বাংলাদেশ যেভাবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে পারে
চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এখন একটি বাস্তবতা এবং এটিকে আর অস্বীকার করার উপায় নেই। আমরা কেমন অনুভব করি, কিভাবে কাজ করি, কিভাবে থাকি, ভ্রমণ করি – সবকিছুই বদলে যাবে। ১ম শিল্প বিপ্লবটি হলো স্টিম ইঞ্জিন নিয়ে, ২য় বিপ্লবটি বিদ্যুতের, ৩য়টি ইন্টারনেট এবং কম্পিউটার বিষয়ক। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব তার পূর্বসূরির সাথে বুদ্ধিমত্তা যোগের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বকে একটি বুদ্ধিমান তথ্য সমাজে রূপান্তরিত করছে।
একটি উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যাক। একজন কোম্পানির সিইও সকালে গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট বা অ্যাপল সিরি দিয়ে আবহাওয়ার পূর্বাভাস কিংবা যানজট চেক করতে পারেন, স্ব-চালিত গাড়ি ব্যবহার করে অফিসে যেতে পারেন, সেখানে রোবট তাকে স্বাগত জানাতে পারে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ব্যবসার ভবিষ্যত সম্পর্কে ধারণা করতে পারেন, মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে ব্যবসায়িক মডেল ডিজাইন করতে পারেন, ইন্টারনেট অফ থিংস এর মাধ্যমে বাসাবাড়ির ইলেকট্রনিক্স এবং অ্যাপ্লায়েন্স নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন এবং আরও অনেক কিছু। বাংলাদেশে শীঘ্রই চালু হতে যাচ্ছে ৫জি ইন্টারনেট। এটি ব্যবসার মডেল, জীবনযাত্রার মান, শিক্ষা পদ্ধতি, ডিজিটাল এবং সোশ্যাল মিডিয়া যা গত এক দশক ধরে দেখে আসছি তার ব্যাপক পরিবর্তন করতে পারে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লব উচ্চমানের শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমেই প্রকৃতঅর্থে বাস্তবায়ন করা সম্ভব এবং তার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)’র সম্মানিত সদস্য ড. মোঃ সাজ্জাদ হোসেন প্রস্তাবিত একটি উদ্ভাবনী শিক্ষা ইকোসিস্টেম তৈরি করা যেতে পারে। এটাসহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করার জন্য ইউজিসি জাতির পিতার ১০০তম জন্মবার্ষিকী এবং দেশের স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে ১০-১১ ডিসেম্বর ২০২১ থেকে ৪র্থ শিল্প বিপ্লব (IC4IRB.ORG) এর উপর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করতে যাচ্ছে।
বিশ্বের অনেক জায়গায় যেমন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলি চতুর্থ শিল্প বিপ্লব (ফোরআইআর) এর সুবিধা নেওয়ার জন্য তাদের জনশক্তি প্রস্তুত করছে। এ কারণেই এই দেশগুলি তাদের শিক্ষায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং রোবোটিক্সকে একীভূত করেছে, প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত তাদের মানব সম্পদের জ্ঞানীয় মনকে ফোরআইআর এর নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য কাজ শুরু করেছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন দেখেছিলেন ‘সোনার বাংলা’র - ক্ষুধা ও দুর্নীতিমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশের। একই দর্শন বহন করে কিন্তু বর্তমান ডিজিটাল দুনিয়ায় তার স্বপ্ন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার সুযোগ্য আইসিটি উপদেষ্টার দূরদর্শী নেতৃত্বে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’ রূপান্তরিত হয়েছে এবং এখন সেটি ‘উদ্ভাবনী বাংলাদেশের’ দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সরকার একটি নিরাপদ, উন্নত ও উদ্ভাবনী দেশের মর্যাদায় পৌঁছাতে ভিশন ২০২১, ভিশন ২০৩০, ভিশন ২০৪১ এবং ভিশন ২০৭১ এবং ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ প্রণয়ন করেছে।
