১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৮:৫১

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে পিএইচডি ডিগ্রি ন্যূনতম যোগ্যতা হওয়া উচিত

লেখক  © টিডিসি ফটো

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার জন্য যে পিএইচডি ডিগ্রি ন্যূনতম যোগ্যতা হওয়া উচিত এই মতের সাথে একমত না। তাদের কথা হলো পিএইচডির ব্যবহারটা কোথায়? অনেকের ধারণা করে প্রথম এবং দ্বিতীয় বর্ষতো বটেই এমনকি তৃতীয় বর্ষেরও অনেক কোর্স পড়ানোর জন্যও পিএইচডি ডিগ্রির প্রয়োজন নাই। কেউ কেউ বলছে একজন ভালো শিক্ষক হওয়ার জন্য দরকার সহানুভূতি মনোভাব, শিক্ষার্থীদের চিন্তা-ভাবনার বিশাল স্পেকট্রাম সম্মন্ধে ধারণা এবং খুব ভালো ওরাল ডেলিভারি স্কিল ইত্যাদি থাকা উচিত।

উপরে উল্লেখিত যোগ্যতা কার বেশি থাকার সম্ভবনা? একজন মাস্টার্স পাশাধারীর নাকি একজন পিএইচডি ডিগ্রিধারীর? উপরে উল্লেখিত গুনাগুন সম্পন্ন পিএইচডি ডিগ্রিধারীই তো খোজ উচিত। আমিতো কখনো বলিনি যে পিএইচডি ডিগ্রি থাকলেই তাকে বিনা বাক্যে, বিনা ইন্টারভিউয়ে, ফিল্টারিং ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া।

গান এবং গবেষণা হলো গুরু-শিষ্য বিদ্যা। পিএইচডি ডিগ্রির ক্ষেত্রে গুরুর অবদান অপরিসীম। Rudolph Peierls-এর ছাত্র ছিলেন Somerfield, Heisenberg, David Hilbert প্রমুখ। J. J. Thomson-কে বলা হয় নোবেল পুরস্কার ফ্যাক্টরি কারণ তার ছাত্র ছিল Rutherford, Aston, Wilson, Bragg, Barkla, Richardson এবং Appleton! এইরকম আরো বলা যাবে।

বর্তমানে বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক স্ট্যানলির অনেক ছাত্র এখন বিশ্বসেরা গবেষক যাদের অনেকেই আমার ফেসবুক বন্ধু। নোবেল জয়ী P W Anderson অনেক ছাত্র প্রডিউস করেছে যাদের অনেকেই বর্তমানে বিখ্যাত পদার্থবিদ। এর মধ্যে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিখ্যাত ছাত্র খন্দকার মোত্তালিবও আছে।

একজন ছাত্র যখন পিএইচডি করে তার একজন সুপারভাইজর লাগে যার সাথে সে ৪ থেকে ৭ বছর ধরে গবেষণার তালিম নেয়। এই সময়ে সে গবেষণা ছাড়াও অনেক কিছুই শিখে যেমন কেমন করে চিন্তা করতে হয়, কেমন করে সমস্যা সমাধান করতে হয়, কেমন করে টীমে কাজ করতে হয়ে ইত্যাদি। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে এই সময়ে সে অনেক কোর্স এটেন্ড করে, আন্ডার গ্রাজুয়েট পড়ায়, অনেক সেমিনারে অংশগ্রহণ করে বিশ্বের বড় বড় গবেষকদের সাথে মেশার সুযোগ পায়, নিজে সেমিনার দেয়। এই সবই ট্রেনিং ভবিষ্যৎ গবেষক হওয়ার ট্রেনিং। এইসবের মাধ্যমে সে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসাবে গড়ে উঠে।

এরপর আবার সে যখন আরেকজন গবেষকের অধীনে ১-৩ বছর পোস্ট-ডক করে সে আরো matured হয়। এরমধ্যে বয়স এবং ম্যাচুরিটির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে পরিপক্ক হয়। এখন এরকম একজন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার জন্য বেশি যোগ্য নাকি সদ্য মাস্টার্স করা কেউ হবেন। এমনি এমনিতো আর উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ন্যূনতম যোগ্যতা পিএইচডি করেনি। তারপরও পিএইচডি কেবল ন্যূনতম যোগ্যতা। তারপরও শিক্ষক হওয়াটা কয়েকটি ধাপে একটা লম্বা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উচিত।

