অবহেলায় মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা, তবুও সফল

অবহেলায় মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা, তবুও সফল
অবহেলায় মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা, তবুও সফল  © ফাইল ছবি

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের ২০২০-২০২১ স্নাতক শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় ‘খ’ ইউনিটে প্রথম হয়েছেন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী সাখওয়াত জাকারিয়া। একইসঙ্গে এই প্রথম দেশব্যাপী ২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষে ‘খ’ ইউনিট গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ঘ’ ইউনিটে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিক বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন যে শিক্ষার্থী সেই রাফিদ সাফওয়ানও মাদ্রাসা শিক্ষার্থী।

কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের জন্য এই ‘খ’ ইউনিটই প্রধান এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শীর্ষস্থানীয়। এমন সাফল্য পাওয়া দুজনই মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থী হওয়ায় দেশব্যাপী আলোচনার ঝড় উঠেছে। কিন্ত এরই মধ্যে বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যায় (বুটেক্স) ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকারী সাদ ইবনে আহমাদ।

একই শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সরকারি সাত কলেজ ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকারী হাসিবুর রহমান এবং জাতীয় অর্থপ্যাডিক্স হাসপাতাল ও পূনর্বাসন কেন্দ্রের (নিটোর) পরীক্ষা প্রথম হওয়া মো. নাজমুল আলমও মাদ্রাসা শিক্ষার্থী হওয়ায় এই আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।

এই সফলতার অধিকাংশ শিক্ষার্থীই ঢাকার ডেমরার দারুন্নাজাত সিদ্দিকীয়া কামিল মাদ্রাসা ও তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার। তারা দেশের নামীদামী কলেজগুলোকে পেছনে ফেলে অর্জন করেছে এই ঈর্ষনীয় সাফল্য।

কাবিল সাদি

তাই শিক্ষাঙ্গনে এই গুরুত্বপূর্ণ ও তুমুল প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরীক্ষায় মাদ্রাসা ছাত্রদের মেধার আধিপত্য আলোচনার পরিধি আরও বাড়িয়েছে। বিশেষ করে যাদের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা অনেকটাই অবহেলিত এবং অনেক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে মাদ্রাসা শিক্ষা পদ্ধতি এখনও প্রাচীন এবং কোনভাবেই মান সম্মত নয়; বিশেষ করে তাদের বাংলা ও ইংরেজিতে প্রচুর দূর্বলতা আছে।

পড়ুন: মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে মেসবাহ কামালের বক্তব্যটি ২০১৮ সালের

এমনকি খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের ইতিহাস বিভাগের একজন অধ্যাপক মেসবাহুল হক কিছুদিন আগে এক টকশোতে এই ইংরেজির দক্ষতাকে কটাক্ষ করে সাধারণ শিক্ষার তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির ইংরেজি বলে সমালোচনা করেছিলেন।

কিন্ত সাম্প্রতিক মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক সফলতার আলোচনা তাদের এই কটাক্ষ বা সমালোচনাকেই বরং সমালোচিত করেছে এবং ট্রল করা হচ্ছে নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে।

তবে মজার বিষয় হলো ইতঃপূর্বে এভাবে আলোচনায় না আসলেও মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা শিক্ষার্থীদের মূলধারার সাধারণ শিক্ষায় সফলতার নজির এবারই প্রথম নয় বরং দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক শাখার স্নাতক ভর্তি পরীক্ষায় টপটেন মেধা তালিকায় মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সুযোগ পাওয়া একটি ধারাবাহিক রেকর্ড।

এটাও বলা প্রয়োজন মাদ্রাসাগুলোতে বাণিজ্য শাখা না থাকায় এবং হাতে গণা কিছু মাদ্রাসা ছাড়া বিজ্ঞান বিভাগ না থাকায় বা থাকলেও পর্যাপ্ত শিক্ষা সরঞ্জামাদির অপ্রতুলতার কারণে এসব ইউনিটে তাদের ভাল করার কোন রেকর্ড তেমন একটা নজরে আসে না।

পড়ুন: প্রতি জেলায় অন্তত একটি মাদ্রাসা সরকারি হোক

ইতিহাস বিভাগের ওই অধ্যাপকের মতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক শাখার প্রায় ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থীই মাদ্রাসা থেকে আসা এবং তিনি একটি হাস্যকর যুক্তিও দেখিয়েছেন এর পেছনে নাকি ৮০ মার্কস পেয়ে একাডেমিক পরীক্ষার জিপিএ স্কোর যা মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই পেয়ে যান।

