ঢাবিতে ছাত্রীদের প্রতি বৈষম্য ও সাংবিধানিক অধিকার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্রীদের পাঁচটি হলে আসন বণ্টন–সম্পর্কিত নীতিমালার একটি ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ছাত্রী বিবাহিত হলে অবিলম্বে কর্তৃপক্ষকে জানাবেন। অন্যথায় নিয়মভঙ্গের কারণে তাঁর সিট বাতিল হবে। শুধু বিশেষ ক্ষেত্রে বিবাহিত ছাত্রীকে চলতি সেশনে হলে থেকে অধ্যয়নের সুযোগ দেওয়া হবে। অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রী হলে থাকতে পারবেন না।’
এ নিয়ম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পাঁচ ছাত্রী হলের শিক্ষার্থীরা। তারা নিয়ম বাতিলের দাবি জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আখতারুজ্জামান কাছে আবেদন জানান ১৩ ডিসেম্বর। ভিসি তাদের বলেছেন যে, কিছু লোকের হঠকারী চিন্তায় কিছু করা যাবে না। হল কর্তৃপক্ষ ও ডিনস কমিটির সভায় আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কোনো পরিবর্তন না আসা পর্যন্ত এ নিয়মই বলবৎ থাকবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বরাবর দেওয়া এক আবেদনে পাঁচ ছাত্রী হলের ছাত্রী প্রতিনিধিরা বিবাহিত ও অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রীদের ক্ষেত্রে থাকা ওই নিয়মটি বাতিলসহ চার দফা দাবি জানিয়েছেন (সূত্র: প্রথম আলো অনলাইন, ১৪ ডিসেম্বর ২০২১)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের জন্য থাকা পাঁচটি হল হচ্ছে রোকেয়া হল, শামসুন নাহার হল, কবি সুফিয়া কামাল হল, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল ও বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল। বিবাহিত হওয়ায় সম্প্রতি শামসুন নাহার হল ও বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের দুই ছাত্রীর সিট নিয়ে জটিলতা তৈরি হওয়ার প্রেক্ষাপটে ছাত্রীরা বিবাহিত ছাত্রীদের ক্ষেত্রে থাকা নিয়মটি বাতিলের দাবি জানান ভিসির কাছে।
বিবাহিত ও অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রীদের হলে থাকার বিষয়ে বিধি-নিষেধ সংক্রান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের করা নিয়মটি সম্পূর্ণভাবে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। সংবিধানের ২৮ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না। সংবিধানের ২৮(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।
সংবিধানের ২৮(৩) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রীদের হলে থাকা বিষয়ে যে নিয়মটি করেছে তা সংবিধানের ২৭ এবং ২৮ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কেননা এখানে শুধু ছাত্রীদের সম্পর্কে বা নারী জাতি সম্পর্কে বলা হয়েছে। কিন্তু বিবাহিত ছাত্রদের সম্পর্কে তেমনটা বলা হয়নি। তাই বলা যায়, বিষয়টি সংবিধানের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রীদের সম্পর্কে যে নিয়ম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ করেছে তা সংবিধানের ২৮(৩) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সংবিধানের ১৯(১) অনুুচ্ছেদ অনুযায়ী সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন৷ বিবাহিত ও অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রীদের প্রতি বৈষম্যমূলক নীতি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রীদের প্রতি সুযোগের অসমতা সৃষ্টি করেছেন। সংবিধানের ১৯ (২) অনুুুচ্ছেদ অনুযায়ী মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রীদেরকে সামাজিকভাবেও হেয় প্রতিপন্ন করেছেন। বিবাহিত ও অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রীদেরকে হলে অবস্থান করা নিয়ে বিধি-নিষেধ দেওয়ায় তাদেরকে অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছেেন। কেননা ঢাকা শহরের যেকোনো জায়গায় বাসা ভাড়ার চেয়ে হলে অবস্থান করা সাশ্রয়ী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় রাষ্ট্র তথা পাবলিকের টাকায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যমূলক নীতির কারণে ছাত্রী বা নারীরা সরাসরি অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
সংবিধানের ১৯(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন। এক্ষেত্রেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। কেননা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিবাহিত ও অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রীদেরকে সমান সুযোগ দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শর্তের মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে হস্তক্ষেপ করছেন।
সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ মতে আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না। কোন নর-নারী বিবাহের উপযুক্ত হলে বিয়ে করবেন কি করবেন না সেটা তার ব্যক্তি স্বাধীনতা। শর্তের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিবাহকে অনুৎসাহিত করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ, ১৯৭৩ দ্বারা। সংবিধানের ২৬-৪৪ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধানের ২৬(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে এই ভাগের বিধানাবলীর সহিত অসামঞ্জস্য সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এই সংবিধান-প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে। সংবিধানের ২৬(২) অনুুুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্র এই ভাগের কোন বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য কোন আইন প্রণয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোন বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।
মৌলিক অধিকার পরিপন্থী কোন আইন করা হলে সংবিধানের ৪৪ এবং ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে হাইকোর্টে রিট করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ১০২(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদনক্রমে সংবিধানের তৃতীয় ভাগের( মৌলিক অধিকার) দ্বারা অর্পিত অধিকারসমূহের যে কোন একটি বলবৎ করিবার জন্য প্রজাতন্ত্রের বিষয়াবলীর সহিত সম্পর্কিত কোন দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিসহ যে কোন ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে হাইকোর্ট বিভাগ উপযুক্ত নির্দেশাবলী বা আদেশাবলী দান করিতে পারিবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে বিবাহিত ও অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রীদের অবস্থান করা সংক্রান্ত নিয়মটি হয়তো বহু পূর্বেই করা হয়েছিল।
তখনকার সমাজবাস্তবতার সঙ্গে হয়তো আইনটি সামঞ্জস্য ছিল। বর্তমান সমাজ বাস্তবতা ভিন্ন। সেজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বৈষম্যমূলক নীতি অচিরেই বাতিল করতে হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সমতা নিশ্চিত করতে হবে। অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রীদের জন্য রিজেনেবল এডজাস্টমেন্ট বা যুক্তিসঙ্গত সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে। ক্লাস ও পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে যেসব ছাত্রী মা হয়েছেন তাদের সন্তান রক্ষণাবেক্ষণের জন্য উপযুক্ত স্থান সৃষ্টি করতে হবে।
ইংল্যান্ডের প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ সকল ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের পাশাপাশি ছাত্রীরাও রেখেছেন অগ্রণী ভূমিকা।
অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক শোষণ ও বৈষম্যের কারণেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের প্রতি বৈষম্য করা হবে তা মেনে নেওয়া যায় না। বিজয়ের মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বৈষম্যমূলক নীতিটি অচিরেই বাতিল করে ছাত্র-ছাত্রী সকলের জন্য একটি সার্বজনীন নীতি প্রণয়ন করবে এটাই সকলের কাছে কাম্য। সেইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যমূলক নীতির কারণে কোন ছাত্রী পূর্বে বা বর্তমানে সামাজিক বা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ক্ষতিপূরণ বহন করতে হবে।
লেখক : ব্যারিস্টার ও ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য
E-mail: mtusar2007@yahoo.com