সমস্যাটা কি তাহলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নে?
সংস্কৃত বিভাগ থেকে মাস্টার্স করে সংস্কৃত লিখতে বা বলতে পারে না। এমন একটি সংবাদ বিভিন্ন প্রকার গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। এই জের ধরে সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক ড. মাধবী রানী চন্দ বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান যে দিনদিন খারাপ হচ্ছে তা অস্বীকার করার কোন উপায় নাই। অনেকেই মুখস্ত করে পাশ করে ফেলে।
তারও বেশ আগে ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ভর্তি হয় তার ৬০% মাদ্রাসার শিক্ষার্থী যাদের ইংরেজি জ্ঞান বাংলা মাধ্যমের চতুর্থ শ্রেণীর সমান। তাহলে বাংলা মাধ্যমের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্ররাই যদি এত ইংরেজি জানে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ইংরেজির জাহাজ হয়েও কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারছে না? সমস্যাটা কি তাহলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নে? সমস্যা যেটাই হউক অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে বাংলা মাধ্যম হউক আর মাদ্রাসা মাধ্যম হউক আমাদের শিক্ষার মান দিনদিন নামছে।
ইনফ্যাক্ট আন্তর্জাতিক মানদণ্ডেও দেখা গেছে বাংলাদেশের শিক্ষার মান ২.৮% যা দক্ষিণ এশিয়ার তলানিতে। শিক্ষার মান কতটা নিচে তা বোঝার জন্য একটা পরিসংখ্যান দেই। ২০১৯-২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার জন্য কোন দেশ থেকে কত শিক্ষার্থী গিয়েছে সেই পরিসংখ্যানটা নিশ্চই একটি ভালো ইনডেক্স হতে পারে। এই র্যাঙ্কিং-এ প্রথম দেশটির নাম চীন।
সেখান থেকে ওই শিক্ষাবর্ষে মোট প্রায় ৩ লক্ষ ৭২ হাজার শিক্ষার্থী যায়। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ভারত যেখান থেকে ১ লক্ষ ৭৩ হাজার শিক্ষার্থী যায়। ভারত চীনের জনসংখ্যা বিবেচনায় নিলে এইটা ঠিকই আছে। যেটা আশ্চর্যের সেটা হলো প্রায় ৩ কোটি জনসংখ্যার দেশ নেপাল থেকে গিয়েছে ১২ হাজার ৭ শত জন।
আর নেপালের ছয়গুন বেশি জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশ থেকে গিয়েছে ৮ হাজার ৮ শত জন। কি লজ্জার না? বাংলাদেশে শত শত ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়। ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল না থাকলে এই সংখ্যা আরো অনেক অনেক কম হতো। নেপালে এত ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল নেই। বড়জোর ৫টা বিশ্ববিদ্যালয় আছে। বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ নিয়ে আন্ডারগ্রাজুয়েট এবং টিচিং বা রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ নিয়ে পিএইচডি করতে যায়।
আমাদের বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার মান আরো কয়েক ধাপ নামানোর সকল রকমের ফর্মালিটি শেষ করে এখন কেবল কার্যকরের অপেক্ষায়। ২০২৩ সাসের শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন শিক্ষাক্রম তৈরী করেছে আমাদের গুণধর শিক্ষামন্ত্রণালয়। সেখানে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা এখন থেকে যেই বিষয় কারিগরি বোর্ডে পড়ানোর কথা তা এখন থেকে main stream শিক্ষা বাংলা মাধ্যমেও পড়ানো হবে। মারহাবা বলুন। অর্থাৎ বাংলা মাধ্যমকে কারিগরি মাধ্যমের দিকে নামানো হলো।
বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের উচ্চতর গণিত না পড়িয়ে আর পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ও রসায়ন কম পড়িয়ে তার বদলে ভালো থাকা নামক আরেক আজগুবি বিষয় পড়ানো হবে বলুন মারহাবা। অন্যদিকে প্রযুক্তি নামক বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল যে এইটা এখন ক্লাস সিক্স থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত সকল শ্রেণীতে পড়ানো হবে। WOW না? পৃথিবীতে আমাদের উদ্যেশ্য তথ্য প্রযুক্তিতে দুনিয়ার নেতৃত্ব দেওয়া।
বলে রাখলাম আজ থেকে ১০ বছর পরে সকলে বুঝতে পারবেন কি বলদামীটাই করতে যাচ্ছি আমরা। আমাদের নতুন প্রজন্মকে নিম্নমানের শিক্ষা প্রদানের জন্য যারা কাজ করছেন এবং আজকে যারা এই বিষয়ে চুপ করে আছেন আজ যারা চুপ করে আছে তাদের উপর অভিশাপ লাগবে। কারণ এর ক্ষতিটা কতটা সুদপ্রসারী হবে তা আমি এখনই দেখতে পাচ্ছি। প্রযুক্তি আগে না বিজ্ঞান আগে এইটা বোঝার ক্ষমতা যেই জাতির নাই সেই জাতি মিস্ত্রি আর কামলা বানাবে এটাই স্বাভাবিক।
লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়