এমনকি তিনি মনে করেন সেখানে একাডেমিক নম্বর দেয়া শুরুই হয় ৯০ থেকে যা রীতিমত হাস্যকর, অযৌক্তিক এবং এমন মন্তব্য একজন দায়িত্বশীল শিক্ষিত ব্যক্তি থেকে আশা করা যায় না।

পড়ুন: সাড়ে ৭ হাজার ইবতেদায়ী মাদ্রাসা এমপিওভুক্তির দাবি

কিন্ত এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই স্কোর ৮০ থেকে ২০-এ নামিয়ে আনার পরও সেই একইভাবে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা তাদের ধারাবাহিক সফলতা বজায় রেখেছেন। শুধু তাই নয় এই অধ্যাপক আশঙ্কা প্রকাশ করছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এভাবে মাদ্রাসা ছাত্রদের ভর্তির সুযোগ ঘটলে অচিরেই এটি উচ্চতর মাদ্রাসায় পরিণত হবে। অথচ তিনি ভুলেই গেলেন তারেক মাসুদের মত জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা মাদ্রাসা থেকে পড়ে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনন্য মর্যাদা এনে দিয়েছিলেন এবং ফুটিয়ে তুলেছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে ধর্মান্ধ মানুষের প্রকৃত সত্য।

যাইহোক এসব অবান্তর ঠুনকো প্রশ্নের থেকেও এখন বড় প্রশ্ন হলো মূলধারার সাধারণ শিক্ষা পদ্ধতির বাইরে ও তুলনামূলক কম সুবিধা পাওয়া কথিত প্রাচীন শিক্ষা পদ্ধতির নানাভাবে অবহেলিত প্রতিষ্ঠান থেকে কিভাবে প্রতিযোগিতার পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অনুপাতিক হারে দেশের অন্যন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির সুযোগ পায়।

এই প্রশ্নগুলোর একটি সাধারণ উত্তর হলো, মাদ্রাসা শিক্ষা ও তার ইতিহাস নিয়ে আমাদের অধিকাংশ ধারণাই ভুল। উপমহাদেশের উচ্চ শিক্ষার শুরুটা কিন্ত মাদ্রাসা শিক্ষার মধ্য দিয়েই। যা আমরা অনেকেই হয়তো জানিই না।

পড়ুন: প্রতি কিলোমিটারে একটির বেশি মাদ্রাসা নয়

ভারতবর্ষে মাদ্রাসা শিক্ষার সূচনা হয় ৭১১ সালে। মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের পর পরই। সিন্ধু বিজয়ের হাত ধরে ভারতে মাদ্রাসা শিক্ষা বা ইসলামী শিক্ষার যাত্রা শুরু হলেও প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয় এরও বেশ কিছুকাল পর।

তৎকালীন ১৮০০ সালের ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার আগেই ১৭৮০ সালে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের (১৭৩২-১৮১৮ সালে) অনুমোদনক্রমে ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক শিক্ষার সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা। ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজি শিক্ষার নতুন ধারা ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৫৪ সালের পরবর্তীকালে। আর উপমহাদেশের প্রথম কওমি মাদ্রাসা দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬৬ সালে।

এতে প্রতীয়মান হয় যে উপমহাদেশে সাধারণ শিক্ষা ও বেসরকারি পর্যায়ে ইসলামি শিক্ষা, তথা কওমি ধারার শিক্ষাব্যবস্থা চালু হওয়ার আগেই আলিয়া নেসাবের শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। তাই গোটা ভারতবর্ষে আলিয়া মাদ্রাসা নেসাবের শিক্ষাব্যবস্থাটিই এতদঞ্চলের প্রাতিষ্ঠানিক ও উচ্চতর ধারার সর্বপ্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা। সময়ের ব্যবধানে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা ভারত ভাগের পর ১৯৪৭ সালে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়।

লক্ষণীয়, সে সময়ে যারা বড় বড় রাজনীতিবিদ বা সমাজ সংস্কারক ছিলেন তাদের অনেকেই মাদ্রাসা পড়ুয়া। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ বীর মীর নিসার আলী তিতুমীর, সৈয়দ আমীর আলী এবং ভাষা শিক্ষার নিমিত্তে রাজা রামমোহন রায়ও পাটনা মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছিলেন (তথ্যসূত্র:বঙ্গদর্শন) তাদের সমাজ সংস্কার ও বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অবদান স্বর্ণাক্ষরে আজও ইতিহাসে লেখা।

আমাদের বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই হয়তো জানেন না, আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক গুরু এবং অবিভক্ত বাংলার শেষ মুখ্যমন্ত্রী সেই হোসেন শহীদ সোহরার্দীও কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার আরবী বিভাগের ছাত্র ছিলেন। এছাড়াও আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীসহ দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমেদও এক সময় মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন এবং তিনিই দেশের এখন পর্যন্ত একমাত্র কুরানে হাফেজ প্রধানমন্ত্রী।

এছাড়াও মাওলানা আকরম খা, আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশদের মত ইতিহাস অলঙ্কৃত বাঘা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও ছিলেন মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। কালের ধারাবাহিকতায় এদেশে যেভাবে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় সাধারণ শিক্ষার প্রসার ঘটেছে সেই তুলনায় মাদ্রাসা শিক্ষায় প্রসার ঘটেনি ফলে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিন দিন কমেছে বই বাড়েনি।

বর্তমান সরকারের আমলে কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি, দারুল আরকাম ইবতেদায়ি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও আলিয়া মাদরাসাগুলোর ভবন নির্মাণের জন্য বিশাল অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সরকারের এসব উদ্যোগ প্রশংসাযোগ্য। কিন্তু দুঃখজনক হলো, গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দিকে আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা অবহেলার শিকার হওয়ায় এ ধারায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমেই কমছে।

শিক্ষা ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের আমলে ঈর্ষণীয় সাফল্যের একটি হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ। তিন শতাধিক মাধ্যমিক বিদ্যালয় সরকারি করা হয়েছে। ৩০০ কলেজ সরকারি করা হয়েছে। ২৬ হাজার ১৯৩টি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি করা হয়েছে, কিন্তু একটি স্বতন্ত্র বা সংযুক্ত ইবতেদায়ি মাদ্রাসাও সরকারি করা হয়নি। তিন শতাধিক মাধ্যমিক বিদ্যালয় সরকারি করা হলেও একটি দাখিল মাদরাসাও সরকারি করা হয়নি। ৩০০ কলেজ সরকারি করা হলেও একটি আলিম বা ফাজিল অথবা কামিল মাদ্রাসাও সরকারি করা হয়নি অথচ মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা মেধা ও প্রতিভার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে বার বার।

অন্যদিকে দীর্ঘদিন অপেক্ষার পরেও বেতন ভাতার অভাবে এবং জাতীয়করণ না করায় অধিকাংশ ইবতেদায়ি মাদ্রাসাগুলো উঠে গেছে। ফলে মাদ্রাসাগুলোর উপরের শ্রেণিতে ছাত্র সংকট গাণিতিক হারে বেড়েই চলেছে।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে একটি মহল মাদ্রাসা শিক্ষাকে নানাভাবে অপরাধী চক্রের সাথে সম্পৃক্ত করবার চেষ্টা করেছেন; এমন কি বর্তমান সময়ে নানা কারণেই জঙ্গি তৎপরতার সাথে ঢালাওভাবে আঙ্গুল তোলার চেষ্টা করা হয়। অথচ সাম্প্রতিক এসব কর্মকান্ডে বেশি সম্পৃক্ততা দেখা যায় ইংরেজি মাধ্যম পড়ুয়া আধুনিক শিক্ষার্থীদের।

আর এজন্যই ২০১৮ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন আয়োজিত আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষকদের মহাসমাবেশ উদ্বোধন শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছিলেন, ‘‘বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু, ধর্মান্ধ নয়। আমি বিশ্বাস করি, যারা কোরআনকে ধারণ করে তারা কখনও জঙ্গি হতে পারে না। প্রথমে বলা হতো মাদ্রাসার ছেলেরা জঙ্গি। কিন্তু আমিই প্রথম উচ্চগলায় বলেছিলাম, মাদ্রাসার সঙ্গে জঙ্গিবাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। মাদ্রাসার ছাত্ররা জঙ্গি নয়। জঙ্গি হতে পারে না।’’ (সূত্র:দৈনিক যুগান্তর)

