মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢালাওভাবে ছোট করা গুরুতর অন্যায়
“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন উচ্চতর মাদ্রাসায় পরিণত হয়েছে এবং এটা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় ৬০% এর বেশি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। তাদের ইংরেজি ভিত্তি এত খারাপ, মাদ্রাসায় যে ইংরেজি পড়ে তা ক্লাস ফোরের সমমান। ফলে ইংরেজিতে দক্ষতাবিহীনভাবে তারা এসে ঢাকাসহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে এবং একটা গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে টেনে টেনে নিচে নামিয়ে নিয়ে আসছে”- অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাইম এশিয়ার উপাচার্য।
এটি একটি পুরোনো বক্তব্য নতুন করে সামনে এসেছে। বক্তব্য পুরোনো হলেও তামাদি হয়ে যায় না। আলোচনা হতেই পারে। এই বক্তব্যের দুটি গুরুতর সমস্যা আছে।
১) এই রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থার একটি স্বীকৃত মাধ্যম হলো মাদ্রাসা শিক্ষা। সেই স্বীকৃত মাধ্যমকে এমন ঢালাওভাবে ছোট করা গুরুতর অন্যায়। এটা উনি করতে পারে না।
২) যদি উনার মন্তব্য সত্যি বলে ধরেই নেই তাহলে সমস্যাটা আসলে কার? উনার কথার অর্থ দাঁড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা এমন মানের হয় যে চতুর্থ শ্রেণির ইংরেজি জ্ঞান নিয়ে মাদ্রাসার ৬০% শিক্ষার্থী ভর্তি হয়ে যেতে পারে। এইটাতো গুরুতর সমস্যা।
তাহলে সমস্যাতো আসলে আমাদের ভর্তি পরীক্ষার মানের। এইটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নের মানে বিরাট সমস্যা আছে। আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডারগ্রাজুয়েটে ভর্তি হতে হলে শিক্ষার্থীদের SAT পরীক্ষা দিতে হয়। এটি সারা বছর ধরেই হয়। SAT পরীক্ষার প্রশ্নের মানের সাথে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নের মানের তুলনা করলে বোঝা যাবে আমাদের প্রশ্নমান কত নিম্নমানের।
ইউরোপ-আমেরিকার ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির জন্য কেবল SAT-ই যথেষ্ট না। তাকে একটি রচনা লিখতে হয়, তার এক্সট্রা কাররিকুলার থাকতে হয়, ভালো রেজাল্ট ইত্যাদি অনেক কিছু দেখে। যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের যেই সাবজেক্টে পড়তে চায় সেই সম্বন্ধেও একটি রচনা লিখতে হয়। এইগুলো শিক্ষার্থী নিজেকেই লিখতে হয়। অন্য কেউ লিখলে বা অন্য কারো লেখা কপি করলে ধরে ফেলে। এর মানে ওরা ভর্তিকে খুবই গুরুত্বের সাথে দেখে। তার মানে শিক্ষার্থীদের দেওয়া সকল তথ্যাদি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে প্রতিটা বিষয় যাচাই বাছাই করে।
আমাদের দেশে শিক্ষার বর্তমানে তিনটি মাধ্যম আছে। আমাদের উচিত তিনটি মাধ্যমেরই যেন যথেষ্ট রিপ্রেসেন্টেশন থাকে। একটি বিশ্ববিদ্যালয় হবে সমাজের সকল শ্রেণির মিশ্রনের স্থান। এইটা কেবলই বাংলা মাধ্যম বা কেবলই মাদ্রাসা অথবা কেবলই ইংরেজি মাধ্যমের জন্য হতে পারেনা। আমাদের উচিত ভর্তি পরীক্ষাকে আরো যুগোপযোগী করা। পরীক্ষার মান সব সময়ই ধীরে ধীরে উন্নত করতে হবে। পরীক্ষার মানই ছাত্রছাত্রীদের মান নির্ধারণ করবে। আমাদের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকেও যুগোপোযগী করতে হবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যদি সকল মাধ্যমের মিলনস্থল বানাতে পারি তাহলেই কেবল একটি সুস্থ্য সমাজ তৈরী হবে।
ইদানিং লক্ষ্য করছি অনেকের পুরোনো বক্তব্যকে উদ্যেশ্যমূলকভাবে সামনে এনে মামলা পর্যন্ত করছে। যেমন কিছুদিন আগে ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একটি পুরোনো লেখাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে একটি মামলা হয়। তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক অধ্যাপক জিয়া রহমানের বিরুদ্ধেও একটি পুরোনো বক্তব্যকে কেন্দ্র করে মামলা হয়।
সম্প্রতি একটি সংগীত ব্যান্ডের পুরোনো একটি গানকে কেন্দ্র করেও একটি মামলা হয়। এই মামলাগুলোও করছে একটি নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠী। সরকারের উচিত এই বিষয়ের দিকেও নজর দেওয়া। কেন হঠাৎ করে কোন একটি পুরোনো বিষয় সামনে চলে আসে।
লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়