আমাদের সন্তানদের কেরানি-পিয়ন বানানোর শিক্ষাব্যবস্থা বাতিল করতে হবে

কামরুল হাসান মামুন
কামরুল হাসান মামুন  © ফাইল ছবি

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে যখনই কোন নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেছে এসেই প্রায় সকল সরকারই একটি শিক্ষা কমিশন করেছে। প্রথম শিক্ষা কমিশন হয় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে ১৯৭২ সালে। সদ্য স্বাধীন হওয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের মানুষদের জন্য শিক্ষার কথা ভাবা একটু বিলাসিতা মনে হলেও বঙ্গবন্ধু শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন বলেই একজন যোগ্য মানুষকে দিয়ে সেই কমিশন গঠন করেছিলেন।

সেই কমিশন ১৯৭৪ সালে তাদের প্রতিবেদন পেশ করে আর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে রাজনীতির পরিবর্তন ঘটায় এ প্রতিবেদন আর আলোর মুখ দেখেনি। এমনকি তার কন্যা টানা ৩ বার ক্ষমতায় থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের কথা বললেও সেই কমিশনের স্পিরিটটাতো বাস্তবায়ন করেইনি বরং আমরা উল্টো পথে যাচ্ছি।

এরপর ১৯৮৩ সালে মজিদ খান কমিশন হয়। ১৯৮৮ সালের মফিজ উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে কমিশন গঠিত হয়। তারপর আবার ১৯৯৭ সালে অধ্যাপক এম শামসুল হককে প্রধান করে যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি করা হয়, তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১৯৯৯ সালের প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি ২০০০ সালে সংসদে গৃহীতও হয়। আবার ২০০২ সালে ড. এমএ বারীকে প্রধান করে নতুন কমিশন গঠন করা হয়। সেটিকে বাদ দিয়ে একই সরকার আবার ২০০৩ সালে অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিঞাকে প্রধান করে নতুন আরেকটি কমিশন গঠন করে। তারপর সর্বশেষ ২০০৯ সালে জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে প্রধান করে জাতীয় শিক্ষা কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিশন ১৯৭৪ সালের শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন ও ২০০০ সালের শিক্ষানীতিকে ভিত্তি ধরে নতুন একটি শিক্ষানীতি তৈরি করে ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে শিক্ষানীতি হিসেবে গৃহীত হয় এবং এটিই হলো বর্তমান সরকারের ঘোষিত শিক্ষানীতি। কিন্তু ঘোষিত শিক্ষানীতির ভিত্তিতে আমাদের শিক্ষা চলছে না।

অর্থাৎ আজ পর্যন্ত কোনো সরকারই তাদের প্রণীত শিক্ষানীতি মেনে চলেনি। এটি এক আশ্চর্য ব্যাপার। ক্ষমতায় এসে নিজের একটা শিক্ষানীতি তৈরী করা যেন একটা ফ্যাশন। কিন্তু নীতি থাকে ডিপ ফ্রীজে কখনো এটিকে ডিফ্রস্ট করা হয় না। আসল বিষয়টা কী? বিশেষজ্ঞ কমিটি করে সরকার। আর সেটি বাস্তবায়নে যারা থাকে তারা হলো আমলা। আমলারা কখনোই বিশেষজ্ঞদের কথামত চলেনি। এইটা একটা সুপেরিওরিটি ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্সের দোলাচল। বিশেষজ্ঞদের কথা শুনলেতো বিষেশজ্ঞরা ক্ষমতাবান হয়ে যান। এই যে এই পান্ডেমিকের সময়ও সরকার একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিশেষজ্ঞ কমিটি করে। দেশ করোনায় নাজেহাল হউক আর গোল্লায় যাক কিচ্ছু যায় আসে না তারা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ শুনেনি।

