শিক্ষক কেন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী?
শিক্ষকরা জাতির আলোকবর্তিকা, তাঁরা দেশ গড়ার কারিগর হিসেবে বেশি পরিচিত। তাঁরা শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে গোটা জাতিকে আলোকিত করে তোলেন। পিতা-মাতা সন্তান জন্ম দিয়ে লালন-পালন করে পৃথিবীতে বড় করে তুলেন আর শিক্ষক আমাদের শিক্ষা দিয়ে এই পৃথিবীতে সত্যিকারের মানুষের মতো চলার উপযোগী করে গড়ে তুলেন।
আগে সহকারী শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল পুরুষদের স্নাতক এবং নারীদের এইচএসসি। কিন্তু ২০১৯ নিয়োগবিধি অনুযায়ী সহকারী শিক্ষকদের নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য দ্বিতীয় শ্রেণির স্নাতক করা হয়েছে। তাছাড়া নিয়োগ লাভের পরে প্রাথমিক শিক্ষকদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য আইইআরের অধীনে দেড় বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন কোর্স করতে হয়।
এ সকল যোগ্যতা অনুযায়ী শিক্ষকরা প্রথম শ্রেণির গ্রেড পাওয়ার যোগ্য। অথচ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সহকারী শিক্ষকরা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। নিম্নমানের বেতন ভাতার কারণে উচ্চ শিক্ষিতরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে চায় না। অথচ সমযোগ্যতায় অন্যান্য অধিদপ্তরে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির গ্রেডে বেতন পায়।
পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোসহ অধিকাংশ দেশে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন-মর্যাদা সর্বাধিক। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিক্ষকদের ভিআইপি মর্যাদা দেয়া হয়। জাপান, আমেরিকা, ফিনল্যান্ডের মতো দেশে কর্মকর্তা তো দূরের কথা, মন্ত্রীর থেকেও শিক্ষকদের মর্যাদা বেশি দেয়া হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন-মর্যাদা একেবারে তলানিতে।
আমাদের দেশের কর্মকর্তরা কখনও শিক্ষকদেরকে কর্মকর্তার সমান মর্যাদায় দেখতে চান না, তাইতো তাঁরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন খাড়া যুক্তি দাড় করান। তাঁরা এমন ভাবেন যে, ছোট শিশুদের পড়ায় বলে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন-পদমর্যাদাও ছোট করে রাখতে হবে; তা নাহলে কর্তৃপক্ষের সম্মান যেন চলে যায়।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে ১০ম গ্রেডের দাবি করলেও কর্তৃপক্ষ যুক্তি দেখাচ্ছে যে, সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের গ্রেড যেহেতু ১০ম, তাহলে প্রধান শিক্ষকদের কীভাবে ১০ম গ্রেড দেয়া যায়? কর্তৃপক্ষের এই কথার মানে কি এটা দাঁড়ায় না যে, শিক্ষকদের বেতন মর্যাদা কর্মকর্তাদের নিচে থাকতে হবে?
একজন শিক্ষক হাজার হাজার কর্মকর্তা তৈরি করেন। পক্ষান্তরে, একজন কর্মকর্তা সারা জীবনেও একজন শিক্ষক তৈরি করতে পারবেন না। তাহলে শিক্ষকের বেতন-মর্যাদা কেন কর্মকর্তাদের নিচে থাকতে হবে?
সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের বেতনের সাথে কর্মকর্তাদের বেতন গ্রেডের তুলনা করা হয়না। জেলা শিক্ষা অফিসারের ৬ষ্ঠ গ্রেড, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের ৯ম গ্রেড, সহকারী মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের গ্রেড-১০, অপরদিকে সরকারি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের ৬ষ্ঠ গ্রেড, সিনিয়র সহকারী শিক্ষকের ৯ম গ্রেড, সহকারী শিক্ষকের ১০ম গ্রেড।
তাহলে, প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষক, সহকারী শিক্ষকের ৯ম/১০ম গ্রেড করার কথা বলা হলে এটিইও, টিইওদের সাথে তুলনা করা হয় কেন? মনে রাখতে হবে, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস ও প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দুটি আলাদা বিষয়। একটি একাডেমিক ও আরেকটি কাজ করে প্রশাসনিক বিষয়ে। তাই প্রাথমিক শিক্ষকদের গ্রেড উন্নয়নের দাবী করা হলে টিইও, এটিইওদের সাথে তুলনা করা অযৌক্তিক।
সরকারি কলেজের বিভিন্ন গ্রেডের(৪র্থ-৫ম, ৬ষ্ট, ৭ম, ৯ম) শিক্ষকদেরতো মাউশির ৯ম গ্রেডের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিতে ও কলেজ পরিদর্শন করতে কোন সমস্যা হয়না,তাহলে প্রাথমিকে সমস্যা হবে কেন? তাই, প্রাথমিক শিক্ষকদের গ্রেডের দাবী যৌক্তিক।
প্রাথমিকে পদোন্নতির কোন সুব্যবস্থা নেই। কিন্তু অন্যদের এই যোগ্যতায় ১০ম গ্রেডে প্রবেশ ও দ্রুত পদোন্নতির ব্যবস্থা আছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে ১ম যোগদানের পর প্রশিক্ষণসহ ৭ বছর চাকরিকাল অতিক্রম করলে পদোন্নতির কথা থাকলেও পরবর্তী পদ (প্রধান শিক্ষকের পদ) খালি না থাকায় পদোন্নতি আর পাওয়া হয় না। গ্রেডেরও পরিবর্তন হয় না। আবার পূর্বের তিনটি টাইমস্কেলের পরিবর্তে এখন ১৬ বছরে দুটি উচ্চতর গ্রেড নিয়ে একই পদে থেকেই চাকরি শেষ করতে হয়।
একই কারিকুলাম, একই সিলেবাস ও একই শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করা পিটিআই পরীক্ষণ বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে নিয়োগ যোগ্যতা : স্নাতক (দ্বিতীয় শ্রেণি), দেড় বছরের ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন (ডিইনএড) বেতনগ্রেড : ১০ম। সুতরাং প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের বিশেষ করে যাদের যোগ্যতা স্নাতক সমমান তাদের ১০ম গ্রেড পেতে বাঁধা কোথায়?
তাই যৌক্তিকতা বিবেচনায় পিটিআই পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের কর্মচারীদের ন্যায় প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড উন্নীত করণের দাবী ন্যায়সঙ্গত ও যৌক্তিক।
মানসম্মত শিক্ষা পেতে হলে শিক্ষকদের বেতনভাতা বৃদ্ধি করতে হবে। যোগ্যতার মাপকাঠি সকল স্তরে সঠিক রাখতে হবে, তবেই দেশ এগিয়ে যাবে। একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী থেকে দেশ ভালো কিছু আশা করতে পারে না। সম্মানিত শিক্ষাবান্ধব ডিজি মহোদয় ও সচিব মহোদয়ের প্রতি নিবেদন অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের স্নাতক ডিগ্রীধারীদের কততম গ্রেডে বেতন দেওয়া হচ্ছে তা পর্যালোচনা করে ন্যায্যতার ভিত্তিতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন গ্রেড নির্ধারণ করা আবশ্যক।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়