তার এই বক্তব্যের সপক্ষে আরও বহু প্রমাণ পাওয়া যায়। বৈশ্বিক সন্ত্রাসের সাম্প্রতিক ত্রাস আইএসের সাথে যারা এদেশ থেকে যুক্ত হয়েছিল তারাও ছিল সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত এমনকি অধিকাংশই ছিল ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষিত শ্রেণি। যার প্রমাণ মিলেছে হলি আর্টিজান জঙ্গি হামলাতেও।

তাই এই কথা বলাই যায়, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের দিকে যে মহল অপরাধীর আঙ্গুল তুলতে চেয়েছেন তারা সুস্পষ্ট ও উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবেই করতে চেয়েছেন। অথচ মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জঙ্গি বা উগ্রবাদী হওয়ার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কম। কারণ তাদেরকে কুরান-হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে সন্ত্রাসবাদে সম্পৃক্ত করা অনেকটাই অসম্ভব সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণি থেকে।

সর্বশেষ যে কুমিল্লার পূজা মন্ডপের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদের ঘটনা ঘটেছে সেখানেও তাদের কোন সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি বরং কোন কোন ক্ষেত্রে মন্দির বা পূজা মন্ডপ রক্ষায় তাদের ভূমিকা পাওয়া যায় এবং এক লাইভ প্রোগ্রামে জাতীয় হিন্দু মহাজোটের সভাপতি গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক স্বয়ং সে কথা স্বীকার করে তাদের প্রশংসাও করেন।

শুধু তাই ই নয়, অসাম্প্রদায়িক চেতনার জায়গাতেও এগিয়ে মাদ্রাসাগুলো। ভারতের কলকাতার পাঁচটি বড় মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যে মুসলিম শিক্ষার্থীরাই সংখ্যালঘু। সেখানে আরবি বা ইসলামিক বিভিন্ন বিষয়ে অমুসলিম শিক্ষার্থীদের প্রথম হওয়ার রেকর্ডও আছে এবং আরও অবাক তথ্য দিয়ে মাদ্রাসা পর্ষদের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবিদ হোসেন বলেন, ‘‘পাঁচটি মাদ্রাসার এক কিলোমিটারের মধ্যেই মধ্যশিক্ষা পর্ষদ পরিচালিত বিদ্যালয়ও রয়েছে। তা সত্ত্বেও অ-মুসলিম পড়ুয়ারা মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছে।’’ (সূত্র:আনন্দবাজার পত্রিকা-৩ এপ্রিল ২০১৭)

সুতরাং এদেশের বুদ্ধিজীবী,পলিসি মেকার এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের মাদ্রাসা শিক্ষার সমালোচনা বা বিতর্ক ছড়ানো বিষয়ে আরও বেশি সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে এবং সরকারকে সাধারণ শিক্ষা প্রসারের পাশাপাশি ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা প্রসারে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যাবস্থাকে আরও বেশি আধুনিকায়নের আওতায় এনে মেধাবীদের দেশের উন্নয়নের কাজে লাগাতে হবে।

প্রকৃত ধর্মীয় জ্ঞানের মাধ্যমে যেমন সামাজিক মূল্যবোধ বাড়ানোর পাশাপাশি প্রকৃত ধর্মচর্চা ও উদ্ভুত সাম্প্রতিক জঙ্গি তৎপরতার হ্রাস করা সম্ভব অন্যদিকে বিদেশী ভাষা হিসেবে আরবি ভাষার দক্ষতা অর্জন করতে পারলে আমাদের রেমিট্যান্স প্রাপ্তির স্বর্গভূমি মধ্যপ্রাচ্যে মানবসম্পদ রফতানির মাধ্যমে অর্জিত হবে বৈদেশিক মুদ্রা যা অবদান রাখবে এদেশের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নকেও।

সাধারণ শিক্ষার সাথে জাতীয়করণ ও অন্যান্য বৈষম্য চলমান থাকলে মেধাবীদের একটি বড় অংশই হারিয়ে যাবে আমাদের অবহেলার নীতিতে যা মূলত আত্মঘাতী সিদ্ধান্তেরই শামিল। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না,মেধাবিদের বৃহৎ অংশকে পাশ কাটিয়ে উন্নয়নের মাধ্যমে স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়ন অসম্ভব।

লেখক: নাট্যকার ও ব্যাংক কর্মকর্তা


সর্বশেষ সংবাদ