপার হলো, রুয়েটে যে পরিমাণ আম-লিচুর বাগান আছে এবং আমি যতোটা সিনিয়র সহকর্মীদের কাছে শুনেছি; সেসবের যথাযথ বাণিজ্যিক উদ্যোগ নিলে পরে বছরে প্রায় ১২-১৫ লাখ টাকার আয় সম্ভব।
এখানে ৩/৪টি বড় সাইজের পুকুর আছে। সেসবে পরিকল্পিতভাবে মাছ চাষ সম্ভব। অনেকগুলো ক্যান্টিন বা খাবারের-মুদি দোকান আছে। এসবে ভার্সিটি কেন্দ্রীয়ভাবে উদ্যোগ নিলে পরে ভার্সিটির আয় যেমন বাড়বে, এবং এসব কাজ করার মাধ্যমে আর্থিকভাবে ঝুকিতে থাকা ছেলে-মেয়েদের শিক্ষাজীবনটা কিছুটা হলেও স্বস্তিদায়ক হবে। এসব ইনফর্মাল আয়ের বাহিরেও রুয়েটসহ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সিভিল/মেকানিক্যালের মতো সাবজেক্টগুলোতে কমার্শিয়ালি বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল টেস্ট করানো হয়। এসব মূলত শিক্ষক বা ল্যাব সংশ্লিষ্টরা করেন। সংশ্লিষ্টদের বাড়তি আয় হয়। সহজেই এসব কাজে শিক্ষার্থীদের নিয়োগ দেয়া যায়।
সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাস্টাররোলে অনেক কর্মচারী নিয়োগ হয়। বেশির ভাগই কম্পিউটার অন/অফ করতে জানেনা এরকম ক্যাপাসিটি সম্পন্ন। অথচ কয়েক বছর যাওয়ার পর চাকরি স্থায়ীকরণের দাবিতে ক্যাম্পাস অচল করে বসে। সেসবে শিক্ষার্থীদের সহজেই অস্থায়ী নিয়োগ দেওয়া সম্ভব এবং ভার্সিটিগুলোতেও অদক্ষ মানবসম্পদের ঝুকি এড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়।
আমিসহ আমার অনেক সহকর্মীদের প্রায়শই অভিযোগ; এসাইনমেন্ট, কুইজ, ক্লাস-টেস্টের রেজাল্ট তৈরি করতে করতেই অনেকটা সময় চলে যায়। ভার্সিটি সেসব কাজের জন্য আমাদের যেসব ভাতা দেয় তার একটা অংশ শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্ধ দিয়ে এসব ম্যানুয়াল বা টিচিং এ্যাসিসট্যান্টের মতো কাজগুলোতে শিক্ষার্থীদের নিয়োগ দিতে পারে, আমরাও কাজের চাপ কমাতে পারি। তামাম দুনিয়ার ভার্সিটিগুলোতে টিচিং এ্যাসিসট্যান্ট বিশেষ করে ফলাফল মূল্যায়নে ছাত্রদের সংযুক্ত করা হচ্ছে, এতে কারো জাত যাচ্ছে না। তাছাড়া, আমাদের বেশির ভাগ সহকর্মী ভার্সিটি, বা অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি গবেষণা ফান্ড নিয়ে কাজ করছেন, সেসবে শিক্ষার্থীদের রিসার্চ এ্যাসিসট্যান্ট নিয়োগ বাধ্যতামূলত করে দিলে পরে সংশ্লিষ্ট গবেষক-এবং ভার্সিটির ক্যাপাসিটিও বাড়ে। প্রতিটা রেভিনিউ বা ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টে শিক্ষার্থীদের অস্থায়ী নিয়োগের সুযোগ করা যেতে পারে। এরকমই অগুনতি উপায়ে চাইলেই ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের আয় এবং কাজের ব্যবস্থা করা সম্ভব।
প্রসঙ্গত, ঢাকা ভার্সিটিতে আমার শিক্ষাকাল ৩টি ডিগ্রি মিলায়ে প্রায় ৭ বছর ছিলো। এবং আমি প্রথম বছর থেকেই চাকুরি করতাম। অনেকগুলো পত্রিকায়/প্রকাশনায় বেতনভুক্ত সাংবাদিক/লেখক ছিলাম। সেসব অভিজ্ঞতা কেবলই সেসময়ে আমার অর্থের যোগান দেয়নি বা আমার পরিবার কে চাপমুক্ত করেনি। বরং, এসব কর্ম-অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে আমার সীমিত সামর্থ্যের ক্যারিয়ারকে সর্বোচ্চ সমৃদ্ধ করেছে।
আমি গর্বের সাথে বলি, সোশ্যাল সায়েন্সের গ্রাজুয়েট হওয়ার পরেও ডিগ্রি শেষ হওয়ার আগেই চাকরি বাজার বিবেচনায় বড় বেতনের চাকরিতে আমাকে আন্তর্জাতিক একটা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা ডেকে নিয়ে নিয়োগ দিয়েছিলো। আমার অন্যান্য বন্ধুরা একই পর্যায়ের চাকরি পেয়ে অন্তত আরো দুই-তিন বছর পরে।
আমি মনে করি, আমি তাদের চাইতে এগিয়ে ছিলাম কারণ আমার কর্ম অভিজ্ঞতা এবং যে প্রফেশনাল কানেকশান আমার তৈরি হয়েছিলো পড়াশোনার সময়কালেই, সেটা বাকিদের বেলায় আরও পরে হয়েছিলো। দিনশেষে, সাফল্য আপেক্ষিক, এবং তারা সবাই আমার চাইতে ভালো করতেছে। বন্ধুদের বেলায় আমি গর্বিত এবং নিজের বেলায় তৃপ্ত।
যেমনটা বলতেছিলাম যে কেবলই বেতন, আর্থিক সাপোট বা কাজের সুযোগ নয়, সামগ্রিকভাবে কাজের প্রতি যে শ্রদ্ধার সুযোগ, পরিবেশ এবং মানসিকতা তৈরি হয় অন-ক্যাম্পাসে কাজের মাধ্যমে সেটা একটা জাতির সামগ্রিক প্যারাডাইম পরিবর্তন করার জন্য যথেষ্ট হতে পারে। এখানে আমার এক আমেরিকান বন্ধু ক্যাম্পাসের বড়-বড় গাছগুলোর ঢাল-পালা (নিটিং) কাটে ঘন্টায় ১৩ ডলার মজুরিতে। আমার পরিচিতদের কেউ রাস্তা পরিস্কার করে, কেউ হোস্টেল/ডর্মগুলোর ডাইনিং ম্যানেজার, টেলিফোন অপারেটর, ড্রাইভার, লাইব্রেরি সহকারী, স্টারবার্কস বা রেস্টুরেন্টের ওয়েটার। কোন বন্ধু কি কাজ করছে সেসব নিয়ে কারো মধ্যে কোন অস্বস্তি নাই, বিকার নাই। প্রকৃতই, আগামী দিনে সিলিকন ভ্যালির প্রকৌশলী বা দেশের পলিসি মেকিংয়ে লিড দিতে যাওয়া আজকের কোন শিক্ষার্থী মুদি দোকানী, খাবার ডেলিভারি বা এগ্রো বেইজড কাজগুলোতে জড়ানোর ফলে কাজের প্রতি তার যে সম্মানটা তৈরি হবে এবং সর্বোপরি যেসব মর্যাদাপূর্ন জীবনবোধের শিক্ষাটা হাতে কলমে পাবে তার মর্মার্থ বুঝবার সামর্থ্য হয়তো আমাদের অনেকরই নাই। শেষতক, বুয়েটকে সাধুবাদ। অনেক যুগ দেরিতে হলেও মডেলটা ছড়ায়ে পড়ুক।
লেখক: পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াই-যুক্তরাষ্ট্র এবং সহকারী অধ্যাপক (শিক্ষাছুটি), রুয়েট