বাদশাহ আছে আলমগীর নেই, শিক্ষক আছে সম্মান নেই
আদর্শ সামাদ, লক্ষ্মীপুরের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠ। ১৯৯১-১৯৯৬। ছাত্র হিসেবে ভেজায় দুষ্টু ছিলাম। প্রতিদিন স্যারদের মাইর হজম করতে হত। আসলে প্রতিদিন না বলে প্রতিদিনের প্রতি ঘণ্টায়, এমন কোনো দিনের কোনো ঘণ্টা বাদ ছিলো না যেদিন হয় পড়া, না হয় হাতের লেখা, না হয় দুষ্টুমির কারণে বেতের বাড়ি পিঠে পড়েনি।
একদিন... ওয়াদা, নিজের সাথে নিজের। যে করেই হোক আজ সাত ঘণ্টার কোনো ঘণ্টায় বেতের বাড়ি খাবো না। যেই ভাবা সেই কাজ। এক এক ঘণ্টা করে পার হচ্ছিলো নানা কৌশলে। ষষ্ঠ ঘণ্টা শেষ হতে চলল। ঠিক সপ্তম ঘণ্টায় ক্লাস চলাকালীন পাশে বসে থাকা বন্ধুটি তার পাঁচ টাকা আমার বুক পকেটে একবার ঢুকায় আরেকবার বের করে, এভাবে করতেছিলো।
আমি তো স্ট্যাচু হয়ে বসে আছি বিকজ আজ এই পিরিওড কোনোমতে পার করতে পারলেই রেকর্ড হবে আমার। ঠিক সেই সময় দেখে ফেললেন এসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার।
উনার একটা বাইক ছিলো হুন্ডা ৫০ জাপানি মডেলের। হেলিকপ্টারের মত আওয়াজ করতো। তাই ছাত্ররা উনার নাম দিয়েছে হেলিকপ্টার স্যার। তো স্যার ডাকলেন দুজনকে। ক্রিমিনাল বন্ধুটি বেতের বাড়ি থেকে বাঁচতে বললো- স্যার এ আমার পাঁচ টাকা নিয়া গেছে। স্যারও আমার বুক পকেটে টাকাটা পাই সে কি মাইর! আমার আর রেকর্ড করা হলো না। পরবর্তী সময়ে হইছিলো কিনা জানিনা।
সপ্তম শ্রেণীর ক্লাস টিচার ছিলেন একজন স্যার, উনার ছদ্মনাম ছিলো ‘আগে একটা খান’ (বেতের বাড়ি, তাও হাতের উল্টা পিঠে)। মানে হইলো পড়া পারেন নাই কেনো, স্কুলে আসেন নাই কেনো, দুষ্টুমি করেছেন কেনো, কৈফিয়ত দেয়ার আগেই- কোনো কথা নাই, আগে একটা খান, তারপর বলেন।
এমনকি কেউ বিচার নিয়ে গেলে, বিচার প্রার্থী এবং যার নামে বিচার উভয়কে আগে একটা খেতে হবে, তারপর বিচার শুনবেন। তারপর অপরাধীকে উত্তম-মধ্যম দেবেন। এই আগে একটা খাওয়ার ভয়ে উনার ক্লাসে বিচারের সংখ্যা ছিলো নিন্মমুখী। আল্লাহ্ সোবহানওয়াতায়ালা আমার স্যারকে বেহেশতের উঁচু মাকাম দান করুক, পরলোকগমন করেছেন বেশ কয়েকবছর আগেই।
সে সময় আপাদমস্তক শুভ্র সাদা ছিলেন হেডমাস্টার স্যার। চুল সাদা, দাড়ি সাদা, পাঞ্জাবি সাদা, পায়জামা সাদা। এজন্য ছাত্ররা মজা করে ডাকতো ‘জ্বীন স্যার’। অবশ্যই স্যারদের আড়ালে। শুনলে খবর ছিলো। তো হেডমাস্টার স্যারের রুম কেমন, রুমের দরজা কেমন, জানালা কেমন, রুমের ভেতর তো দূরে থাকুক, জানতাম না। মোটকথা পাঁচবছরের সিক্স টু টেন, একদিনের জন্য ওইদিকে যাওয়া তো দূরে থাক, চোখ দিয়ে তাকাইতামও না। যদি বলেন ভয়ে, অবশ্যই না, ভয় শ্রদ্ধা ভালোবাসা সবই ছিলো সম্মানিত স্যারদের জন্য সবসময়।
এই যে এত এত গোপন কাহিনী আজ প্রকাশ করে দিলাম, আমার নিজের ছাত্ররাও হয়তো আছে এখানে। দীর্ঘ একুশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে তো আর কম ছাত্র পড়াইনি (পাবলিক স্কুলে তিন + টুমচর মাদ্রাসায় আঠারো)। শিক্ষকদের উপর কোনো রাগ-ক্ষোভ রাখা এবং থাকার প্রশ্নই আসে না এমনকি আমার বাবা-মায়েরও। আজও উনাদের কথা মনে হলে উতলা হয়ে উঠে মন-প্রাণ।
প্রাইমারিতে পড়েছিলাম মোরশেদ স্যারের নিকট। যে স্যার ছিলো ছাত্রদের জন্য মুর্তিমান আতংক, বেত হাতে থাকতো সবসময়। আমার স্পষ্ট খেয়াল আছে ওযু শিখেছি মোরশেদ স্যারের কাছেই। এইতো সেদিন স্যারের একটি ছবি ফেসবুকে দেখে বুকটা হাহাকার করে উঠে... যথেষ্ট রাগি এই স্যারই পরবর্তীতে দেখি সবারই প্রিয় স্যার। ইনশাআল্লাহ... অচিরেই স্যারকে দেখতে যাবো। স্যারের বাড়ির ঠিকানা পাবার অপেক্ষায়।
এই যে স্যারেরা শাসন করেছেন, মেরেছেন, মনে পড়লে হাসি পায়। মজা করি বন্ধুদের আড্ডায় এসব নিয়ে এখনো। এরকম আরো শত শত ঘটনা আছে। আদর্শ সামাদিয়ান-৯৬ ব্যাচের সবারই জানা এসব ঘটনাগুলো।
লেখক: শিক্ষক, টুমচর ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসা