২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২১:৪৬

মাতৃভাষা চর্চায় আমাদের ভাবনা

মুহম্মাদ আবু রায়হান  © টিডিসি ফটো

মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব, বাকশক্তি সম্পন্ন প্রাণী। জগতের অন্য প্রাণীর থেকে মানুষ স্বতন্ত্র। ভাষার অনন্যতা তাকে ভিন্ন করেছে। মানুষের চিন্তা-চেতনা, আবেগ- অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে ভাষা একমাত্র অবলম্বন হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

সুদীর্ঘকাল থেকে মানুষ ভাষা চর্চা ও অনুশীলন করে আসছে। পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে ছয় হাজারেরও বেশি ভাষা প্রচলিত রয়েছে। বিশ্বে অপরাপর জাতির ন্যায় বাঙালী জাতিও মাতৃভাষা বাংলায় অভিব্যক্তি প্রকাশ করে।বাঙালী জাতিকে এ ভাষায় নিজস্ব অভিব্যক্তি প্রকাশের জন্য অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, সংগ্রাম এমন কি রক্ত ঝরাতে হয়েছে।

আরও পড়ুন: এসএসসি-এইচএসসির মানবন্টনে পরিবর্তন, বেড়েছে সময়

ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিভিন্নকালে এদেশের রাজনৈতিক ও শাসনতন্ত্রের পথ পরিবর্তনের সাথে সাথে এ ভাষার প্রতি নানা ধরনের অসম আচরণ ও অবজ্ঞা-অবহেলা প্রদর্শন করা হয়েছে। জন্মলগ্ন থেকে এ ভাষা চর্চায় রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে তেমন উল্লেখযোগ্য পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি। প্রাচীন শাসনামল তথা মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সেন আমলের মধ্যে এ ভাষা সবচেয়ে বেশী নিগৃহীত হয়েছে। সেন রাজারা বাংলা ভাষার চর্চা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং সংস্কৃতকে রাষ্ট্রভাষা করেন। ফলে হিন্দু ব্রাহ্মণদের দৌরাত্ম্যের ফলে বাংলা ভাষা চর্চা এবং সাহিত্যের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয়।

সেন আমলে বাংলা ভাষার দুরবস্থার কথা তুলে ধরে ড. দীনেশ চন্দ্র সেন বলেছেন, ‘ইতরের ভাষা বলিয়া বঙ্গ ভাষাকে পন্ডিতমন্ডলী দূর দূর করিয়া তাড়াইয়া দিতেন।’ মধ্যযুগে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায় বাংলা ভাষার প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করেন। এমন কি মাতৃভাষা বাংলা কি না তা নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশ শাসনামলে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার পর নতুন উদ্যমে বাংলা ভাষা চর্চা শুরু হলেও বিদেশী পণ্ডিতদের চক্রান্তে বাংলা ভাষার চেহারা ক্রমপরিবর্তিত হতে থাকে। ফলশ্রুতিতে বাংলা গদ্য হয়ে ওঠে সংস্কৃত প্রধান।

এ বিষয়ে মোহাম্মাদ আব্দুল মান্নান বলেন, ‘বাংলা ভাষার আদল পরিবর্তনের এ কাজটি এত ব্যাপক হলো, যার ফলে বাংলা হরফ ঠিক থাকলো বটে, কিন্তু রক্তে মাংসে সে ভাষা হয়ে উঠলো অনেকাংশেই সংস্কৃতি যা ছিল আসলে বাংলা হরফে সংস্কৃতি লেখারই নামান্তর।’

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বাঙালী জাতি আশা করেছিল, এবার মাতৃভাষা স্বরূপে আবির্ভূত হবে ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে পরিপুষ্ট হয়ে উঠবে। সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি জ্ঞানের অন্যান্য শাখায় সদর্পে বিচরণ করবে। কিন্তু নতুন শাসকগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকদের ভাষাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করলে বাঙালী জাতি ক্ষোভে ফেটে পরে এবং তুমুল আন্দোলন ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন।

আরও পড়ুন: মেধাতালিকায় না আসলেও ভর্তি করিয়ে দেয়ার আশ্বাস, আটক

অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে মাতৃভাষা বাংলা বর্তমানে সত্তর বছর অতিক্রম করছে কিন্তু বাংলা ভাষা কি নিজস্ব মর্যাদার আসনে আসীন হয়েছে? রাষ্ট্রের সকল স্তরে ভাষার প্রয়োগ কি যথার্থরূপে সাধিত হয়েছে? আমরা কি এ ভাষাকে আমাদের অন্তরে গ্রথিত করতে পেরেছি?

যদি পারতাম তবে কি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামকরণের ক্ষেত্রে আমরা আমাদের দেশের ভাষা সাহিত্যের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিষয়কে উপেক্ষা করে এ রকম উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম, আমেরিকান, কানাডিয়ান, ইউরোপিয়ান, ব্রিটানিকা ইত্যাদি নামে আমরা আমাদের দেশীয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নামকরণ করতে পারি?

এছাড়া সমাজের এক শ্রেণির যুবারা বাঙলা-হিন্দি-ইংরেজির মিশ্রণে নতুন এক ভাষার জন্ম দিয়েছে। যাদের পরিচয় বাংলিশ নামে। না পারছে ওরা ভালো বাংলা বলতে, আর না পারছে ভালো ইংলিশ আওড়াতে, যা ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে ছন্দ পতনের উৎস হিসেবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। যা অদূর ভবিষ্যতে জাতির জন্য অশনি সংকেত হিসেবে দেখা দিতে পারে।

এদিকে দেশের বেশ কিছু ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও বেসরকারি রেডিওগুলো মাতৃভাষা চর্চার ক্ষেত্রে দ্বিধাহীন চিত্তে শব্দের বিকৃত উচ্চারণ ও বাংলিশ জাতীয় শব্দ ও বাক্যের ব্যবহার করছে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত ধারাবাহিক সিরিয়ালগুলোয় অবলীলায় মিশ্রিত আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার করছে, যা প্রমিত বাংলা চর্চার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখা দিয়েছে।

উপরন্তু, আকাশ সংস্কৃতির এ যুগে দেশে-বিদেশী চ্যানেলের অবাধ প্রবেশে ছেলেমেয়েদের মধ্যে মাতৃভাষা চর্চার চেয়ে বিদেশী ভাষা বিশেষ করে হিন্দি ভাষা চর্চায় অধিক মনোনিবেশ করছে। দেশের ত্রিমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার ফলে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাতৃভাষা চর্চার ক্ষেত্রে অনেকাংশে উদাসীনতার দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হচ্ছে।

জীবনের সকল ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণের কারণে আমরা আমাদের স্বকীয়তাকে হারাতে বসেছি। রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ, ভাষা দিয়ে রাষ্ট্রের নামের শুরু। কিন্তু ভাষার মর্যাদা নেই সঠিকভাবে। ইংরেজির দাপটে বাংলা পলাতক নগরজীবনে। আর চাকরি ক্ষেত্রে সেতো বলার অপেক্ষা নেই । মাতৃভাষা কেন্দ্রিক যথার্থ পরিকল্পনা ও দূরদর্শিতা না থাকলে ভাষার সুফল ভোগ করা অসম্ভব। কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত লক্ষে পৌছা যায় না। যদিও মাতৃভাষা বাংলা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গে আজও এর পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার সুনিশ্চিত হয়নি।

এক সময়ে বাংলা প্রচলনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক, শাসন তান্ত্রিক ও আঞ্চলিক প্রতিবন্ধকতা ও অন্তরায় ছিল। কিন্তু এখন সে প্রতিবন্ধকতা নেই। তথাপি স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা ভাষা প্রচলন ও প্রসারের ব্যাপারে নানা ওজর ও অজুহাতের শেষ নেই। যেমন- অভিধানের সংকট, সঠিক পরিভাষা নেই, দক্ষ অনুবাদকের অভাব এবং আইন সংক্রান্ত পরিভাষার অভাব ইত্যাদি ইত্যাদি।

আরও পড়ুন: এ বছর এসএসসি-এইচএসসিতে হবে না নির্বাচনী পরীক্ষা

স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীর পরও যদি আমরা এসব নগণ্য বিষয়ের অজুহাতে জ্ঞান চর্চা ও জ্ঞান বিতরণের ক্ষেত্রে মাতৃভাষাকে ব্যবহার করতে না পারি তবে তা জাতির জন্য নিতান্তই দুর্ভাগ্য।
উচ্চ শিক্ষার মাধ্যম মাতৃভাষায় না হলে জাতির চিরন্তন দক্ষতা, সৃজনশীলতা এবং মননশীলতার নতুন দিগন্ত সূচিত হয় না। কেননা, মাতৃভাষায় যেভাবে চিন্তা, অনুধাবন ও উপলব্ধি করা যায় তা অন্য কোন বিদেশী ভাষায় সম্ভব নয়।

এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মনসুর মুসা বলেন, ‘মাতৃভাষায় জ্ঞান চর্চা না করতে পারলে, চিন্তা বিন্যাস করতে না পারলে এবং উন্নত যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে সমাজে যে মৌলিক চিন্তা ও সৃজনশীলতার প্রবাহ সৃষ্টি হয়না। এ কথা অনেক সমাজবিজ্ঞানী, সমাজ মনোবিজ্ঞানী, সমাজ ভাষাবিজ্ঞানী এবং শিক্ষা-বিশেষজ্ঞগণ স্বীকার করেন।’

এ চিরন্তন সত্যটি উপলব্ধি করেই বিশ্বের উন্নত বিশ্ব যেমন: ফ্রান্স, জার্মানি, সুইডেন, নরওয়ে, রাশিয়া ও জাপান প্রভৃতি দেশসমূহ তাদের মাতৃভাষার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে সুবিন্যস্ত করেছে। কেননা ভাষাগত পরাধীনতা মানুষের মৌলিক চিন্তাকে বাধাগ্রস্ত করে এবং অপরের চিন্তার চর্বিত চর্বণে বেশি উৎসাহিত করে।

পৃথিবীতে বাংলা ভাষার অবস্থান পঞ্চম । বর্তমানে বাঙলা ভাষা সম্প্রসারণশীল ভাষা। এ বর্ধনশীল বলতে শুধুমাত্র জনসংখ্যা বৃদ্ধি নয় বরং ভাষা চর্চার পরিধির ক্ষেত্রও। আধুনিক বিশ্বে বর্তমানে বাংলাদেশ- ভারতের বাহিরেও বাংলা ভাষা চর্চা ও অনুশীলন হচ্ছে।

বিবিসি বাংলা ও ভয়েস অব আমেরিকাসহ পৃথিবীর অনেকগুলো বেতার কেন্দ্র থেকে বাঙলা ভাষার সম্প্রচার হয়ে থাকে। এছাড়াও চীন, জাপান, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে বাংলা শিক্ষাদান কেন্দ্র রয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ওরিয়েন্টাল ভাষাসমূহের মধ্যে বাংলা অন্যতম ভাষা হিসেবে পঠিত হচ্ছে। আফ্রিকার দেশ সিয়েরালিয়নে এ ভাষা দ্বিতীয় অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে এ ভাষায় রচিত সাহিত্যকর্ম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অন্যান্য সাহিত্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। অনেক বিদেশী বিদ্বানরা এ ভাষার সাহিত্যকর্ম ও সাহিত্যিকদের নিয়ে গবেষণা করছে। বিগত দুই-তিন দশক থেকে দেশে বাংলা ভাষার চর্চা ও সর্বত্রগামীতার গতি বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং এর গতিকে আরও বৃদ্ধি ও ত্বরান্বিত করার জন্য বাংলা একাডেমী এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভাষাবিদ কর্তৃক ভাষারীতি প্রণয়ন করতে হবে।

মাতৃভাষাকে বিশ্বের বুকে ছড়িয়ে দিতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে বিদেশী শিক্ষার্থীদের বাংলা শেখার জন্য সরকার কর্তৃক পর্যাপ্ত বৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সকল সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ল্যাবসমৃদ্ধ ভাষা ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা কোর্স চালু করতে হবে। সর্বোপরি একটি জাতীয় অনুবাদ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বের জ্ঞানের বইগুলো মাতৃভাষায় অনুবাদ করা এবং মাতৃভাষায় রচিত জ্ঞানের বইগুলো বিশ্বের অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করে ভাষার সর্বত্রগামিতার পথ উন্মুক্ত করতে হবে।

লেখক- সহকারী অধ্যাপক, ভাষা-যোগাযোগ ও সংস্কৃতি বিভাগ,
গণ বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা