‘ঘ’ ইউনিট তুলে দিয়ে লাভটা কী হবে?

লেখক
লেখক  © সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কীসের ভিত্তিতে কোন গবেষণার মাধ্যমে কী কারণে সব সিদ্ধান্ত নেয় সেটা আজও বোঝা হলো না! এই যে বিশ্ববিদ্যালয় বলছে, বিভাগ পরিবর্তনের ঘ ইউনিট আর থাকবে না, এর ফলে লাভটা কী হবে আমার জানা নেই। এই যে গত সাত বছর ধরে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ নেই, এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান কতোটা বেড়েছে জানা নেই। অথচ এসব প্রশ্নের উত্তর জরুরী। এ সংক্রান্ত গবেষণাও জরুরী।

গণমাধ্যম সূত্রেই জানলাম, ২০২১-২২ সেশন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘ ইউনিট থাকবে না। এর আগে ২০২০ সালের অগাস্টে ডিনস কমিটির সভায় ঘ ইউনিট তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে শিক্ষকদের একটি অংশের বিরোধীতার মধ্যে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে তা বাস্তবায়ন হয়নি। কিন্তু এবার সেটি হতে যাচ্ছে।

শুনেই আমার মেজাজ খারাপ হয়েছে। উপাচার্য মহোদয়কে বলতে শুনলমা, ঘ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা উঠিয়ে ’ক’, ’খ’ ও ‘গ’ ইউনিটের উত্তীর্ণদের মধ্য থেকে ইউনিট ও বিভাগ পরিবর্তনের সুযোগ করে দেওয়া হবে। আমার কোনভাবেই মাথায় আসে না বিজ্ঞান বিভাগের ক ইউনিটের পরীক্ষা দিয়ে কীভাবে তার কলা, সামাজিক বিজ্ঞান বা ব্যবসা অনুষদের আগ্রহ বোঝা যাবে?

আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতায় জানি, আমাদের দেশের বহু ছেলেমেয়ে বিজ্ঞান, কলা কিংবা ব্যবসা শাখা নেয় বাবা-মা বা স্কুলের শিক্ষকদের কারণে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসে অনেকেই এখান থেকে বেরিয়ে আসার স্বাধীনতা পায়। আমার নিজের জীবনেও তাই ঘটেছে।

দেখেন, ক্লাস ফাইভে ও এইটে বৃত্তি পেলাম। স্কুলের ভালো ছাত্র কাজেই সব শিক্ষকদের কথা বিজ্ঞান পড়তে হবে। এসএসসিতে কয়েক নম্বরের জন্য চট্টগ্রাম বোর্ডে বিজ্ঞান বিভাগে আমি স্ট্যান্ড করিনি। তখনো বিজ্ঞান পড়তে ভালো লাগতো না। উচ্চমাধ্যমিকেও বিজ্ঞানে পড়তে হলো। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে আমার মনে হলো আমি আর বিজ্ঞান পড়বো না। আমি কোথাও বিজ্ঞানের কোন পরীক্ষা দেইনি। বিবিএ, আইন, ঘ ইউনিট যেখানেই আমি পরীক্ষা দিয়েছি সেরা দশের মধ্যে ছিলাম কিংবা শুরুর দিকে।

আমি জানি আমার মতই এই দেশের বহু ছেলেমেয়েকে ডি ইউনিটে সুযোগ পেয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়েছে। এখন যিনি আর বিজ্ঞান পড়তে চান না তাকে যদি ক ইউনিটের বিজ্ঞান বিভাগ দিয়েই ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয় সেটা খুবই বাজে সিদ্ধান্ত। বিজ্ঞান বিভাগে পরীক্ষা নিয়ে ছেলেটা সাংবাদিকতা কিংবা দর্শনে ভালো হবে কী না সেটা যাচাই করা যাবে না। যার যে বিষয়ে আগ্রহ সেটি বা কাছাকাছি কোন বিষয়ে পরীক্ষা নিতে হবে।

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কেন হঠাৎ করে ঘ ইউনিট বাতিল করতে আগ্রহী? কারণ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, পরীক্ষার্থীদের চাপ কমাতে এই সিদ্ধান্ত। এগুলো শুনলে আমার ভীষন হাসি পায়। আচ্ছা চাপ যদি কমাতেই চান তাহলে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেন। আরও পরিষ্কার করে যদি বলি, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা যদি একদিনে হতে পারে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষাও একদিনে হওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে যার যে বিভাগে পড়ার ইচ্ছে তিনি সেভাবে সেই প্রশ্নের উত্তর দেবেন। দক্ষিণ কোরিয়াতে সেভাবেই হয়।

এবার আরেকটা কথা বলি। আজকে অনলাইনে একটা আলোচনায় ছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া নিয়ে। একদল ছেলেমেয়ে দ্বিতীয়বার ভর্তির সুযোগ চেয়ে আন্দোলন করছে। অবশ্য গত সাত বছর ধরে প্রতিবারই এই আন্দোলন হচ্ছে। এর কারণ, ২০১৪ সালের ১৫ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করে।

এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে দ্বিতীয়বার ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের ২৬ জন অভিভাবক রিট আবেদন করেন। আবেদনের ওপর প্রাথমিক শুনানি শেষে ১৬ মার্চ দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ বাতিলের সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়ার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা-ও জানতে চান আদালত। এরপর আর কী হয়েছে আমার জানা নেই।

আমি অবশ্য সব কিছু নিয়ে আদালতে যাওয়ার পক্ষে না। এর চেয়ে আলোচনা জরুরী, গবেষণা জরুরী। একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ তো থাকতে হবে। আজকের আলোচনা অনুষ্ঠানে সহকারী প্রক্টর বললেন, শিক্ষার মান বাড়াতে নাকি এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আরেকবার বললেন, দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার মতো রিসোর্স নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই।

আমি অবশ্য বুঝলাম না দ্বিতীয়বার ভর্তির সাথে শিক্ষার মানের কী সম্পর্ক, আর রিসোর্স মানেই কী? আচ্ছা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কী কোন গবেষণা আছে কী পরিমান ছেলেমেয়ে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দেয়? আচ্ছা তাদের মধ্যে কতোজন চান্স পায়? কতোজন একবছর ড্রপ দিয়ে ভালো বিষয়ে পড়তে চায়? এর ফলে কি পরিমান আসন ফাঁকা থাকে? ভর্তি পরীক্ষা একবার হলেও কি আসল ফাঁকা থাকছে না? আছে এসব বিষয়ে কোন তথ্য? আমি গত সাতবছরেও এমন কোন তথ্য দেখলাম না।

আমি বলছিনা দ্বিতীয়বার সুযোগ দিতে হবে। আবার বলছি না এই সুযোগ বন্ধ করে দিতে হবে। দেখেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা কোন রকেট সায়েন্স না। সারা দুনিয়াতেই হয়। একটু সব জায়গায় দেখেন কোথায় কি হয়। এই যে গত সাত বছর ধরে দ্বিতীয়বার ভর্তির সুযোগ নেই তাতে কী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বেড়েছে? আছে এ নিয়ে কোন গবেষণা? তাহলে কি কারনে এই সিদ্ধান্ত?

আচ্ছা আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমন পড়াশোনা হয় তা নিয়ে কোন গবেষণা আছে? কেন ছেলেমেয়েরা প্রথম বর্ষ থেকেই একাডেমিক লেখাপড়া বাদ দিয়ে চাকুরির পরীক্ষা পড়ে আমাদের শিক্ষকরা কী জানে? আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে সেটা কি আমাদের শিক্ষকরা জানেন?

দেখেন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হলে যুক্তি দিয়ে নিতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে যদি গবেষণা থাকে যে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা না নেয়ার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের এই উন্নতি হয়েছে সেটা তারা জাতিকে জানাতে পারেন। ভালো হলে আমরা সবাই সেটা মেনে নেবো। নয়তো একটা ছেলেমেয়ের দ্বিতীয়বার পরীক্ষার সুযোগ কেন বন্ধ করবেন? আর দ্বিতীয়বার দিলেই যে সে চান্স পেয়ে যাবে এমন কোন কথা আছে কী?

আরেকটা কথা, ঘ ইউনিটে সমস্যা হয়, দ্বিতীয়বারের ভর্তিতে সমস্যা! আচ্ছা এই যে গণহারে ইভিনিং মাষ্টার্স হয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়া হয়, শিক্ষক-কমকর্তা-কর্মচারীর সন্তানেরা কোটায় ভর্তি হয়ে যায় তখন শিক্ষার মানে সমস্যা হয় না?

দেখেন, আমি নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। শিক্ষকতা আমার পেশা নয় তবে পাবলিক বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই জায়গাতেই আমার পড়ানোর একটু আধটু অভিজ্ঞতা আছে। আর সারাজীবন সাংবাদিকতা করেছি, শিক্ষা নিয়ে বহু রিপোর্ট করেছি। দেশ সমাজ নিয়ে ভেবেছি,একটু আধটু বোঝার চেষ্টা করেছি।

আমার গত ২০ বছরের অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে, এই দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, ভর্তি পরীক্ষা এসব নিয়ে বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত আমরা হুট করে নেই। এর পেছনে যথাযথ গবেষণা থাকে না। বরং অনেক সময় থাকে ব্যক্তিগত রেষারেষি বা ক্ষুদ্র স্বার্থ।

কাজেই আমি আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বলবো, যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে গেলে শিক্ষাবিদদের মতামত নিয়ে, গবেষণা করে, তথ্য প্রমাণ নিয়ে ভবিষ্যত ভেবে সিদ্ধান্ত নিন। আর শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিদ্ধান্ত নিলে হবে না, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের একই রকম সিদ্ধান্ত হতে হবে। শিক্ষার্থীদের কথা ভাবতে হবে। আজকে থেকে ১০-২০ বছর পরে বিশ্ববিদ্যালয় কোন জায়গায় যাবে সেগুলো ভাবতে হবে।

ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের নীতি নির্ধারকদের বলবো, আপনারা যে সিদ্ধান্তই নেন না কেন একটু গবেষণা করে সিদ্ধান্ত নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা বলে একটা ইনস্টিটউট আছে। আমি জানি না তারা এগুলো নিয়ে আদৌ কোন গবেষণা করে কী না? এই যে সাত বছর ধরে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা নেই তার ফলে কী হয়েছে? এর আগে যখন দ্বিতীয়বার সুযোগ ছিলো সেই সময়ের সঙ্গে একটা তুলনামূলক আলোচনা হোক। সব বিষয়ে সবার মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত হোক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি নির্ধারকদের বলবো, আপনারা শিক্ষক হয়েছেন ভেবেই মনে করবেন না আপনারা যা করেন সব ঠিক। যদি তাই হতো, তাহলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বহিস্কার করতো না। একটু ইতিহাসটা মনে করিয়ে দেই।

১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলের সংযুক্ত ছাত্র ছিলেন। ১৯৪৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে যোগ দিয়ে বহিষ্কৃত হন। ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আর পড়াশোনা করা হয়ে উঠেনি তাঁর।

এবার বলেন বঙ্গবন্ধুকে বহিস্কারের সিদ্ধান্ত কী ঠিক ছিলো? না ঠিক ছিলো না। আর সে কারণেই দীর্ঘ ৬১ বছর পর ২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিবুর রহমানের ছাত্রত্ব বাতিলের বিষয়টি প্রতাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। তার মানে বিশ্ববিদ্যালয় সেই সময় ভুল করেছিল।

নীতি নির্ধারকদের কাছে অনুরোধ, একটা ভুল বুঝতে দয়া করে ৬১ বছর সময় নেবেন না। যা করবেন বুঝে শুনে, ছেলেমেয়েদের কথা ভেবে, ভবিষ্যত ভেবে সিদ্ধান্ত নেবেন। এরপর সেটা জাতিকে জানাবেন। আশা করছি, জাতির বিবেক দাবিদার আপনাদের বিবেকবোধটা আরেকটু জাগ্রত হবে।

লেখক: কলামিস্ট ও ফ্রিল্যান্সিং জার্নালিস্ট


সর্বশেষ সংবাদ