শিক্ষক নিয়োগের জন্য অবশ্যই একটা সেমিনার-টকের আয়োজন করা উচিত, তার কাছ থেকে টিচিং ফিলোসফি নিয়ে একটি রচনা চাওয়া উচিত, নিয়োগ পেলে বিভাগে সে কিভাবে কান্ট্রিবিউট করবে সেই সর্ম্পকে লেখা চাইতে পারে। এরপর কয়েক ধাপে ইন্টারভিউতো আছেই। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের মতামতও নেওয়া যেতে পারে। এত কিছু পার হয়ে একজন শিক্ষক নিয়োগ পেতে পারে। আমিতো তেমন শিক্ষকের কথা বলি।

আমাদের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার কথা চিন্তা করে বলা যায় আমরা মাস্টার্স পাশধারীকে প্রভাষক হিসাবে নিয়োগ দিতে পারি তবে সেটা অবশ্যই স্থায়ী পদে না। পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন সাপেক্ষে তাকে tenured বা স্থায়ী পদে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এর মাধ্যমে প্রভাষকদের একটা চাপের মধ্যে রাখা যায় যেন সে অতি দ্রুত পিএইচডি করতে যায়। এই চাপ না দিলে অনেকেরই আর পিএইচডি ডিগ্রি হয় না।

ইদানিং একটা নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে। যেহেতু আমরা পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়াও সহকারী অধ্যাপক পদে প্রমোশন দেই তাই অনেকে সহকারী অধ্যাপক হওয়ার আগে পিএইচডি করতে যেতে চায়নাকারণ তখন শিক্ষা ছুটিকালীন সময়ে বেতন বেশি পাবে। অথচ সে জানেই না কত মূল্যবান সময় সে অপচয় করে ফেলছে। পিএইচডির জন্য সবচেয়ে স্বর্ণালী সময় হলো অনার্স কিংবা মাস্টার্স করার পর পরই। আমাদের মাস্টার্স পাশ করতে করতেই ২৫-২৬ বছর বয়স হয়ে যায়। অথচ উন্নত বিশ্বে এই বয়সের মধ্যে অনেকের পিএইচডি হয়ে যায়। তাই মাস্টার্স পাশ করার পর যত দ্রুত সম্ভব পিএইচডি করতে চলে যাওয়া উচিত। না গেলে দেখা গেছে দেরি হতে গিয়ে অনেকের বেশি দেরি হয়ে যায় এবং সংসারী হয়ে সমস্যার ডালপালা তৈরি হয়ে যায়।

যার ফলে একটা বড় অংশের আর কখনই পিএইচডি হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পিএইচডি না হলে মানসিক চাপ থাকে। প্রমোশনের সময় এই নিয়ে বার বার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। জুনিয়ররা দ্রুত প্রমোশন পেলে চাপ আরো বাড়ে। যার ফলে অনেক সময় মানসিক সমস্যাও সৃষ্টি হতে পারে। তাই সরাসরি পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের নিলে বিশ্ববিদ্যালয়কে পিএইচডি জন্য বেতনসহ ছুটি দিতে হয় না এবং এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থের সাশ্রয় হয়।

পিএইচডি ডিগ্রি যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা বলে শেষ করা যাবে না। একটি পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায় যেই দেশে যত বেশি পিএইচডি ডিগ্রিধারী সেই দেশ ততবেশি উন্নত। যেমন আমেরিকা ৬৭৪৪৯, জার্মানির ২৮১৪৭, গ্রেট ব্রিটেন ২৫০২০, ভারতের ২৪৩০০, জাপানের ১৬০৩৯, ফ্রান্সের ১৩৭২৯, দক্ষিণ কোরিয়ার ১২৯৩১, স্পেনের ১০৮৮৯, ইতালির ১০৬৭৮, অস্ট্রেলিয়ার ৮৪০০, কানাডার ৭০৫৯, তুরস্কের ৪৫১৬, রাশিয়ার ২২২৩, দক্ষিণ আফ্রিকার ২০৬০!

কল্পনা করুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক কেবল মাস্টার্স ডিগ্রিধারী? কেমন হতো? এইবার কল্পনা করুন সকল শিক্ষকের ভালো মানের পিএইচডি ডিগ্রি আছে এবং অনেকের পোস্ট-ডক অভিজ্ঞতাও আছে। এইবার ভাবুনতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেমন হতো? এই পার্থক্য যদি কল্পনা করতে পারেন তবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে কেন পিএইচডি ডিগ্রি ন্যূনতম যোগ্যতা হবে বুঝতে পারবেন। উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়তো আর বলদ না। তারা এমনি এমনি শিক্ষক নিয়োগে পিএইচডি ডিগ্রিকে প্রাধান্য দেয় না।

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়