এখন বিশ্লেষণ করা যাক বাংলাদেশ কিভাবে বিশ্বে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের একটি উদীয়মান রোল মডেল হতে পারেঃ
প্রথমত, ডিজিটাল বাংলাদেশের শক্ত ভিত্তি। গত তের বছরে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নের ফলে সারা দেশে, প্রায় প্রতিটি সেক্টরের পাশাপাশি মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বিশাল আইসিটি অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি) এখন ফাইবার অপটিক্যাল তারের মাধ্যমে সংযুক্ত করা হচ্ছে, স্কুলগুলো এখন শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব দিয়ে সজ্জিত, হাজার হাজার ইন্টারেক্টিভ কনটেন্ট এবং ই-বুক ডিজাইন ও ডেভেলপ করা হয়েছে, ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করা হচ্ছে, ইত্যাদি। এইভাবে, ডিজিটাল বাংলাদেশ আমাদের দেশে ফোরআইআর চালু করার জন্য একটি উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে।
দ্বিতীয়ত, দারুণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় $৩২৭ বেড়ে $২,৫৫৪ হয়েছে। ২০২১ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ স্বল্পোন্নত দেশ(এলডিসি)ক্যাটাগরি থেকে বাংলাদেশকে উন্নীত করার একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে ১৫,০০০ ডলারের মাথাপিছু আয়ের পাশাপাশি জনগণকে সমানভাবে ক্ষমতায়ন করে একটি ধনী দেশে পরিণত হওয়ার পরিকল্পনা করেছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনাকে কোনো বিলম্ব ছাড়াই শুরু করা উচিত। দেশের জিডিপি আকার আজকের ২২৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০৪১ সালে ২.৬ ট্রিলিয়ন ডলারে পরিণত হবে। এখন সরকার উচ্চশিক্ষা ঋণ কর্মসূচি চালু করতে পারে। করদাতার আয় এবং চাকরির সু্যোগের উপর ভিত্তি করে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে, সরকার-ভর্তুকি এবং সম্পূর্ণ ফি প্রদানের মতো উচ্চ শিক্ষার প্রকল্পগুলো থাকা উচিত। সরকার ফোরআইআর সম্পর্কিত কোর্স এবং প্রোগ্রামগুলিতে আরো বেশি ভর্তুকি প্রদান করতে পারে।
তৃতীয়ত, কর্মক্ষম বয়সের জনসংখ্যার অনুপাত। আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৩তম কিন্তু জনসংখ্যার দিক থেকে আমরা বিশ্বের ৮ম বৃহত্তম দেশ। আমাদের এখন কাজের বয়সের লোক(১৫-৬৪ বছর) আগের যেকোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশি রয়েছে। এটি এখন ৬৬শতাংশ এবং ২০৩০ সাল নাগাদ তা ৭০ শতাংশে উন্নীত হবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আবির্ভাবের ফলে অনেক চাকরি চলে যাবে, এটা সত্য কিন্তু আরও বেশি নতুন চাকরির সৃষ্টি হবে। তাই যদি এই বৃহৎ জনসংখ্যাকে ফোরআইআর এর জন্য একটি দক্ষ কর্মশক্তিতে রূপান্তর করা যায়, তাহলে এটি আমাদের চলমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নকে আরো শক্তিশালী করবে।
চতুর্থ, ব্লেন্ডেড, অনলাইন ও ডিজিটাল শিক্ষার বিস্তার। ব্লেন্ডেড লার্নিং হতে পারে সারাদেশের উচ্চ-প্রযুক্তি, নিম্ন-প্রযুক্তি এবং প্রযুক্তিহীন জনগণকে সংযুক্ত করে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের একটি ভাল সমাধান। ইউজিসি সম্প্রতি ন্যাশনাল ব্লেন্ডড লার্নিং পলিসি ২০২১ নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে এবং এখন সরকার এটিকে প্রাক-প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত বিস্তৃত করছে। পরবর্তী ধাপ হল অনলাইন ডিজিটাল শিক্ষা- বাংলাদেশ এখনও বৈশ্বিক অনলাইন শিক্ষা শিল্পে তার উপস্থিতি বুঝাতে পারেনি, যা মূল্যমান ২০২৬ সালের মধ্যে $৩৭৫ বিলিয়ন হতে পারে। এটি সহজেই রেমিট্যান্স এবং গার্মেন্টসের পরে তৃতীয় সর্বোচ্চ আয়ের উৎস হতে পারে, যদি ফোরআইআর প্রযুক্তি শিক্ষাব্যবস্থার সাথে কার্যকরভাবে সংহত করা যায়।