বর্তমানে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষাক্রমের একটি আমূল পরিবর্তন আনছে। সেটা কী? সেটা হলো এসএসসি লেভেলে বিজ্ঞান, কলা আর বাণিজ্য শাখায় আর বিভাজন থাকবে না। এই পর্যন্ত খুবই ভালো। কিন্তু যেই পরিবর্তনের মাধ্যমে পুরোনোটাকে প্রতিস্থাপিত করছে সেটি বাস্তবায়িত হলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ২৪টা বেজে যাবে। বলা হচ্ছে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা যেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত, দেশপ্রেমিক, উৎপাদনমুখী, অভিযোজনে সক্ষম সুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক সেই জন্য নবম দশম শ্রেণীতেও সকল শিক্ষার্থী একই বিষয় পড়বে। বিষয়গুলো কী কী? বাংলা, ইংরেজি, সমাজবিজ্ঞান, বিজ্ঞান, তথ্য প্রযুক্তি, ভালো থাকি, জীবন ও জীবিকা, ধর্ম শিক্ষা, শিল্প ও সংষ্কৃতি এবং গণিত। তাহলে কী বাদ গেল?

আগে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা যে উচ্চতর গণিত পড়ত সেটা একদম নাই। আর আগে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা যে আলাদা করে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান পড়ত এখন নতুন প্রস্তাবিত কাররিকুলামে তিনটিকে একত্রিত করে নাম দেওয়া হয়েছে বিজ্ঞান যা আগে অষ্টম শ্রেণীতে ছিল। তাহলে কি দাঁড়াল? এই কাররিকুলাম পড়লে আগে কলা এবং বাণিজ্য শাখার শিক্ষার্থীরা যা পড়ত সেই তুলনায় বর্তমান এই কাররিকুলামটি মন্দ না। বরং ভালো কারণ এখন তারা বেশ কিছুটা বিজ্ঞান পড়বে। সমস্যাটা হলো যারা বিজ্ঞান শাখা পড়তো বা বিজ্ঞানী হতে চায় তারা মান অনেক নামিয়ে দেওয়া হলো। নবম দশম শ্রেণীর এই জ্ঞান নিয়ে তারা না হতে পারবে ইঞ্জিনিয়ার, না হতে পারবে ভালো ডাক্তার, না হতে পারবে ভালো পদার্থবিদ না, হতে পারবে ভালো প্রযুক্তিবিদ।

মোটের ওপর শিক্ষার মানের বারটি একটু নামিয়ে দেওয়া হলো। উদ্যেশ্য হলো কেউ যদি এসএসসি পাশের পর ঝরে যায় সে যেন কিছু করে খেতে পারে। মানে হলো ভালো থাকা ও জীবন জীবিকা নামক বিষয় ঢুকিয়ে মেইন স্ট্রিমের শিক্ষাকে এখন কারিগরি শিক্ষার দিকে নামিয়ে দেওয়া হলো। আবার যথেষ্ট বিজ্ঞান না শিখিয়ে প্রযুক্তি শেখানোর মাধ্যমে তাকে প্রযুক্তিবিদ না বানিয়ে টেকনিশান বানিয়ে কিছু একটা করে খাওয়ার দিকে নজর দেওয়া হলো। অথচ দেশের সমান্তরাল আরো কয়েকটি শিক্ষা ব্যবস্থা আছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইংরেজি মাধ্যম ও মাদ্রাসা মাধ্যম। ওই দুটোতে কিন্তু হাত দেওয়া হয়নি। বিশেষ করে ইংরেজি মাধ্যমে কোন সরকারই কখনোই হাত দেয়নি। ওখানে যারা পড়বে তারা যেন বিশ্বমানের শিক্ষা পায় সেটা নিশ্চিত করা হয়। কেন তাদের বুঝি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত দেশপ্রেমিক, উৎপাদনমুখী, অভিযোজনে সক্ষম সুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক হওয়ার দরকার নাই? যত দরদ আর খেলামেলা সব গরিবের সন্তানদের শিক্ষা নিয়ে?

এই কারিকুলাম কার্যকর হলে দেশের সর্বনাশ ঘটবে। আমাদের গরিবের সন্তানরা কেবল কেরানি, পিয়ন, মিস্ত্রি ইত্যাদি বানানোর এই কারিকুলাম অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