পঞ্চম, ফলিত গবেষণা এবং উদ্ভাবনের প্রবণতা বৃদ্ধি। যদিও বিভিন্ন বৈশ্বিক সূচকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিং ততটা ভালো নয় কিন্তু আমরা কৃষি, অটোমেশন, ফ্রিল্যান্সিং, এসএমই সেক্টর, নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য বিমোচন ইত্যাদি ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান উন্নতি করছি। সরকার সাম্প্রতিক বছরগুলিতে তার বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে তৃতীয় এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সম্পর্কিত গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য আরও বেশি তহবিল বরাদ্দ করছে।
ষষ্ঠ, কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া। $৩০০ মিলিয়ন মূল্যের ত্বরান্বিত এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তনের জন্য দক্ষতা শক্তিশালীকরণ ‘এসেট’ প্রকল্পটি ১ মিলিয়নেরও বেশি যুবক ও কর্মীদের ভবিষ্যতের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা দিয়ে তৈরি করবে। প্রতিটি উপজেলায় একটি করে টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থাকবে এবং উপজেলা আইসিটি ট্রেনিং অ্যান্ড রিসোর্স সেন্টার ফর এডুকেশন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কারিগরি শিক্ষায় গ্র্যাজুয়েটদের চাকরির জন্য অপেক্ষা করতে হয় না বরং তারা অন্যদের চাকরি সু্যোগ তৈরি করে।
সবশেষে, ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সংযোগের গুরুত্ব অনুধাবন। প্রতি বছর প্রায় ২ মিলিয়ন নতুন প্রবেশকারী শ্রমশক্তিতে যোগদান করে কিন্তু এখনো ৩৮.৬ শতাংশ স্নাতক বেকারত্ব প্রকারান্তরে দক্ষতার অমিল নির্দেশ করে। ফলে বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি, কর্পোরেট সংস্থা এবং বহু-জাতিক কোম্পানিগুলোতে প্রযুক্তিগত ও ব্যবস্থাপনা স্তরে বিদেশীরা আমাদের চাকরির বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে। জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মতে এই প্রবণতা বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর $৬ বিলিয়ন রেমিট্যান্স নিয়ে যায়। এখন সরকার এটা ভালভাবে বুঝতে পেরেছে এবং প্রয়োজন-ভিত্তিক কারিকুলাম, আউটকাম বেজড শিক্ষা, বিভিন্ন পর্যায়ের ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম ইত্যাদির উপর জোর দিয়েছে।
ভবিষ্যত কাজগুলো হবে এমন যা মেশিন করতে পারে না, একই সাথে সৃজনশীল প্রচেষ্টা, সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার মতো ক্ষেত্রগুলি যেখানে মানুষ মেশিনকে হারাতে পারে, সেগুলো ক্ষেত্র চাকরি সৃষ্টির জন্য উন্মুক্ত থাকবে। বাংলাদেশ ২০২৫ সালের মধ্যে আইটি সফটওয়্যার রপ্তানি থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার আয়ের পথে রয়েছে, যা হয়তো একদিন আমাদের গার্মেন্টস শিল্পকে ছাড়িয়ে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা। এখন আমাদের নীতিনির্ধারকদের উচিত চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সম্পর্কিত গবেষণা ও উদ্ভাবনকে অগ্রাধিকার দিয়ে শিক্ষানীতি পুনর্বিবেচনা করা, যাতে বৈশ্বিক পর্যায়ে আমরা একটি প্রতিযোগিতামূলক, উদ্ভাবনী এবং দক্ষ দেশ হিসাবে টিকে থাকতে পারি। তাই চলুন উদ্ভাবন করি - অনুকরণ নয়।
লেখক: ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লেন্ডেড লার্নিং সেন্টারের পরিচালক এবং বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির আইসিটি ও শিক্ষা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান।